বঙ্গবন্ধু
সরকারের শাসনামলের
মাত্র সাড়ে
তিন বছরে
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের
পুনর্গঠন, স্বল্পতম
সময়ের মধ্যে
দেশের জন্য
সংবিধান প্রণয়ন,
সাধারণ নির্বাচন
অনুষ্ঠান, ভারত
প্রত্যাগত প্রায়
এক কোটি
শরণার্থীর পুনর্বাসন,
মুক্তিযোদ্ধা ও
নির্যাতিতা নারীদের
পুনর্বাসন, পাকিস্তান
থেকে পাঁচ
লক্ষাধিক বাঙালিকে
ফিরিয়ে আনা,
১২১টি দেশের
স্বীকৃতি অর্জন,
জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ,
ওআইসিসহ বিভিন্ন
উন্নয়ন সংস্থার
সদস্যপদ লাভ,
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে
অংশগ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্যের
মুসলিম দেশগুলোর
সঙ্গে সম্পর্ক
স্থাপন, ভারতের
সঙ্গে বেশকিছু
স্পর্শকাতর বিষয়
নিষ্পত্তির লক্ষ্যে
চুক্তি স্বাক্ষর,
দেশের অভ্যন্তরে
অব্যাহত সন্ত্রাস,
চুরি-ডাকাতি,
দুর্নীতি, কালোবাজারি,
মুনাফাখোরি, চোরাচালানি
এবং নাশকতামূলক
কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা
গ্রহণ, বন্যা-দুর্ভিক্ষ
ইত্যাদি মোকাবেলা
করে দেশকে
যখন শান্তি-শৃঙ্খলা
ফিরিয়ে এনে
অগ্রগতির পথে
নিয়ে যাওয়া
হচ্ছিল, ঠিক
সে মুহূর্তে
বাংলাদেশে নেমে
এসেছে এক
অকল্পনীয় ও
অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ। মাত্র সাড়ে
তিন বছর
সময়ে বঙ্গবন্ধুর
সরকার দেশের
জন্য যা
যা করেছে,
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী,
শূন্য থেকে
যাত্রা শুরু
করা সরকারের
কাছে আর
কী প্রত্যাশা
থাকতে পারে?
তার পরও
একদল ষড়যন্ত্রকারী,
ক্ষমতালোভী, বিপথগামী
ব্যক্তি পঁচাত্তরের
হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ
তৈরির সুযোগের
অপেক্ষায় থাকে। জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবসহ তার
পরিবার, মন্ত্রিসভা,
আওয়ামী লীগ
নেতারাসহ দেশের
আপামর জনতা
যা কোনো
দিন কল্পনাও
করেননি, ইতিহাসের
নির্মম ও
জঘন্য সে
হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত
হলো ১৫
আগস্ট প্রথম
প্রহরে। অন্যান্য
কর্মব্যস্ত দিনের
মতো ১৪
আগস্ট, ১৯৭৫
বঙ্গবন্ধু রাত
৮-৯টায়
গণভবন থেকে
ধানমণ্ডির ৩২
নম্বর সড়কের
নিজ বাসায়
ফেরেন। তারপর
যথারীতি আহার
ও অন্য
কার্যাদি শেষ
করে রাত
সাড়ে ১২টার
দিকে ঘুমাতে
গেলেন। ১৫
আগস্ট সকাল
১০টায় বঙ্গবন্ধু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরিদর্শনে যাবেন।
সব প্রস্তুতি
সম্পন্ন হয়েছে। পূর্বপরিকল্পনামতো ঘাতক
দলের অপারেশন
কমান্ডার আর্মার্ড
কোরের লেফটেন্যান্ট
কর্নেল ফারুক
রহমান, লেফটেন্যান্ট
কর্নেল আব্দুর
রশিদ, মেজর
শরিফুল হক
ডালিম, মেজর
নূর চৌধুরী,
মেজর বজলুল
হুদা, মেজর
মহিউদ্দিন, মেজর
আজিজ পাশা
প্রমুখ তাদের
অধীন সৈন্য,
ট্যাংক, কামান,
মেশিনগান, স্টেনগান
নিয়ে ১৪
আগস্ট রাত
থেকেই অভিযানের
প্রস্তুতি নেন।
তারা চারটি
দলে বিভক্ত
হয়ে ১৫
আগস্ট ভোর
৪টা-৫টার
মধ্যে তিনটি
দল ধানমণ্ডি
ও সংলগ্ন
এলাকায় প্রেসিডেন্ট
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের
৩২ নম্বর
রোডের বাড়ি,
বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা
শেখ ফজলুল
হক মনির
বাড়ি। ভগ্নিপতি
মন্ত্রী আবদুর
রব সেরনিয়াবাতের
মিন্টু রোডের
বাড়ি ঘেরাও
করে আক্রমণ
করেন। শেষোক্ত
দুজনের বাড়িতে
ভোর ৫টার
আগেই আক্রমণ
করে শেখ
ফজলুল হক
মনি ও
তার স্ত্রী
আরজু মনি,
আব্দুর রব
সেরনিয়াবাত, তার
কন্যা বেবী
ও পুত্র
আরিফ, নাতি
সুকান্তসহ সেরানিবাতের
বাড়িতে সে
রাতে অবস্থানরত
আরো কয়েকজন
আত্মীয়, আশ্রিতজন
এবং গৃহপরিচারিকাকে
হত্যা করে।
এ অভিযানের
দায়িত্বে ছিলেন
মেজর ডালিম
ও রিসালদার
মোসলেহ উদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর ৩২
নম্বর সড়কের
বাড়ি আক্রমণের
নেতৃত্বে ছিলেন
লেফটেন্যান্ট কর্নেল
ফারুক রহমানের
বিশ্বস্ত মেজর
মহিউদ্দিন। সঙ্গে
ছিল মেজর
নূর, মেজর
হুদা ও
আরো অনেকে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
আক্রান্ত হলে
নিরাপত্তার দায়িত্বে
নিয়োজিত পুলিশ
বাহিনীর সঙ্গে
আক্রমণকারী সেনাদের
তুমুল গোলাগুলি
হয়। তখন
ভোর সাড়ে
৫টা। বঙ্গবন্ধুর
বাড়ি আক্রান্ত
হওয়ার পর
তিনি বিভিন্ন
দিকে বেশ
কয়েকটি ফোন
করেন। তিনি
তার মিলিটারি
সেক্রেটারি কর্নেল
জামিলকে ফোন
করে তাড়াতাড়ি
আসতে বললেন।
সেনাবাহিনী প্রধান
মেজর জেনারেল
সফিউল্লাহকেও খবর
দিতে বলেন
যেন সেনাপ্রধান
ফোর্স পাঠান।
কর্নেল জামিল
তার ব্যক্তিগত
গাড়ি নিয়ে
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির
দিকে আসার
পথে সোবহানবাগ
মসজিদের কাছে
বিদ্রোহী সৈনিকদের
গুলিতে নিহত
হন। বঙ্গবন্ধুর
সঙ্গে সেনাপ্রধানের
কথা হয়।
জেনারেল সফিউল্লাহ
বলেছিলেন, “Sir,
can you get out. I’m doing something.” কিন্তু
কোনো ব্যবস্থা
নেয়ার আগেই
সেনা সদস্যরা
বাড়িতে ঢুকে
পড়েন। সফিউল্লাহ
ফোনে গোলাগুলির
শব্দ শুনতে
পান। বঙ্গবন্ধুর
জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ
কামাল বাড়ির
গেটের সামনে
গোলমাল ও
উত্তেজনা দেখে
নিচে নেমে
আসেন। তার
পরিচয় পেয়ে
ঘাতক সৈন্যরা
শেখ কামালকে
ব্রাশফায়ারে হত্যা
করেন। বঙ্গবন্ধু
দোতলা থেকে
সিঁড়ি দিয়ে
নিচে নামার
পথে মেজর
নূরসহ কয়েকজনের
মুখোমুখি হন।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
তিনি জিজ্ঞেস
করেছিলেন, ‘তোরা
কী চাস?’
অমনি অতর্কিত
ব্রাশফায়ারে তার
বুক ঝাঁঝরা
হয়ে যায়।
তিনি সিঁড়িতে
পড়ে গেলেন।
তারপর একে
একে হত্যা
করা হয়
শেখ জামাল
ও তার
স্ত্রী রোজিকে,
শেখ কামালের
স্ত্রী সুলতানা
কামাল খুকি,
বেগম মুজিব,
বঙ্গবন্ধুর ছোট
ভাই শেখ
নাসের এবং
সর্বশেষে কনিষ্ঠপুত্র
১০ বছর
বয়সী শেখ
রাসেলকে। আক্রমণকালে
ওই বাড়িতে
বেশ ক’জন
পুলিশ ও
নিরাপত্তারক্ষী নিহত
হন। বঙ্গবন্ধুর
দুই কন্যা
শেখ হাসিনা
ও শেখ
রেহানা তখন
শেখ হাসিনার
স্বামী ওয়াজেদ
মিয়ার সঙ্গে
জার্মানিতে অবস্থান
করছিলেন। সে
জন্য তারা
বেঁচে গিয়েছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল
ফারুক ট্যাংক
নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে
প্রতিরোধের দায়িত্বে
ছিলেন। অন্য
অফিসারগণ টার্গেট
করা বাড়িগুলোর
চারদিকে সম্ভাব্য
বাধাদানে আগত
কোনো পুলিশ
বা সৈন্যদের
প্রতিরোধে নিয়োজিত
ছিলেন। লেফটেন্যান্ট
কর্নেল রশিদের
দায়িত্ব ছিল
অপারেশন-পরবর্তী
অবস্থা সামাল
দেয়া ও
সার্বিক রাজনৈতিক
সমন্বয় সাধন। জেনারেল সফিউল্লাহ
যখন বঙ্গবন্ধুর
ফোনের জবাব
দিচ্ছিলেন, তখন
ভোর আনুমান
৫টা ৫০
মিনিট। সেনাপ্রধান
বিভিন্ন দিকে
ফোন করতে
থাকেন। ৪৬
ব্রিগেড কমান্ডার
শাফায়াত জামিলকে
ফোন করে
প্রথম বেঙ্গল
ও চতুর্থ
বেঙ্গল রেজিমেন্ট
মুভ করতে
বলেন। তার
নির্দেশ সত্ত্বেও
শাফায়াত জামিল
কোনো ব্যবস্থা
নেননি। সেনাপ্রধান
সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার
জিয়াউর রহমান,
ব্রিগেডিয়ার খালেদ
মোশাররফ প্রমুখকেও
ফোন করেছিলেন
কিন্তু কোনো
ট্রুপস মুভ
করাতে পারেননি।
তিনি নৌ
ও বিমান
বাহিনীপ্রধানের সঙ্গেও
কথা বলেন।
অপারেশন শেষ
করে মেজর
ডালিম ঢাকা
বেতার কেন্দ্র
দখল করেন
এবং নিজেই
বেতারে প্রচার
করলেন ‘স্বৈরাচারী
শেখ মুজিবকে
হত্যা করা
হয়েছে।’ সকাল
৭টায় ঢাকা
বেতারে ফারুক
হোসেইনের নিয়মিত
সংবাদ পাঠে
জানা গেল
খন্দকার মোশতাক
আহমেদের নেতৃত্বে
সামরিক অভ্যুত্থানে
রাষ্ট্রপতি শেখ
মুজিবুর রহমানকে
হত্যা করা
হয়েছে। গোটা জাতি
এ হত্যাকাণ্ডের
খবর শুনে
স্তম্ভিত হয়ে
গেল। যে
মানুষটি তার
সারা জীবন
বাংলার মানুষের
অধিকার আদায়,
তাদের মুক্তির
জন্য সংগ্রাম
করেছেন, জেল-জুলুম
সহ্য করেছেন,
পাকিস্তানের কারাগারে
নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত
জীবন কাটিয়েছেন,
জাতিকে স্বাধীন
দেশ উপহার
দিয়েছেন তাকে
কিনা হত্যা
করেছে একদল
বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারী
সৈনিক। আর্মার্ড
কোরের মাত্র
দুটি ইউনিট
এ অভিযানে
যোগ দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা
করার পরও
চাইলেই বাংলাদেশের
তত্কালীন প্রতিরক্ষা
বাহিনী বিদ্রোহীদের
কাবু করতে
পারত। কিন্তু
এক অজ্ঞাত
কারণে তারা
তা করেনি।
১৫ আগস্ট
সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট
খন্দকার মোশতাক
আহমেদের নেতৃত্বে
মন্ত্রিসভা শপথ
গ্রহণ করে।
দেশ এক
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের
দিকে যাত্রা
করে। বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানকে
যারা ভালোবাসেন
কিংবা তাকে
নিয়ে গবেষণা
করেন বা
আলোচনা করেন,
তারা অনেক
সময় বিস্ময়
বোধ করেন—বঙ্গবন্ধু
ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি
শুরু করে
বাংলার মানুষকে
ভালোবেসে, তাদের
অধিকার আদায়
করতে গিয়ে
১৩ বছরের
অধিক সময়
পরিবার থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে
কারা প্রকোষ্ঠে
কাটিয়েছেন, বলতে
গেলে তার
জীবনের স্বর্ণযুগ
অতিবাহিত হয়েছে
নির্জন বন্দিশালায়,
তিনি জীবনে
আর্থিক সচ্ছলতার
মুখ দেখেননি,
দীর্ঘ সময়
অনিশ্চিত জীবন
কাটিয়েছেন, ক্ষমতার
লোভ কিংবা
সম্পদের উচ্চাভিলাষ
তাকে লক্ষ্যচ্যুত
করতে পারেনি,
সে মানুষটিকে
বাঙালিরা কীভাবে
হত্যা করল?
তাহলে ষড়যন্ত্র,
জালিয়াতি, ছলচাতুরী
এসব কি
বাঙালি চরিত্রের
বৈশিষ্ট্য? বঙ্গবন্ধুর
মৃত্যু পর্যন্ত
তার সঙ্গে
সংস্থাপন বিভাগের
সচিব হিসেবে
কাজ করেছেন
মাহবুবুর রহমান।
১৯৮৭ সালে
প্রকাশিত তার
রচিত ‘কিছু
স্মৃতি কিছু
ধৃতি’ গ্রন্থে
লিখেছেন, ‘এ
কেমন দেশ
বা এ
কেমন জাতি?
যার মুখের
কথা শোনার
জন্য লক্ষ
লক্ষ লোক
জমা হতো,
আর যাকে
লক্ষ লক্ষ
লোক মিছিল
করে অভ্যর্থনা
করত, যার
জয়ধ্বনিতে গগন
বিদারিত হতো,
তাকে সপরিবারে
হত্যা করা
হলো, মনে
কোনো দুঃখ
হলো না।
যার জন্ম
না হলে
বাঙালি জাতীয়তাবাদের
বিকাশ হতো
না, আর
বাংলাদেশের সৃষ্টি
হতো না,
তার হত্যার
সাথে সাথে
সবাই তার
কথা হেলায়
মন থেকে
মুছে ফেলল।
এ ঘটনার
নজির খুঁজে
বের করা
কঠিন। এ
ব্যাপারে আজও
অনেকের আত্মজিজ্ঞাসা
রয়ে গেছে।’
বঙ্গবন্ধু নিজ
বাড়িতে সাধারণ
নিরাপত্তা বেষ্টনীর
মধ্যে থাকতেন।
দেশের রাষ্ট্রপতি
হিসেবে প্রাপ্য
কঠোর নিরাপত্তা
ব্যবস্থা তিনি
নেননি। কারণ
তিনি বিশ্বাস
করতেন এবং
বলতেন, ‘বাঙালি
আমাকে মারবে
না।’ তার
এ বিশ্বাসের
ভিত্তি ছিল
তার দেশপ্রেম
ও মানবপ্রেম।
বাংলাদেশকে ও
বাঙালিদের তিনি
প্রাণের চেয়েও
বেশি ভালোবাসতেন।
এর প্রকাশ
দেখা যায়
পঞ্চাশের ষড়যন্ত্রের
সময় মুসলিম
যুব কর্মীদের
নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে
দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ,
দুর্গতদের মধ্যে
খাদ্য বিতরণ
ও সেবাদান
করার মধ্যে।
১৯৪৬ সালের
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়
জীবনের মায়া
তুচ্ছ করে
আহতদের সেবা
করেছেন। ১৯৫৪
সালে আদমজী
জুট মিলের
দাঙ্গা-হামলার
সময়, ১৯৬৪
সালের সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গায় তিনি
দলীয় কর্মীদের
নিয়ে বাংলার
মানুষকে রক্ষা
করতে এগিয়ে
গেছেন। ১৯৬৬
সালে ছয়
দফা দিয়ে
তিনি বাংলার
মানুষকে জাগিয়ে
তুলেছেন, স্বাধিকার
আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ
করেছেন। বঙ্গবন্ধুর এ
আত্মবিশ্বাস ছিল
যে তিনি
যেমন এ
দেশের মানুষকে
ভালোবাসেন, বাংলার
মানুষও তাকে
ভালোবাসে। তার
ডাকে এ
দেশের মানুষ
মুক্তিযুদ্ধ করেছে,
দেশকে মুক্ত
ও স্বাধীন
করেছে। তার
একটি স্বপ্ন—বাংলার
মানুষ খেয়ে-পরে,
সুখে-শান্তিতে
বাস করুক।
আত্মমর্যাদা নিয়ে
বিশ্বের দরবারে
মাথা উঁচু
করে নিজের
স্থান করে
নিক। তিনি
বলতেন, ‘ভিক্ষুক
জাতির পৃথিবীতে
কোনো সম্মান
নেই।’ বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত
আত্মজীবনী’ গ্রন্থের
শুরুতে উল্লেখিত
তার নোটবুকে
৩০-০৫-৭৩
ইংরেজিতে লেখা
একটি উক্তির
বাংলা অনুবাদ
নিম্নরূপ: ‘একজন
মানুষ হিসেবে
সমগ্র মানবজাতি
নিয়েই আমি
ভাবি। একজন
বাঙালি হিসেবে
যা কিছু
বাঙালিদের সঙ্গে
সম্পর্কিত, তাই
আমাকে গভীরভাবে
ভাবায়। এ
নিরন্তন সম্পৃতির
উৎস ভালোবাসা,
অক্ষয় ভালোবাসা,
যে ভালোবাসা
আমার রাজনীতি
এবং অস্তিত্বকে
অর্থবহ করে
তোলে।’ বাংলার
মানুষের প্রতি
হূদয়ের এ
উষ্ণতা ও
ভালোবাসার কারণে
সব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের
মুখে এ
বিশ্বাস প্রবলভাবে
আঁকড়ে ধরেছিলেন,
কোনো বাঙালি
তাকে হত্যা
করতে পারে
না। তার
নিরাপত্তার ব্যাপারে
সন্দিহান ও
চিন্তিত হয়ে
অনেকে তাকে
সতর্ক করেছিলেন।
ভারতের গোয়েন্দা
সংস্থা ‘র’
তাদের সোর্স
মারফত জানতে
পারে, বাংলাদেশে
একটি সামরিক
অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা
হচ্ছে। ভারতের
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা
গান্ধীর অনুমতি
নিয়ে ‘র’-এর
অন্যতম নীতিনির্ধারক
আর এন
কাড ১৯৭৪
সালের ডিসেম্বরে
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
দেখা করে
এ ষড়যন্ত্র
সম্পর্কে অবহিত
করলে বঙ্গবন্ধু
তা হেসে
উড়িয়ে দিয়ে
বলেছিলেন, ‘সবাই
আমার সন্তান,
আমাকে কেউ
মারবে না।’ বাংলার মানুষের
প্রতি এ
অবিচল ও
সীমাহীন বিশ্বাসই
তার উত্তম
চরিত্রের ও
মহৎ গুণাবলির
বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যের
কী নির্মম
পরিহাস একদল
বিপথগামী বাঙালিই
তাকে হত্যা
করেছে। তবে
হত্যাকারীরা বাঙালি
হলেও তারা
ছিল বহিঃশত্রুর
মদদপুষ্ট ও
বেতনভুক্ত জল্লাদ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
পর্যালোচনা করলে
দেখা যায়,
মোশতাক-ফারুক-রশীদ
এরা চেয়েছিলেন
যেকোনোভাবে পাকিস্তানের
সঙ্গে কনফেডারেশন।
ফারুক-রশীদ
পাকিস্তান থেকে
এসে মুক্তিযুদ্ধেও
যোগদান করেছে
বিলম্বে। তারা
কোনো সেক্টরে
যুদ্ধ করেনি।
কলকাতায় অবস্থান
করেছেন। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে
কিউবার নেতা
ফিদেল ক্যাস্ট্রো
বঙ্গবন্ধুকে সিআইএর
ষড়যন্ত্র সম্পর্কে
সতর্ক করেছিলেন।
পৃথিবীর কোটি
কোটি দরিদ্র
শোষিত নির্যাতিত
মানুষের অকৃত্রিম
বন্ধু চিলির
প্রেসিডেন্ট আলেন্দের
হত্যাকাণ্ডের (১৯৭৩)
পর অবশ্য
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
‘একে
একে আমাদের
সবাইকে এভাবে
শেষ করা
হবে। এবার
টার্গেট করা
হবে আমাকে।’ কী আশ্চর্য
ভবিষ্যদ্বাণী! হয়তো
মনের অগোচরে
তিনি এ
কথাটি বলে
ফেলেছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা
ছিল দীর্ঘদিনের
প্রস্তুতির ফসল।
বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয়
বিপ্লবও একদলীয়
শাসন প্রবর্তনের
সময় খন্দকার
মোশতাক এর
বিরোধিতা করেন
এবং বঙ্গবন্ধুর
বাসায় এসে
তার সঙ্গে
উত্তেজিতভাবে তর্ক
করেন, কিন্তু
জেনারেল এমএজি
ওসমানী বা
ব্যারিস্টার মইনুলের
মতো পদত্যাগ
করেননি। তিনি
পার্লামেন্টেও ছিলেন,
মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি
থেকে ঘাতকদের
হত্যাকাণ্ডের সুযোগ
করে দিয়েছেন।
প্রচলিত আছে,
খন্দকার মোশতাক
১৪ আগস্ট
বাসা থেকে
খাবার রান্না
করে এনে
বঙ্গবন্ধুকে তার
৩২ নম্বর
রোডের বাড়িতে
খাইয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর
পিতা শেখ
লুত্ফর রহমানের
মৃত্যুর পর
তার লাশ
নিয়ে কবরে
নেমেছিলেন, এছাড়া
শেখ কামালের
বিবাহের উকিলও
ছিলেন খন্দকার
মোশতাক। বিশ্বাসঘাতক
আর কাকে
বলে! ১৯৭৫ সালের
১৫ আগস্টের
পর দীর্ঘ
২১ বছর
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে
নির্বাসন দেয়ার
প্রয়াস চলে।
কিন্তু ঘন
কালো মেঘের
আড়ালে লুক্কায়িত
সূর্যের উদয়কে
যেমন ঠেকানো
যায় না,
তেমনি বঙ্গবন্ধুর
অবিস্মরণীয় পর্বতপ্রমাণ
অবদান অস্বীকার
করা যায়
না। ১৯৯৬
সালে বঙ্গবন্ধু
কন্যা শেখ
হাসিনা বাংলাদেশের
রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হলে এবং
২০০৯ থেকে
একনাগাড়ে আরো
তিন মেয়াদে
আওয়ামী লীগ
ও শেখ
হাসিনার শাসনামলে
বঙ্গবন্ধুকে যেমন
পুনর্মূল্যায়িত করা
হয়েছে, তেমনি
তার আদর্শ
ও পথ
অনুসরণ করে
বঙ্গবন্ধুর সোনার
বাংলা গড়ার
স্বপ্ন বাস্তবায়নে
শেখ হাসিনা
বাংলাদেশের সরকারের
নেতৃত্ব দিয়ে
যাচ্ছেন। যুদ্ধোত্তর
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
পুনরুদ্ধারে বঙ্গবন্ধুর
সাড়ে তিন
বছরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ,
বৈরী সময়ের
ঘটনাবহুল শাসনামলের
আজ নতুনভাবে
পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে।
কীভাবে একটি
দেশ ও
জাতিকে শূন্যাবস্থা
থেকে অগ্রগতির
পথে নিয়ে
যাচ্ছিলেন, উপর্যুপরি
বন্যা, খরা,
দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস,
উগ্রবাদী তত্পরতা,
দুর্নীতি ইত্যাদি
কাটিয়ে উঠে
অর্থনীতিকে একটি
মজবুত ভিত্তির
ওপর দাঁড়
করাতে চেয়েছিলেন,
তা অনুকরণীয়
দৃষ্টান্ত হয়ে
আছে। পঁচাত্তরে ব্রিটিশ
সাংবাদিক ডেবিড
ফ্রস্ট কোনো
এক সাক্ষাত্কারে
বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস
করেছিলেন, ‘আপনার
সবচেয়ে বড়
শক্তি কি?’
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
‘আই
লাভ মাই
পিপল।’ পরের
প্রশ্ন—‘আপনার
দুর্বলতা কি?’
বঙ্গবন্ধু জবাবে
বলেছিলেন, ‘আই
লাভ মাই
পিপল টু
মাচ। আমি
মরি, তাও
ভালো। তবু
আমার দেশবাসীর
যেন মর্যাদার
হানি না
ঘটে।’ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির
উৎসই ছিল
জনগণ। এ
রাজনীতির গোড়াপত্তন
হয়েছে গ্রামবাংলার
হাটে-ঘাটে,
প্রতারিত-শোষিত
বাঙালির পর্ণকুটিরে।
মানুষের জন্য
অকৃত্রিম ভালোবাসা,
আন্দোলন-সংগ্রাম
নিঃস্বার্থ ত্যাগের
ওপর রচিত
এবং ত্যাগেই
ভালোবাসা পরিপূর্ণতা
লাভ করেছে।
আজীবন সংগ্রামী
এ মানুষটি
তার আরাধ্য
কাজ সমাপ্ত
করার আগেই
ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের
নির্মম হত্যার
শিকার হন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার
পরদিন লন্ডনের
টাইমস পত্রিকায়
লেখা হয়
‘সবকিছু
সত্ত্বেও শেখ
মুজিব স্মরণীয়
এজন্য, তাকে
ছাড়া বাংলাদেশ
কখনো বাস্তবে
পরিণত হতো
না।’ (১৬-৮-১৯৭৫) কিউবার সংগ্রামী
প্রেসিডেন্ট ফিদেল
ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন—‘আমি
হিমালয় দেখিনি
কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে
দেখেছি। তার
ব্যক্তিত্ব ছিল
হিমালয়ের মতোই
বিশাল।’ তিনি আরো
বলেছিলেন, ‘শেখ
মুজিবের মৃত্যুতে
বিশ্বের শোষিত
মানুষ হারালো
তাদের একজন
মহান নেতাকে,
আমি হারালাম
একজন অকৃত্রিম
বিশাল হূদয়ের
বন্ধুকে।’ ১৫ আগস্ট,
১৯৭৫ বিবিসি
প্রচার করে—শেখ
মুজিব নিহত
হলেন তার
নিজেরই সেনাবাহিনীর
হাতে অথচ
তাকে হত্যা
করতে পাকিস্তানিরা
সংকোচ বোধ
করেছে। ফিলিস্তিন নেতা
ইয়াসির আরাফাত
মন্তব্য করেন
আপসহীন-সংগ্রামী
নেতৃত্ব আর
কুসুমকোমল হূদয়
ছিল মুজিব
চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। জার্মান চ্যান্সেলর
উইলি ব্রান্ডট
মন্তব্য করেন—মুজিব
হত্যার পর
বাঙালিদের আর
বিশ্বাস করা
যায় না।
যারা মুজিবকে
হত্যা করেছে
তারা যেকোনো
জঘন্য কাজ
করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার
সংবাদ বেতারে
শোনার পর
তাত্ক্ষণিক সাহিত্যিক-সাংবাদিক
আবু জাফর
শামসুদ্দীন তার
ডায়েরিতে লিখেছিলেন,
‘মৃত
মুজিব জীবিত
মুজিবের চেয়ে
শক্তিশালী রূপে
আবির্ভূত হবেন।’ বঙ্গবন্ধু নিহত
হওয়ার সংবাদ
শুনে মিসরের
প্রেসিডেন্ট আনোয়ার
সাদাত দুঃখ
করে বলেছিলেন,
‘তোমরা
আমারই দেয়া
ট্যাঙ্ক দিয়ে
আমার বন্ধু
মুজিবকে হত্যা
করেছো। আমি
নিজেই নিজেকে
অভিশাপ দিচ্ছি।’ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের
পর জার্মানিতে
অবস্থানরত তার
দুই কন্যা
শেখ হাসিনা
ও শেখ
রেহানা রাজনৈতিক
আশ্রয়ের আশায়
ভারতে আসার
পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট
এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন
অফিসারকে শেখ
হাসিনা তার
পাসপোর্ট দেখালে
বাংলাদেশী পাসপোর্ট
দেখে সে
অফিসার শেখ
হাসিনাকে বললেন—‘ছি:
তোমরা বাংলাদেশীরা
জঘন্য জাতি।
যে মানুষটি
তোমাদেরকে স্বাধীনতা
এনে দিয়েছিলেন
তাকেই তোমরা
হত্যা করে
ফেললে?’
শেখ হাসিনা
চিত্কার করে
কান্নায় ভেঙে
পড়েন। এয়ারপোর্টের
লোক দেখল
দুই বোনের
আহাজারি। বিবিসি বাংলা
বিভাগের শ্রোতাদের
জনমত জরিপে
২০০৪ সালের
১৪ এপ্রিল,
১৪১১ বঙ্গাব্দের
১ বৈশাখ
বাংলাদেশের জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর
রহমান ‘সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’
উপাধিতে ভূষিত
হন। যুগে
যুগে যেসব
বাঙালি মনীষী,
কবি, সাহিত্যিক
বাংলাকে ভালোবেসে
অমরত্ব লাভ
করেছেন তাদের
মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ
অভিধায় অভিষিক্ত
হয়েছেন আমাদের
বঙ্গবন্ধু। মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত