সিল্করুট

বাংলা থেকে রফতানি হতো ইউরোপে

মুহম্মদ আল মুখতাফি

ঊনিশ শতকের তামাক ব্যবসায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম বখশ এলাহি অ্যান্ড কোং ছবি: ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া

১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন। একই বছর যাত্রা শুরু করে আরো একটি প্রতিষ্ঠান, নাম ইম্পেরিয়াল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ঔপনিবেশিক ভারতের কৃষিতে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হয়ে ওঠে শিগগিরই। এটি ভূমিকা পালন করে বাংলায় তামাক শিল্পের প্রসারের প্রথম বড় পদক্ষেপ হিসেবে। 

উপমহাদেশে তামাকের শুরুটা ছিল পর্তুগিজদের হাতে। তবে ইংরেজ আমলে ভারত তামাক উৎপাদনে শীর্ষে পৌঁছায়। পশ্চিমা বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে ১৭ শতকেই ভারত পরিণত হয় তামাকের অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রে। সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগেই বাংলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে তামাকের বাজার। বিশেষ করে রাজা, মহারাজা, ভূস্বামী ও অভিজাতরা হুঁকার মধ্য দিয়ে তামাক সেবন করত। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বাইরেও রফতানি হতো বাইরে। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেই কেবল নয়, বাংলার তামাক সমুদ্রপথ ধরে গিয়ে পৌঁছাত লন্ডন ও ভ্যানিসের বন্দরগুলোয়।

ব্রিটিশ সরকারের কাস্টম হাউজের দেয়া তথ্য অনুসারে, ১৮৭১-৭২ অর্থবছরে বাংলা থেকে রফতানি হওয়া তামাকের মূল্যমান ১১ লাখ ৭২ হাজার ১৫৪ রুপি। ১৮৭২-৭২ অর্থবছরে এর আকার বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ লাখ ১০ হাজার ৬৪৮ রুপি। পরবর্তী বছরে সংখ্যাটি আরো বেড়েছে। ১৮৭৩-৭৪ অর্থবছরে রফতানি হওয়া তামাকের আকার ২২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫ রুপি। একই সূত্র থেকে দেখা যায়, ১৮৭৪ সালের কেবল প্রথম ১০ মাসেই রফতানির আকার ছিল ১৮ লাখ রুপি। উৎপাদন ও রফতানির ঊর্ধ্বমুখী গতি অব্যাহত ছিল দীর্ঘদিন। বাংলা থেকে ইউরোপে তামাক রফতানি ছিল অনেকটা নতুন ধরনের বাণিজ্য। আর যেহেতু রফতানি হতো, তার মানে মানও ছিল তুলনামূলক ভালো। এদিকে বার্মায় যে তামাক দিয়ে চুরুট বানানো হতো, তা ছিল রংপুরে উৎপাদিত। রংপুরে প্রায় ৬০ হাজার একর জায়গাজুড়ে উৎপাদন হতো তামাক। প্রতি একরে উৎপাদন হয় নয় মণ, প্রতি মণ বিক্রি হয় ৬-১২ রুপিতে। প্রধান তামাক উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলো ছিল রংপুর, তিরহুত, কুচবিহার, দিনাজপুর, পূর্ণিয়া, মুঙ্গের ও নদীয়া। রংপুর থেকে রফতানি আয় ছিল ১৬ লাখ ৫ হাজার রুপি। তিরহুতের ৪০ হাজার একর জায়গায় চাষ করা হতো তামাক; যদিও কোনো রফতানির তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। কুচবিহারের ২৪ হাজার একর জায়গায় চাষ করা হতো তামাক; সেখান থেকে রফতানি আয় ছিল ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫০ রুপি। দিনাজপুরে আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার একর; রফতানি আয় ছিল ১ লাখ ২০ হাজার রুপি। পূর্ণিয়ায় আবাদি জমির পরিমাণ ১৫-২০ হাজার একর। রফতানি বাবদ আয় ছিল ৩ লাখ রুপি। মুঙ্গেরের আবাদি জমির পরিমাণ ১০ হাজার একর; সেখান থেকে রফতানি আয় ১ লাখ ৩০ হাজার রুপি। নদীয়ায় আবাদি জমির পরিমাণ ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার একর; সেখান থেকে আসা রফতানি আয়ের আকার ২ লাখ ৫০ হাজার রুপি।

বাংলা থেকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বন্দরগুলো ও সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো। ১৮৭১-৭২ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৯ লাখ ৪৪ হাজার ২৬১ রুপি। ঠিক পরের বছরে অর্থাৎ ১৮৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি ছিল ৫ লাখ ১০ হাজার ৫৯৩ রুপি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে বছর কলকাতা ও চট্টগ্রাম বন্দরে কমেছে রফতানির আকার। চট্টগ্রাম বন্দরের রফতানি কমেছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮০০ পাউন্ড, যার বাজারমূল্য ২৯ হাজার ৪৬২ রুপি। তবে অবনতি সাময়িক সময়ের জন্য। ঔপনিবেশিক আমলে তামাক রফতানির প্রধান কেন্দ্রই ছিল ইউরোপ। প্রথমে গ্রেট ব্রিটেন ও ইতালির বন্দরগুলোয় ভিড়েছে তামাকবাহী জাহাজ। পরবর্তী সময়ে একে একে যুক্ত হয়েছে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম ও হল্যান্ডের নাম। 

তামাক ব্যবসা কেন্দ্র করে বাংলায় গড়ে উঠেছিল নতুন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী। হুঁকা থেকে সিগারেটে বিবর্তন তামাক ব্যবসাকে গতি দিয়েছে। বিষয়টিকে স্পষ্ট করতে একটা আখ্যান সম্ভবত প্রাসঙ্গিক। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে হাজি করম এলাহি ব্যবসা পরিচালনা করতেন দিল্লিতে। ব্রিটিশ আমলে যখন দিল্লির অবক্ষয় ও কলকাতার উত্থান ঘটছিল, তখন হাজি করম এলাহির ছোট ভাই বখশ এলাহি ১৮৭৮ সালে আসেন কলকাতায়। তামাক সেবনের অভ্যাস তখন জনপ্রিয় হওয়ার পর্যায়ে। সেখানে তিনি দেখেছিলেন মানুষের হুঁকা ও সিগারেটের চাহিদা। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বখশ এলাহি তার ভাইয়ের কাছ থেকে পুঁজি সংগ্রহ করলেন। তামাক ক্রয়ের মধ্য দিয়ে শুরু করলেন তার সিগারেটের ব্যবসা। প্রতিষ্ঠিত হলো বখশ এলাহি অ্যান্ড কোং। বখশ এলাহি সিগারেটের প্রচারণা চালান সে সময়কার ভারতীয় সংগীতের তারকা গওহর জানকে দিয়ে। কোম্পানিটির সফলতা ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১৯০১ সাল পর্যন্ত বখশ এলাহির ব্যবসা ছিল এক রকম একচেটিয়া। এ সময়ে বাইরে থেকে যেসব কোম্পানি বাংলায় প্রবেশ করত, তারা এলাহি অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারত্বের চুক্তি করত। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ই.জে পারিশ কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রিটে ডিপো স্থাপন করে। এভাবে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হতে থাকে তামাকের ব্যবসা। হাজি বখশ এলাহি পরবর্তী জীবনে বাংলার চেম্বার অব কমার্সের সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে খান বাহাদুর উপাধিও দেয়। বাংলার মানুষের তামাকে অভ্যস্ততা এখন আরো বেশি। ধূমপায়ীর সংখ্যা বেড়েছে বই কমেনি। তবে সেই বিখ্যাত বখশ এলাহির কথা কেউ জানে না। সিগারেটের ধোঁয়ার মতোই তিনি ও তার অর্জনকে সঙ্গে নিয়েই হারিয়ে গেছেন মানুষের স্মৃতি থেকে।

মুহম্মদ আল মুখতাফি: লেখক