সিল্করুট

ঐতিহাসিক রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধবিহার

সুনীল বড়ুয়া

বিহারের বাইরে লিখিত রাংকুটের ইতিহাস ছবি: ছৈয়দ আলম

বিহারের পাদদেশে বিশালাকৃতির শতবর্ষী বটবৃক্ষ যে কারো নজর কাড়ে। এর পাশ ঘেঁষে দৃষ্টিনন্দন গেটটিও অপূর্ব কারুকাজ যেন চমকের ওপর চমক। থরে থরে সাজানো সিঁড়িগুলো উঠে গেছে পাহাড়চূড়ায়। ওখানেই আছে ছোট-বড় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মন্দির। যার একটিতে হচ্ছে মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধের (বুড়া গোঁয়াই) মূর্তি। মূর্তিটির কারণে মূলত এটি বৌদ্ধদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থস্থান। মূর্তি দর্শনেই ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের মন ভরে ওঠে গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর পবিত্রতায়। কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের ঐতিহাসিক রাংকুট (রামকোট) বনাশ্রম তীর্থস্থান। রামু উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় ৩০টি বৌদ্ধবিহার ও জাদী (প্যাগোডা) থাকলেও এটিই সবচেয়ে প্রাচীন ও ইতিহাসসমৃদ্ধ। বিহারের মূল ফটকেই লেখা আছে ২৬৮ খ্রিস্টপূর্বে সম্রাট অশোক এটি প্রতিষ্ঠা করেন। সে হিসাবে বিহারের বয়স প্রায় ২৩০০ বছর। বর্তমানে এ বিহারটি বাংলাদেশী বৌদ্ধদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থস্থান। পাশাপাশি পর্যটকদের ভ্রমণের জন্যও আকর্ষণীয় গন্তব্য।

শতবর্ষী বটবৃক্ষ, নানা বৈচিত্র্যময় বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলী, জাদুঘর, পদ্মবীণা ঝুলন্ত ব্রিজ, মিরাক্কেল গার্ডেনছাড়া নানা অনুষঙ্গ পর্যটকদের মোহিত করে। যে কারণে বিহারটি এখন শুধু পূজারিদের কাছে নয়, দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার বসতিতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটলেও এ সময় সেই হামলা থেকে বিহারটি রক্ষা পায়। যে কারণে প্রাচীন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ বিহার এখনো সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। 

ঐতিহাসিক রাংকুট বৌদ্ধবিহারের প্রাক-ইতিহাস শিরোনামে বিহারের একটি ভবনের দেয়ালে তুলে ধরা হয়েছে এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। সেখানে ‘ধন্যবতী রাজবংশ’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে যা বলা হয়েছে এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে, গৌতম বুদ্ধ ধন্যবতীর রাজা চাঁদসুরিয়ার সময়ে সেবক আনন্দকে নিয়ে আরাকানের রাজধানী ধন্যবতী যান। যাওয়ার পথে এ পাহাড়ে অবস্থান করেন। এ সময় গৌতম বুদ্ধ সেবক আনন্দকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘হে আনন্দ, ভবিষ্যতে পশ্চিম সমুদ্রের পূর্বপাশে পাহাড়ের ওপর আমার বক্ষাস্থি স্থাপিত হবে। তখন এর নাম হবে ‘‌রাংউ’। ‘রাংউ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বক্ষাস্থি’। ধারণা করা হচ্ছে, ভাষাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় রাংউ থেকে রামু শব্দটি এসেছে। বর্তমানে ঐতিহাসিক রাংকুট বনাশ্রম তীর্থস্থানে ৬ ফুট উঁচু ও সাদা পাথরের মহাকারণিক গৌতম বুদ্ধ মূর্তিটি আছে, এ মূর্তির মাথায় বুদ্ধের বক্ষাস্থি স্থাপিত হয়েছে। সে কারণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি অতি পবিত্র তীর্থস্থান।

খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮ অব্দে সংঘটিত ইতিহাসের বিভীষিকায় কলিঙ্গ যুদ্ধের সময় মানবতার ধ্বংস এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে সম্রাট অশোকের মনে দারুণ রেখাপাত করে। মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করার জন্য এ সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও শ্রীবৃদ্ধিকল্পে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে চুরাশি হাজার ধর্ম স্কন্ধ (মন্দির) নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, রামুর রামকোট বনাশ্রম বৌদ্ধবিহার এর মধ্যে একটি। এ বিহারের প্রতিষ্ঠাকাল ২৬৮ খ্রিস্টপূর্ব। বিহারের প্রধান ফটকের ওপরেও এ সাল লেখা আছে। বিহারের দেয়ালে লেখা ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা মতে, ‘বিহারটি নির্মাণের পরবর্তী সময়ে সেখানে সাতশ বৌদ্ধ ভিক্ষু বসবাস করতেন। ভারত ও বাংলাদেশ পরিদর্শনের সময়ে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এ স্থান পরিদর্শন করেন। কালের পরিক্রমায় হাজার বছরের ঐতিহ্য এ বৌদ্ধবিহারটি মাটিতে তলিয়ে যায়। একসময় গিয়ে বিহারটি ধ্বংসস্তূপ ও বন-জঙ্গলে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯২৯ সালে আবার নতুন করে বিহারটি আবিষ্কৃত হয়।’

বিহারের বর্তমান বিহারাধ্যক্ষ ও পরিচালক জ্যোতিসেন মহাথের জানান, ইতিহাস পর্যালোচনা করে যা জানতে পেরেছি, ১৯২৯ সালের দিকে বিহারের ধ্বংসাবশেষ দেখে তৎকালীন জগতচন্দ্র মহাস্থবির নামের এক বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কারক এটি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। স্থানীয় জমিদার মতিসিং মহাজনের আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে জগতচন্দ্র মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ায় এ বিহারটির গুরুত্ব ব্যাপক। শুধু তীর্থস্থান নয়, ঐতিহাসিক তীর্থস্থান বলা হয় এ বিহারকে। পুরাকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ এ বিহারের মাটি খুঁড়লেই পুরনো ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়। প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তির ধ্বংসাবশেষ, সেকালের ইটের টুকরোসহ এ রকম অনেক স্মৃতি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ব্যাপকভাবে খননকাজ চালালে এখান থেকে আরো অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করা যাবে বলে ধারণা করেন গবেষক ধনীরাম বড়ুয়া। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ সালে প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথের নামের ধর্মসংস্কারক এ বিহারের সংস্কারের কাজ করেন। ওই সময় রাংকুটের পাহাড়ের পাদদেশে ধ্বংসাবশেষ এবং প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তির অসংখ্য খণ্ড খণ্ড টুকরো পাওয়া যায়। সুদীর্ঘ বিশ বছরের বেশি সময় তিনি এখানে অবস্থান করেন। ১৯৮৮ সালে বিহারে অবস্থানকালে গভীর রাতে তিনি ডাকাত দলের আক্রমণের শিকার হন। এ সময় ডাকাতরা বিহারের বহু প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর করে। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সুস্থ হলে প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথের রামকোট থেকে চলে যান। বর্তমানে প্রতি বছর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে এ বিহারে যে ‘চুরাশি হাজার ধর্মস্কন্ধ পূজা’ অনুষ্ঠিত হয়, এটি তিনি প্রবর্তন করেন। 

গৌতম বুদ্ধের মূর্তির সামনে চুরাশি হাজার ধর্মস্কন্ধ পূজাকে ঘিরে প্রতি বছর বৈশাখী পূর্ণিমার আগের রাত থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৌদ্ধ নর-নারীরা এ বিহারে ছুটে আসেন। দেশী-বিদেশী পর্যটক ও পুণ্যার্থীর পদচারণায় সারা বছর এ বিহার মুখরিত থাকলেও বৈশাখী পূর্ণিমার দিন এ বিহার পূর্ণ ঐতিহ্য ফিরে পায়। রাতভর চলে বুদ্ধ কীর্তন, আর ভোরবেলায় হাজার হাজার মানুষ মহাসমারোহে উদযাপন করে চুরাশি হাজার ধর্মস্কন্ধ পূজা। সেই থেকে রাংকুট বৌদ্ধবিহারে ব্যূহচক্র মেলা (প্যাঁচঘর), চুরাশি হাজার ধর্মস্কন্ধ পূজাসহ নানা উৎসব উদযাপন করা হচ্ছে জানিয়ে জ্যোতিসেন মহাথের জানান, জগতচন্দ্র মহাস্থবিরের অনুপ্রেরণায় বাংলা নববর্ষের বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে সাত দিনব্যাপী ব্যূহচক্র মেলার (প্যাঁচঘর) আয়োজন করা হতো, যা পরবর্তী সময়ে রামকোটের মেলা নামে পরিচিতি লাভ করে।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ‘‌এখানে সংরক্ষিত বুড়ো গোঁয়াই মূর্তি বৌদ্ধদের কাছে অতি পূজনীয়। সংসার জীবনে শান্তি ও কল্যাণের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এ মূর্তি দর্শন এবং পূজা দিতে প্রতিদিন অসংখ্য পূজারি এখানে আসেন। এছাড়া নবজাতককে অন্নপ্রাশন, প্রব্রজ্যা দান, সংঘদান অষ্টপরিষ্কার দানসহ নানা রকম ধর্মীয় আচারাধি রাংকুট বিহারে এসে সম্পন্ন করেন। আবার ফলও পান। নানা কারণে বিহারটি বাংলাদেশী বৌদ্ধদের কাছে অতি পবিত্র এবং সবচেয়ে বেশি ধর্মীয় মর্যাদাপূর্ণ তীর্থস্থান।’

সুনীল বড়ুয়া: সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মী