সিল্করুট

উপমহাদেশজুড়ে তামাক বাণিজ্য

ফারিহা আজমিন

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পণ্যবাহী জাহাজ ছবি: মিডিয়াম

তামাকের আদি নিবাস সুদূর উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যেই এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে উপমহাদেশ জুড়েও। শুরুতে কেবলই উচ্চবিত্ত শ্রেণীর আমোদ-প্রমোদের অংশ হিসেবে তামাক থাকলেও ধীরে ধীরে এটি বাণিজ্যিক পণ্যের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে ঔপনিবেশিক আমলে উপমহাদেশজুড়ে তামাক বাণিজ্য সৃষ্টি করেছে অন্যতম এক ইতিহাস।

প্রায় ১৭ শতকের শুরু থেকে প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ভারত উচ্চ তামাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি হয়ে ওঠে। আধুনিক সময়ে ভারত বিশ্বের মোট এক-পঞ্চমাংশ থেকে এক-চতুর্থাংশের কাছাকাছি পরিমাণ তামাক উৎপাদন করছে। যা বিশ্বের আরো দুটি সর্বোচ্চ তামাক উৎপাদনকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের তামাক উৎপাদনের প্রায় সমান। তবে আদি থেকেই ভারতে বৃহৎ উৎপাদন প্রধানত অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্যই উৎপাদিত হয়ে আসছে। তাই উৎপাদনের তুলনায় রফতানি হয়েছে তুলনামূলক কম। 

তামাক চাষ ও ব্যবসার প্রসার এবং বৃদ্ধি সপ্তদশ শতাব্দীর ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এক অধ্যায়। নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে প্রবর্তিত তামাক গাছ দ্রুতই ভারতীয় কৃষিতে জায়গা করে নেয় এবং কয়েক দশকের মধ্যে তামাক প্রধান অর্থকরী ফসলেও পরিণত হয়। প্রায় ১৫৯০ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশে এ উদ্ভিদের এক প্রকার অজানাই ছিল। এমনকি সম্রাট আকবরের আদালতে ইতিহাস লেখক আবুল ফজলের মহান প্রশাসনিক সংকলন আইন-ই-আকবরিতেও কোথাও তামাকের উল্লেখ নেই। 

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে এটি তখনো নতুন ছিল। কিন্তু ১৬১৭ সাল নাগাদ এর ব্যবহার এতটাই ব্যাপক হয়ে ওঠে, শুধু অভিজাতদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এর চাহিদা বেড়ে যায়। এ অবস্থা প্রতিরোধে আকবরের উত্তরসূরি সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭) তামাক ব্যবহার বা ধূমপান নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আইন জারি করেছিলেন। তবে ভারতবর্ষে প্রথম কবে তামাক গাছ রোপণ করা হয় তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সে অর্থে কোনো লিখিত গ্রন্থে তামাকের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্ট ডব্লিউ এইচ মোরল্যান্ড এ বিষয়ে বলেছেন: আকবরের রাজত্বকালে ভারতে তামাক উৎপাদন খুব কম ছিল। তামাক উদ্ভিদটি তার রাজস্ব কর্মকর্তাদের কাছে ছিল অজানা এবং ফলস্বরূপ ষোড়শ শতাব্দীতে এটি অধিক পরিমাণে জন্মাতে পারেনি। এটি পর্তুগিজ বণিকদের মাধ্যমেই ভারতে পৌঁছেছিল বলে ধারণা করা হয় এবং সর্বপ্রথম ভারতের গুজরাট প্রদেশেই তামাক পাতা পাওয়া যায়। সেখানে ১৬১৩ সালে প্রথম তামাক পাতা পাওয়া যায়, কিন্তু উৎপাদন শুরু হয়েছিল কবে থেকে তা জানা যায়নি। 

ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের পর্যালোচনায় জানা যায়, দক্ষিণ ভারতের বিজাপুর থেকে ফিরে আসা একজন রাজদূত আকবরকে একটি হুক্কা উপহার দিয়েছিলেন। 

তামাক প্রথম উল্লেখযোগ্যভাবে ১৬০৪ থেকে ১৬০৫ সালে ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া গেছে। সেখানকার গোলকোন্ডা রাজ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট উইলিয়াম মেথওল্ডের (১৫৯০ থেকে ১৬৬৩), পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে: ভারতে তামাক চাষ করে সেগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম তৎকালীন আরাকান রাজ্যে রফতানি করা হতো। পাশাপাশি তিনি আরো উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশরা নিজেরাও ধূমপানের জন্য এ তামাক পাতা সংরক্ষণ করত। কোনো প্রকার যত্ন ছাড়াই এ পাতা শুধু রোদে শুকিয়েই ব্যবহার করা যায়, কোনো রকম পরিশীলতা ছাড়াই। মেথওল্ডের মতে, ভারতের কোরো ম্যান্ডেল উপকূলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে তামাকের চাষ স্থানীয় চাহিদা এবং রফতানির জন্য যথেষ্ট ফসল উৎপাদন করা হতো। 

