সিল্করুট

তামাক

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস

দরবারে বসে তামাক সেবন করছেন নওয়াব আসাফুদ্দৌলা ছবি: ব্রিটিশ লাইব্রেরি

তামাকের ব্যবহার এখন জগৎ জুড়িয়া। কেহ তামাক-পাতার গুঁড়া চিবাইয়া খান, কেহ নস্য করিয়া নাকে গোঁজেন, কেহ পাতাকোটা গুড় মশলা দিয়া তৈয়ার করা তামাক পুড়াইয়া তাহার ধোঁয়া কতক শ্বাস-প্রশ্বাসের সহিত পেটে পুরেন, কতক নাক মুখ দিয়া বাহির করিয়া দেন। তামাক বর্তমান জগতের অল্প লোকেরই ব্যবহারে আসে না।

যে সকল কাজ করিতে বারণ করিলে ছেলে বুড়ো সকলে সেগুলাই আগে করিয়া বসে, তন্মধ্যে তামাক খাওয়াও একটি। কিশোর বা যুবারা তাই বিড়ি সিগারেট বেশী টানে, ছাত্রমহলে নস্যও বড় কম চলে না। স্বদেশী আন্দোলন কি করিয়াছে না করিয়াছে তাহা বলিতে যাওয়া তত নিরাপদ নহে, কিন্তু উহা যে চায়ের দোকানের সহিত সমানে টক্কর দিবার মত সহরের অলিতে-গলিতে স্বদেশী বিড়ির দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।

ডাক্তাররা বলেন, মেয়েদের মধ্যে হিষ্টিরিয়ার এত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ পানে খাবার দোক্তা-জদ্দার প্রচলনাধিক্য। যাহা হউক সেকালে পুরুষ-মহলে চমকি পাথর তামাক টিকে কয়লা আর শোলার বোঝা, ঠিকরে চিমটে, গুল আর ছাই ছড়াবার নোংরামিটা যেমন দেশলায়ের আবির্ভাবে ঘুচিয়া গিয়াছিল, আর এখন দেশলাই, চুরুট, বিড়ির দৌলতে, হুঁকা কলিকা তামাক টিকে ছিঁচকে কয়লাগুলের রেল্যা, নলিচা সাফ ও জল বদলের পালা আর তাওয়া আলবোলা ও স্বর্ণাকৃতি শঙ্কা ক্রমেই অদৃশ্য হইতেছে, তেমনি একালের মেয়েরাও গালের মধ্যে পোড়া তামাক বা গুল টিপিয়া রাখিয়া চারিদিকে নিষ্ঠীবন ত্যাগের প্রথা উঠাইয়া দিয়াছেন; যাহা প্রাচীনা পল্লী-বাসিনীদের মধ্যে এখনও কিছু কিছু আছে, তাঁহাদের পর থাকিবে না, এরূপ আশা হয়। কিন্তু রেলকোম্পানীর বাই-ল’র নিষেধ সত্ত্বেও ধূমপায়ী ও সুখা সেবী ব্যসনীদের জ্বালায় নিরীহ তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের আর সুখ নাই। পশ্চিমারা যখন চূণ মিশাইয়া দোক্তা বাম করতলে রাখিয়া দক্ষিণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা পিশিয়া ঘন ঘন তালি দিতে দিতে তাহার ধূলা উড়াইতে থাকে, কিম্বা গাড়ীর শ্বাসরোধকারী ভিড়ের মধ্যে সিগারেট ও সস্তার-বিড়ি টানিয়া ধোঁয়া ছাড়িতে থাকে তখন অনভ্যস্ত যাত্রীরা বিব্রত ও অতিষ্ঠ হইয়া উঠে। তামাকখোরদের তৎপ্রতি দৃকপাত নাই। এই পাপেই হউক অথবা তামাকের নিজের দোষেই হউক ডাক্তার কবিরাজ মহাশয়গণ চিকিৎসা গ্রন্থাদিতে এবং সাময়িক প্রবন্ধে তামাক ব্যবহার সম্বন্ধে অতি ভীষণ অভিসম্পাৎ-বাণী লিখিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, চুরুটের ধোঁয়া খাইতে খাইতে ক্রমে শ্বাসনালী ও ফুসফুসের উশ্লৈষ্মিক ঝিল্লির প্রদাহ আরম্ভ হয়, দেহে থাইসিস্ ও ক্যান্সার রোগের বীজাণু বৃদ্ধি হয়। ইহা শুষ্ক কাশ, স্বরবিকার, হাঁপানি, স্নায়বিক দৌর্বল্য, শিরঃশূল, অবসাদ, কার্য্যে অনিচ্ছা, অনিদ্রা ঘটায়, শ্বাসনালী ও পাকস্থলী হইতে এই বিষ রক্তের সহিত মিশিয়া হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়ায় বাধা দেয়, হৃদস্পন্দন জন্মায়, দৃষ্টি ও স্মৃতিহ্রাস করে, মাংস-পেশী শিথিল করে। কলিকার আগুনের ফুল্কী উড়াইয়া পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির গাত্রবস্ত্র পুড়াইয়া দেওয়া আর-একটি রোগ বিশেষ। তাহা ছাড়া তামাকখোরেরা নিজের মুখের দুর্গন্ধ নিজেরা না পাইলেও তাঁহারা যাঁহাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে আলাপ করেন তাঁহারা পাইয়া থাকেন।

যাঁহারা গোলামের ন্যায় তামাকের বশীভূত হইয়া হুঁকা হাতে করিয়াই বাড়ীময় হুঁকা খুঁজিয়া বেড়ান, কিম্বা যাঁহারা তামাকের বিষ-ক্রিয়ায় ক্ষুধামান্দ্য, শৈথিল্য, শীর্ণতা, শুষ্কতা, কম্পন, শিরোঘূর্ণন, আচ্ছন্নভাব ও অবসাদ আদি দৈহিক গ্লানি ভোগ করিয়া অনুতপ্ত এমন ভুক্তভোগীরা উপরিউক্ত বিজ্ঞ চিকিৎসকগণের কথায় তথাস্তু করেন। তথাপি তামাকের ভক্তগণ বঙ্কিমবাবুকে দলে পাইয়া বলেন, তামাক তাঁহাদের আরামদায়ক, বিরামদায়ক, মুখগন্ধ-নাশক, দন্তমূলদৃঢ়কারক, বিরেচক, মাথায় বুদ্ধি উৎপাদক, কার্য্যে প্রবৃত্তিদায়ক, শ্লেষ্মা, তন্দ্রা এবং সর্ব্বপ্রকার জড়তা নিবারক। তাঁহারা আয়ুর্ব্বেদের ফুসফুস দুর্ব্বলকারক, ক্ষণিক সজীবতায় প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সমধিক অবসাদ উৎপাদক এবং অগ্নিমান্দ্য অজীর্ণ বর্দ্ধক প্রভৃতি দোষবিজ্ঞাপক বেদবাক্য না মানিয়া মাত্র তামাকের গুণগ্রাহী হইয়া বলেন, তামাকের ধূম কফনাশক, দন্তশুদ্ধিকারক ও মুখরোগনিবারক। এখানে বলা ভাল যে, তামাকের যে-কোন অবস্থাতেই তাহার নিকোটিন নামক বিষ দেহে প্রবেশ করে ও কিছু না কিছু অনিষ্ট করেই। তবে যদি বলেন, কেহ খুব তামাক খাইয়া ও চুরুট ফুঁকিয়াও বেশ আছেন, তিনি নিয়মের ব্যতিক্রম মাত্র।

সে যাহাই হউক, তামাক এই শব্দের মূল কি? ইহা সংস্কৃত শব্দ নহে, সংস্কৃত শব্দমূলকও নহে। প্রাচীন অভিধানে এ-শব্দ বা ইহার অর্থ জ্ঞাপক প্রতিশব্দ নাই। আধুনিক অভিধানে ইহার তাম্রকূট, কলঞ্জ, ধূমপর্ণী, তমাল এই নাম পাওয়া যায়। ইহার অর্ব্বাচীন সংস্কৃত পর্যায় “ধূম্রাহা, গৃঘ্রপত্রা, গৃধানী, কৃমিথ্বী, শ্রীমলীপহা, সুলভা ও স্বয়ম্ভবা।” পূর্ব্বে আয়ুর্ব্বেদীয় চিকিৎসা শাস্ত্রানুসারে ধুতুরার পাতা, তালীশপাতা ও তেজপাতা বাতির মত পাকাইয়া তাহার ধূমপান করিবার প্রথা প্রচলিত ছিল এবং নেশার জন্য লোকে সিদ্ধিপাতা ও গাঁজার ধূম পান করিত। এই বাতিকে ধূমবর্তিকা বলিত এবং উহা দন্তশোধনার্থ ও শ্বাস, হাঁপ, পীনস, বস্তিশূল, হিক্কা, ক্ষয়কাশ, সর্দি, বমনবেগ প্রশমনে ও অন্যান্য রোগে প্রয়োগ করা হইত।

সংস্কৃত ধূমের নাম খ-তমাল। তামাকপাতা তমাল-পত্র নামে অভিহিত হইল। সুতরাং তমাল ও তামাক অর্থে চলিয়া গেল। বেট সাহেব কৃত Dictionary of the Hindu Language নামক অভিধানে তমাল শব্দের অর্থ-পর্যায়ে আছে 2. Name wrongly given to tobacco অর্থাৎ তামাককে ভুলে তমাল বলা হয়। ভুল ত বটেই, কারণ তামাক জিনিসটাই ভারতের নহে, শুধু ভারতের বলি কেন, এশিয়া, য়ুরোপ, আফ্রিকা এ তিনটি মহাদেশেরই নয়। তামাক আমেরিকার দেশজ ও নিজস্ব। ১৪৯২ খৃষ্টাব্দে আমেরিকা আবিষ্কারের পর য়ুরোপ প্রথমে তামাকের সন্ধান পায়। আবিষ্কর্তা কলম্বাস প্রথমে সানসাল্ডের ও পরে কিউবা দ্বীপে ইহার ব্যবহার দেখিতে পান। তথায় আদিম অধিবাসীরা তামাক পাতা পাকাইয়া লম্বা লম্বা নলের মত করিয়া তাহার ধূম পান করিত। দেশ ভাষায় তাহারা যাহা বলিত, সেই উচ্চারণের অনুকরণে য়ুরোপে তামাক আনয়নকারীরা ‘টাবাকো’ শব্দের প্রবর্তন করেন। আদিম মার্কিন পুরুষদেরই ইহা পানীয় ছিল। তাহাদের স্মৃতি শাস্ত্রমতে তাহাতে অধিকার ছিল না। টাবাকোর ধূমপান, দেবতাদের সোমপান, সন্ন্যাসীদের সিদ্ধিপান ও গঞ্জিকা সেবনের ন্যায় পুণ্যকর্ম বলিয়া তাহাদের বিশ্বাস ছিল। 

ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভ হইতে য়ুরোপীয় জাতিরা আমেরিকায় গমনাগমন করিতে থাকে। লোকের ধারণা সার ওয়াল্টার রালেই সর্ব্বপ্রথম আমেরিকা হইতে য়ুরোপে তামাকের আমদানী করেন, এবং পর্তুগীজরা ভারতবর্ষে তাহার প্রচলন করে। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, জ্যাকুইস্ কার্টিয়ের (Jacquis Cartier) কানাডায় এবং আঁন্দ্রে থেভেট (Andre Thevet) ব্রেজিলে গিয়া তামাকের সন্ধান পান। তাহারা এবং অন্যান্য অনেকেই তামাকের বীজ য়ুরোপে আনিয়া তথাকার লোকের সহিত পরিচয় করাইয়া দেন। আঁন্দ্রে থেভেট কর্তৃক ১৫৩৬ অব্দে ফ্রান্সে তামাক প্রথম আনীত হয়। ১৫৮৬ খৃষ্টাব্দে ফ্রান্সিস ড্রেক্ নামক প্রসিদ্ধ নাবিক সর্বপ্রথমে ইংলন্ডে তামাক আনেন। রালে সেই জাহাজে করিয়াই আমেরিকা হইতে দেশে আসিয়াছিলেন। টাবাকো তুর্কি ও পারসীকদিগের মধ্য দিয়া আসিয়া হিন্দীতে স্বভাবত অনুনাসিক উচ্চারণ তম্বাকু-তামাকু আকার ধারণ করিয়া বঙ্গে তামাক ও তামুক হইয়া দাঁড়ায়। অতঃপর সাধুভাষায় ব্যবহার করিবার জন্য ইহার আটপোউরে নাম ঘুচাইয়া সংস্কৃত অভিধানে “তাম্রকূট” ও “তমালপত্র” এই সুষ্ঠুবেশ দেওয়া হয়। অমরকোষে তামাক জ্ঞাপক শব্দ নাই। তাহাতে তাম্রকূট ও তমালপত্র ভিন্নার্থক। তাহা হইলে কোন সময় হইতে সংস্কৃত সাহিত্যে তামাক অর্থে “তমাল-পত্র” প্রবেশ করিল। হালাত-ই আসাদ বেগ নামক গ্রন্থগত বিবরণ হইতে জানা যায়, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তামাকের নাম ভারতবাসীর সর্ব্বপ্রথম কর্ণগোচর হয়। আসাদ বেগ নামক জনৈক তুর্কী ভদ্রলোক নানা দেশ হইতে সংগৃহীত বহু অভিনব দ্রব্য আনিয়া সম্রাট আকবরের দরবারে উপস্থিত হন। তাঁহার প্রদর্শিত বস্তুর মধ্যে ছিল তামাকের পাতা। উহা তিন তিন হাত লম্বা মণিরত্ন খচিত-মুখ নলের মুখে লাগান চুরুটের আকারে পাকাইয়া রাখা হইয়াছিল। বাদশাহ উহা দেখিয়া বিস্ময়ের সহিত যখন জানিতে চাহিলেন, উহা কি? উত্তরে নবাব খান-ই-আজম বলিলেন, ইহার নাম তাম্বাকু। মক্কা মদীনার লোক ইহার সহিত খুব পরিচিত। সম্রাট সমস্ত শুনিয়া একটী মুখে দিয়া ধূমপান করিতেই তাঁহার চিকিৎসক নিষেধ করেন। কিন্তু বাদশাহ বলেন, সংগ্রহকর্তা আসাদ বেগের আনন্দ বন্ধনের জন্য তিনি নিশ্চয়ই অল্পস্বল্প পান করিবেন। কিন্তু দুই চার টান দিতেই হকীম সাহেব সম্রাটের অনিষ্টাশঙ্কায় অতি উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন, এবং কিছুতেই আর অধিক পান করিতে না দিয়া নলটি তাঁহার মুখ হইতে সরাইয়া খান ই-আজমকে দুই তিন টান টানিতে দিলেন। তিনি তাঁহার সহযোগী দ্রব্যগুণাভিজ্ঞ হকীমকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তামাকের গুণ কি?

দ্বিতীয় হকীম বলিলেন, তাঁহার গ্রন্থাদিতে উহার উল্লেখ পর্যন্ত নাই। উহা সম্পূর্ণ নূতন আবিষ্কার। তামাক-পাতা চীন দেশ হইতে আনীত এবং য়ুরোপীয় ডাক্তারগণ কর্তৃক বহুল প্রশংসিত। প্রথম হকীম বলিলেন, প্রকৃত পক্ষে এই ঔষধটি এখনও অপরীক্ষিত। চিকিৎসকগণ ইহার বিষয় কিছুই লেখেন নাই। এমন অজানা জিনিসের গুণ তাঁহারা কিরূপে সম্রাট-সমীপে বর্ণন করিবেন। সুতরাং সম্রাটের উহা ব্যবহার যুক্তিসংগত নহে। 

এই কথায় আসাদ বেগ প্রথম হকীমকে বলিলেন, ‘য়ুরোপীয়রা এত নির্বোধ নহেন যে, ইহার বিষয় কিছুই জানেন না। তাঁহাদের মধ্যে এমন অনেক জ্ঞানী লোক আছেন যাঁহাদের ভুল প্রায়ই হয় না। আপনি পরীক্ষা না করিয়াই ইহার দোষ গুণ না জানিয়াই কিরূপে এরূপ সিদ্ধান্ত করিতে পারেন যাহার উপর চিকিৎসকগণ, নর-পতিগণ এবং অন্যান্য মহাপুরুষ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ নির্ভর করিতে পারেন? কোন কিছু বিশেষ পরীক্ষার পর তাহা ভাল কি মন্দ বলাই ঠিক।’

এ কথায় প্রথম হকীম বলিলেন, ‘আমরা য়ুরোপীয়দের অনুসরণ করিতে ও আমাদের নিজেদের দেশের জ্ঞানী লোকেরা পরীক্ষা করিয়া যে-ব্যবস্থা দেন নাই, এমন আচার অবলম্বন করিতেও চাহি না।’

তখন আসাদ বেগ বলিলেন, ‘বড়ই আশ্চর্য্যের কথা। বাবা আদমের কাল হইতে আজ পর্য্যন্ত জগতের প্রত্যেক অভ্যাসই কোন-না-কোন সময়ে সম্পূর্ণ নূতন ভাবেই দেখা দেয়। যে-কোন প্রথাই হউক না, তাহা প্রথম আবিষ্কৃত হইয়া ধীরে ধীরে কোন জাতির মধ্যে প্রবর্তিত হয়, আর তাহা জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করে, প্রত্যেকেই তখন তাহা গ্রহণ করে। বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণ ও হকীমগণের কর্তব্য, দ্রব্যের গুণাগুণ জানিয়া কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। ভাল গুণগুলি প্রথমেই প্রকাশ না পাইতে পারে। চোবচিনির শিকড় China root আগে কেহই জানিতেন না। ইহাও নূতন আবিষ্কার। আর ইহা যে অনেক রোগে উপকার দেয় তাহাও সেদিন মাত্র জানা গিয়াছে।’

সম্রাট হকীমের সহিত আসাদ বেগের যুক্তিতর্ক শুনিয়া চমৎকৃত ও তুষ্ট হইয়া খান-ই-আজমকে বলিলেন, ‘আসাদের জ্ঞানগর্ভ কথাগুলি শুনিলেন? ঠিক কথা, আমরা অপর দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের গৃহীত দ্রব্য আমাদের পুঁথিপত্রে লিখিত নাই বলিয়া নিশ্চয়ই অগ্রাহ্য করিব না, অন্যথা আমরা উন্নতির পথে অগ্রসর কিরূপে হইব?’

হকীম সাহেব আরও কিছু বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু বাদশাহ তাঁহাকে নিরস্ত করিয়া মুল্লাহকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। মুল্লাহ তামাকের অনেক গুণ বর্ণনা করিলেন বটে, কিন্তু হকীমের মতকে কেহই ফিরাইতে পারিলেন না। তিনি যে একজন সুচিকিৎসক ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই।

আসাদ বেগ প্রচুর পরিমাণ তামাক ও ধূমপানের পাইপ সঙ্গে আনিয়াছিলেন। তিনি কতকগুলি কয়েকজন আমীর উমরাহের মধ্যে বিতরণ করিলেন। অন্যান্য সকলেই পরে তাহা চাহিয়া লইলেন। এইরূপে ক্রমে তামাক খাইবার প্রথা চলিয়া গেল। অতঃপর ইহার চাহিদা দেখিয়া সওদাগরগণ তামাকের ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন এবং অল্পদিনেই দেশময় বিস্তার লাভ করিল। সম্রাট কিন্তু ধূমপানের অভ্যাস করেন নাই।১ ধূমপান যে লোকের স্বাস্থ্য হানি করিতে লাগিল তাহার প্রমাণ তৎকালীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁহার আত্মচরিতে লিখিয়াছেন-তামাকের ধূমপান যখন বহু লোকের শারীরিক ও মানসিক অনিষ্ট সাধন করিতে লাগিল, তখন আমি আমার রাজ্যে তাহার ব্যবহার বন্ধ করিতে আদেশ দিলাম। আমার ভ্রাতা পারস্যরাজ শাহ আব্বাসও তামাকের অপকারিতা জানিতে পারিয়া ইরানেও তাহার ব্যবহার নিষেধ করিয়া আইন জারী করিলেন।২

মার্কিনের ‘এনটি-সিগারেট লীগ’ অথবা ম্যাঞ্চেস্টারের ‘এন্টি-টোব্যাকো’ সভার ন্যায় বর্তমান জগতের বহু সভাসমিতির দ্বারাই যে তামাকের ধূমপান নিবারণ চেষ্টা চলিতেছে তাহা নহে। পূর্ব্বে য়ুরোপের রাজারাও প্রথম প্রথম বহু চেষ্টা করিয়াছিলেন। রোমের প্রধান প্রধান ধৰ্ম্মযাজক তামাক খাওয়া ধৰ্ম্ম-বিরুদ্ধ ও নীতি-বিগর্হিত বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন। এশিয়ার নানা দেশেও ইহার ব্যবহার রহিত করিবার চেষ্টা হইয়াছিল। ১৫৮৪ অব্দে ইংলন্ডে ধূমপান-নিবারক আইন জারী হইয়াছিল। ইহার এক শতাব্দী পরে রাজা দ্বিতীয় চার্লস আইন করিয়া তামাকের চাষ বন্ধ করিয়া দেন। ভারতের হিন্দুসমাজও তামাক ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। স্কন্দ পুরাণের একটি প্রক্ষিপ্ত শ্লোক তাহার নিদর্শন।৩

তথ্যসূত্র

(১) (২) Halat-i-Asad Beg; The Voyages and Travels of M. Caeser Fredrick, Merchant of Venice, into the East India and beyond the Indies, translated out of Italian by M. Thomas Hierooke, “and quoted by J.N.Das Gupta. Bar-at-law, Professor of Presidency Col- lege, Cal., in his Bengal in the Sixteenth Century A, D.”

৩. স্কন্দপুরাণ, মথুরা খণ্ড, ৫২ অধ্যায়।

[প্রবন্ধটি ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে (১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ) প্রবাসী পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত]

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস: সাহিত্যিক ও অভিধান প্রণেতা