সিল্করুট

আদি ইতিহাস

এস এম পিয়াল

তামাক পাতা ছবি: এনসাইক্লোপেডিয়া ভার্জিনিয়া

তামাকের আদি নিবাস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়। গাছের শুকানো পাতাই মূলত পরিচিত তামাক নামে। গাছগুলো হয় ১২ ইঞ্চি থেকে ১৮ ইঞ্চি লম্বা। তামাক অত্যন্ত নেশাদায়ক পদার্থ। তামাকে আগুন দিয়ে সিগারেট, বিড়ি চুরুট, হুঁকো ও অন্যান্য ধূমপানের মাধ্যম প্রস্তুত করা হয়। ধূমপান ছাড়াও তামাক ব্যবহৃত হয় গুল হিসেবে। তামাকের মূল নেশাদায়ক উপাদান নিকোটিন এক প্রকারের স্নায়ুবিষ (নিউরোটক্সিন) যা এক ধরনের অ্যাসিটাইল কোলিন রিসেপ্টরের (কোলিনার্গিক অ্যাসিটাইল কোলিন রিসেপ্টর) ওপর কাজ করে। কিন্তু তামাকের ধোঁয়ায় নিকোটিন ছাড়াও নানা ক্যান্সারপ্রদায়ী পদার্থ থাকে। একটা সিগারেটে যতখানি তামাক আছে তা চিবিয়ে খেলে পুরোপুরি শরীরে যদি প্রবেশ করত তা থেকে মৃত্যু অনিবার্য। তবে ধূমপানের ফলেও ধীরে ধীরে আয়ু কমে আসতে থাকে। শুধু ক্যান্সারের প্রবণতার জন্যেই নয়, হৃদরোগের জন্যেও সমান দায়ী।

আমেরিকা মহাদেশের দেশ মেক্সিকোয় ৬০০-৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তামাক চাষের প্রমাণ পাওয়া যায়। ন্যাটিভ আমেরিকানদের মাঝে তামাক চাষ প্রচলিত ছিল। ধূমপান ছাড়াও বিনিময়ে মাধ্যম হিসেবে তারা তামাক পাতা ব্যবহার করত। কিছু কিছু সমাজে তামাক পাতাকে স্রষ্টার উপহার বিবেচনা করে তামাক সেবন স্রষ্টার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতো। আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহারের পাশাপাশি শারীরিক অবস্থার চিকিৎসার জন্যও তামাক ব্যবহার করা হয়। ব্যথানাশক হিসাবে এটি কান ব্যথা এবং দাঁতের ব্যথা, মাঝে মাঝে পোল্টিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু আদিবাসী মানুষ সর্দি-কাশির চিকিৎসার জন্য ধূমপানের মিশ্রণে একটি উপাদান হিসেবে তামাকের ব্যবহার করেছে।

তামাকের ইংরেজি (tobacco) এসেছে স্প্যানিশ (tobaco) শব্দ থেকে। ধারণা করা হয় এ শব্দটির উৎপত্তি আরাওয়াকান ভাষা থেকে। ক্যারিবীয় অঞ্চলের তাইনো ভাষায় এটি তামাক পাতার রোল অথবা ধূমপানের বিশেষ নলকে বোঝায়। আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপীয়দের পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে তামাক পাতা ব্যবহার শুরু হয়। স্পেনের রাজা ফিলিপের আদেশে ১৫৫৯ সালে তামাকের বীজ ইউরোপে নিয়ে আসা হয়। কিউবা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য জায়গায় ১৮ শতকের দিকে তামাক বিক্রয়ের জন্য চাষাবাদ করা হতো। ১৪৪২ সাল থেকে পর্তুগিজ নাবিকদের দ্বারা জাপানিরা তামাকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। তামাক প্রথম ১৬ শতকের শেষের দিকে স্প্যানিশদের দ্বারা অটোমান সাম্রাজ্যে আসে। সেখানে এটি চিকিৎসকদের আকর্ষণ করেছিল এবং অনেক অসুস্থতার জন্য একটি সাধারণভাবে নির্ধারিত ওষুধ হয়ে ওঠে। যদিও তামাক প্রাথমিকভাবে ওষুধ হিসেবে নির্ধারিত ছিল, পরবর্তী গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে ধূমপানের ফলে মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, ইন্দ্রিয় নিস্তেজ হয়ে যায় এবং মুখে একটি খারাপ স্বাদ/ গন্ধ হয়।

১৯১০ সালের পর সিগারেট ধূমপান প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ১৯১০ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক মনোভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন দেখা যায়। ব্যাপকভাবে মহিলারা ধূমপান শুরু করে। বিভিন্ন দেশে এর প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে। তবে ১৯৪৮ সালে একটি সত্যিকার অগ্রগতি আসে, যখন ব্রিটিশ শারীরবৃত্তীয় রিচার্ড ডল প্রথম বড় গবেষণা প্রকাশ করেন, যা প্রমাণ করে যে ধূমপান গুরুতর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। ১৯৫০ সালে তিনি ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করেন যেটি ধূমপান এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখায়। চার বছর পর ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ ডক্টরস স্টাডি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রায় ৪০ বছর পর ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ ডক্টরস স্টাডি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রায় ৪০ হাজার ডাক্তারের ওপর করা একটি সমীক্ষা, পরামর্শ নিশ্চিত করে, যার ভিত্তিতে সরকার পরামর্শ দেয় যে, ধূমপান এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের হার সম্পর্কিত।

তামাক ধূমপান মানবদেহের হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালির (কার্ডিও ভাসকুলার সিস্টেম) ক্ষতি করে। হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান করোনারি হার্ট ডিজিজের একটি প্রধান কারন। যেখানে হৃৎপিণ্ডের ধমনি হৃৎপিণ্ডের পেশিকে যথেষ্ট অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ করতে পারে না।

তামাকজাত দ্রব্যের বাজারে আয়ের বিষয়ে ২৩টি নির্বাচিত অঞ্চলের তুলনা করে চীন র‌্যাংকিয়ে শীর্ষে রয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের দেশে তামাকের ব্যবহার ঠিক কখন শুরু হয় তার কোনো সন তারিখ কারো জানা নেই। তবে যোড়শ শতকে পর্তুগিজ নাবিকদের মাধ্যমে যে এ দেশে তামাকের আমদানি, চাষ ও প্রচলন হয় তা এক প্রকার নিশ্চিত। তামাক একটি নেশাদ্রব্য। তামাক সেবনকারী তামাকের মধ্যকার আসক্ত উপাদানের দ্বারা এর প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বে যত নেশাদ্রব্য বিদ্যমান এর মধ্যে এ নেশাদ্রব্য বৈধভাবে বেচাকেনা হয়। বিশ্বের সর্বত্র তামাক একটি বিশাল শিল্প হিসেবে পরিণত। তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, হুক্কা, সিগার, পাইপ, সাদাপাতা, গুল, খৈনি, নস্যি ইত্যাদি অন্যতম।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ২০০৭-এর তথ্য অনুযায়ী বছরে ৫ হাজার ২২৪ টন তামাক দেশে আমদানি করা হয় এবং ৯ হাজার ৬৩১ টন তামাক রফতানি করা হয়। তামাক খাতে বার্ষিক আমদানি ব্যয় ১৫০ কোটি এবং রফতানি আয় ৯৮ কোটি টাকা। দেশে বছরে প্রায় ২৫০০ কোটি শলাকা সিগারেট উৎপাদিত হয়। বছরে যে পরিমাণ বিড়ি সিগারেট বাংলাদেশের মানুষ সেবন করে তার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। যা দিয়ে প্রতি বছর দুটি যমুনা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

এস এম পিয়াল: বণিক বার্তা প্রতিনিধি, রংপুর