১৬২২ সালের আগে লোহিত সাগর-পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল এবং উপকূলীয় বার্মা পর্যন্ত তামাক পাতা বাণিজ্য হতো। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায়, উদ্ভিদটি প্রথম চাষের পর এটি অর্থকরী ফসল হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অর্জন করতে কয়েক দশক সময় লেগেছিল। ভারতের সুরাটে তামাক চাষের প্রমাণও পাওয়া গেছে। তথ্যপ্রমাণে যেটুকু জানা যায়, তামাক প্রাথমিকভাবে ভারতের দুটি পৃথক অঞ্চলে চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। বর্তমান ভারতের গুজরাটের সুরাট থেকে তৎকালীন ব্রোচ অঞ্চল পর্যন্ত এবং অন্ধ্র প্রদেশের মসুলিপটাম থেকে শুরু করে বেশকিছু অঞ্চলজুড়ে তামাকের চাষ হয়েছে ১৬০০ সালের আগ পর্যন্ত।  

প্রকৃতপক্ষে তামাক ১৬১৬ সাল নাগাদ একটি শিল্প হিসেবে ভার্জিনিয়াতে শুরু হয়েছিল। যা ১৬৩০ সালের মধ্যেই ৫০ হাজার পাউন্ড রফতানি করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতের কাছে তামাকের পরিচয় হয়েছে ইউরোপীয়দের মাধ্যমে, বিশেষ করে পর্তুগিজদের মাধ্যমে। পর্তুগিজ পর্যটক সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক (১৫৮৭-১৬৭৯ সাল) তার ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন, তিনি বাংলায় তামাক চাষ দেখেছিলেন। যেগুলো উপকূলীয় বার্মার আরাকানের বাজারে বিক্রি করা হতো। তবে তামাক উৎপাদনের সবচেয়ে বড় অংশ হিসেবে সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে ভূমিকা রেখেছে গুজরাট ও অন্ধ্র প্রদেশ অঞ্চল। ব্রিটিশ শারীরতত্ত্ববিদ জন ফ্রেইয়ের (১৬৫০-১৭৩৩), যিনি পারস্য এবং ভারতবর্ষ ভ্রমণে এসেছিলেন ১৬৭২ থেকে ১৬৮১ মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে, তিনি সুরাটের বেশকিছু এলাকাজুড়ে তামাক চাষ হতে দেখেছেন। এছাড়া থমাস ব্রোরেই ১৭১৩ সালের দিকে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গা তামাক চাষ হতে দেখেছেন। এমনকি তামাককে উত্তর ভারতে উপহার হিসেবেও গ্রহণ করা হতো। বিয়েবাড়িতে পান-সুপারির সঙ্গে তামাক পাতা পরিবেশন করা হতো। তাই ভারতের অন্ধ্র প্রদেশসহ মাদ্রাজেও এটি চাষ হতো এবং সেখান থেকে সুমাত্রার অচিনে রফতানি করা হতো। এটি ছিল সেখানকার স্থানীয় সরকারের একচেটিয়া একটি ব্যবসা। এছাড়া ব্রোরেইয়ের লেখায় জানা গেছে রাজ্যের যে কোনো অংশে উৎপাদিত তামাক বিক্রির আগে রাজার কাছে নিয়ে যেতে হতো। তারপর বাজারে বিক্রি করা হতো এবং তামাক ব্যবসায়ীরা পথে পথে তামাক বোঝাই করে ভ্রমণকারীদের সন্ধানে অপেক্ষা করত। যেহেতু অপরাধ হিসেবে তামাক সেবন অন্তর্ভুক্ত ছিল না তাই সাধারণভাবে স্থানীয়রা প্রচুর তামাক গ্রহণ করত। 

ইংল্যান্ড-আমেরিকার চেয়েও এ সময়ে ভারত হয়ে উঠেছিল সর্বোচ্চ তামাক সেবনকারী দেশগুলোর একটি। কেবল তামাক উৎপাদন বা সেবনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তামাক রফতানিতেও নাম লিখিয়েছিল ভারত। তৎকালীন ভারতীয় অভিজাত ব্যক্তিদের একজন ছিলেন আসাদ বেগ। তিনি সে সময়ে উপমহাদেশের নানা অঞ্চল ঘুরে ভারতের বিজাপুরে এসেছিলেন। তিনি লিখেছেন,

‌বিজাপুরে বেশকিছু তামাক গাছ দেখেছি। ভারতে এর মতো আগে কখনো দেখিনি, আমি আমার সঙ্গে কিছু নিয়ে এসেছিলাম। আদিল খান (বিজাপুরের সুলতান) আমাকে একটি সুপারির থলি দিয়েছিলেন, আমি সেটি সূক্ষ্ম তামাক দিয়ে পূর্ণ করেছি। আমি একটি রূপালী ট্রেতে সব সুন্দরভাবে সাজিয়েছি।

এছাড়া তার বর্ণনা থেকে আরো জানা যায়, যখন থেকে তামাকের চাহিদা বাড়তে থাকে তামাক বিক্রি শুরু হয় তখন থেকেই ধূমপানের প্রথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ১৬০৪ বা ১৬০৫ সালেই মূলত তামাক দিয়ে ধূমপানের প্রথা মোগল ভারতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যদিও বা সম্রাট জাহাঙ্গীর তার শাসনামলে তামাক চাষ এবং তামাক সেবনে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তবে ভারতে বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে কোম্পানির বাণিজ্যের সময় পণ্যে আদান-প্রদান এবং বিক্রি বা আমদানির আনুষঙ্গিক নোটিস থেকে জানা যায় কেবল দিল্লি থেকেই সে সময়ে তামাক রফতানি বাবাদ প্রতিদিন ২৫০০ রুপি পাওয়া যেত। তবে ডব্লিউ এইচ মোরল্যান্ডের মতে, কেবল দিল্লির জনসংখ্যাই ছিল সে সময় এক লাখ, সেখানে প্রতিদিন ২৫০০ রুপি আয় হলে এক মাসেই নয় লাখ বারো হাজার পাঁচশ রুপি আয় হয়, যা একেবারে অসম্ভব। 

ধারণা করা হয় কোম্পানির লাভ শুরু হওয়ার পর থেকেই ভারতবর্ষজুড়ে তামাক রফতানির বড় পরিসর শুরু হয়। ব্রিটিশ নথিতে তামাকের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬১২ সালে। যখন একজন রবার্ট ক্লার্কসন সুরাটে তামাক প্রস্তুতকারী ফ্যাক্টরির দায়িত্বে ছিলেন। গোমব্রুন এবং পারস্য উপসাগর-লোহিত সাগর এলাকাজুড়েও ছিল তামাক চাষ। পূর্ব উপকূলে অন্ধ্র প্রদেশ একটি প্রধান তামাক-উৎপাদক অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এর প্রধান বন্দর ছিল গোলকোন্ডা রাজ্যের মসুলিপটাম শহর। এছাড়া মাদ্রাজ অঞ্চলের দক্ষিণে প্রচুর পরিমাণে তামাক বিক্রির জন্যও পাওয়া যেত। দক্ষিণ ভারতের তামাকও মাঝে মাঝে জাহাজে করে পারস্যে নিয়ে যাওয়া হতো কিন্তু প্রধানত সুমাত্রার অচিন এবং জাভায় নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে ভালো দাম পাওয়া যেত তামাকের। দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের প্রধান বিক্রেতারা ছিল ডাচ। এছাড়া ১৬৬৫ সাল নাগাদ বোম্বাইয়ের তামাকের আয় বছরে ৪২০ পাউন্ডেরও বেশি হয়ে গিয়েছিল। বাংলা, বিহার, ওড়িশার পাশাপাশি উত্তর ও মধ্য ভারতেও সপ্তদশ শতাব্দীতে তামাক চাষের বৃদ্ধি দেখা যায়।

ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় কৃষিতে তামাকের সূচনা হয়েছিল এবং কৃষক নগদ অর্থ থেকে লাভবান হতে শুরু করেছিল। শতাব্দীর শেষের দিকে ধূমপানের মাধ্যমে বা পান চিবানোর মাধ্যমে তামাক খাওয়া ভারতীয় সমাজে রীতির মতো বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। তামাক নিম্নবিত্ত মানুষের মতো অভিজাতদের মধ্যেও চাহিদার পণ্য হয়ে উঠেছিল এবং এ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছিল। তামাক চাষের মুনাফা কৃষক এবং সরকার উভয়ের জন্যই যথেষ্ট ছিল। এভাবে তামাকের বৃদ্ধি ভারতীয় কৃষি ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক উন্নয়নের সৃষ্টি করে। ফলে কয়েক দশকের মধ্যে তামাক ভারতীয় অর্থনীতিতে একটি প্রধান অর্থকরী ফসল হতে শুরু করে। 

ফারিহা আজমিন: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা