সিল্করুট

গন্ডোয়ানাল্যান্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাস

এসএম রশিদ

অস্ট্রেলিয়ার হান্টার ভ্যালিতে কয়লাখনি, ২০১১ ছবি: ম্যাক্স ফিলিপস

গন্ডোয়ানা বা গন্ডোয়ানাল্যান্ড আমাদের দূর থেকে দূরতম অতীতের ইতিহাস। পৃথিবীর দক্ষিণভাগের এ সুপার বা মেগাকন্টিনেন্ট ভাঙতে শুরু করে আজ থেকে ১৮ কোটি বছর আগে। ১৮৮০ সালের পর থেকে গন্ডোয়ানা শব্দটি ধীরে ধীরে আধুনিক মানুষের ইতিহাসে, আলোচনায়, বইয়ে জায়গা করে নিতে থাকে। অনেকে এর উৎস যে ভারতের গোণ্ড আদিবাসী সম্প্রদায়ের নাম থেকে তা-ও জানেন না। কিন্তু শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে যায়। আজকের যে সভ্যতা ফসিল জ্বালানির ওপর নির্ভর করে চলছে তার উৎসও সেই গন্ডোয়ানাল্যান্ড। দক্ষিণভাগের মহাদেশগুলো মাটির তলায় যে তেল, গ্যাস বা কয়লা পাওয়া যায় তা গন্ডোয়ানারই উপহার। গন্ডোয়ানার আধুনিক ইতিহাস তাই অ্যানথ্রোপসিনের ইতিহাসের উপাদান।

গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামটির উদ্ভব ১৮৮৫ সালে। ১৮ কোটি বছরের বেশি পুরনো এ বিস্তৃত ভূভাগের আধুনিক ইতিহাসও হাজির হলো। ইতিহাসবিদ ও ভূতত্ত্ববিদরা মিলিতভাবে এ ইতিহাস খুঁজতে শুরু করেন। বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সাহিত্যে গন্ডোয়ানার ধারণা নতুন নতুন চেহারা নিতে থাকে। কখনো প্রাক-মানব, কখনো মানুষের, কখনো আদিবাসীর, কখনো জাতীয়তাবাদের আবার কখনো নব্য-উপনিবেশবাদীদের।

গন্ডোয়ানার আধুনিক ইতিহাস শুরু ও নামকরণ মধ্য ভারতের গোণ্ড অঞ্চলের নামে, যা গোণ্ড আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসভূমি। অস্ট্রিয়ান ভূতত্ত্ববিদ এডুয়ার্ড সুয়েস গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামকরণ করেন ১৮৮৫ সালে। এটা তিনি করেছিলেন উনিশ শতকে দক্ষিণ গোলার্ধে সংঘটিত বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক গবেষণার সঙ্গে ভারতীয় ফসিলের সম্পর্কের ভিত্তিতে। স্থানীয় কোনো নাম দিয়ে হেমিস্ফেরিক ফেনোমেনাকে চিহ্নিত করার এমন ঘটনা দুনিয়ায় বিরল। অনেক অস্ট্রেলিয়ান বিশ্বাস করেন এটি তাদের স্থানীয় শব্দ এবং আদিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো নাম। অস্ট্রেলিয়ার মুদ্রায় আছে গন্ডোয়ানা। সে দেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতিতেও টার্মটির উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ভারতে আছে গন্ডোয়ানা গণতন্ত্র পার্টি, যারা আলাদা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করছে। প্রাচীন, প্রাক-ইতিহাসের সেই মেগাকন্টিনেন্ট কেন আজকের দিনের মুদ্রায় উঠে আসে? আধুনিক ইতিহাসে নামটি কেন জায়গা করে নিতে পারে?

সুদূর অতীত ও আধুনিক সময় গন্ডোয়ানাল্যান্ডের মাধ্যমে বিস্তৃতভাবে সম্পর্কযুক্ত। একদিকে নামটি লক্ষ-কোটি বছরের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যদিকে তার অবশেষ আমাদের এ যুগে জ্বালানি সরবরাহ করে। সে যুগে যত জীব বাস করত তারা আজ আমাদের জ্বালানি সরবরাহ করে। কয়লা তৈরি হয়েছে, সেটা মানুষ খুঁজে পেয়েছে, খনি থেকে উত্তোলন করেছে এবং তা শিল্প বিপ্লব সম্ভব করেছে। আধুনিকতা যে জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভর করে—কয়লা, কার্বন—তা-ই অ্যানথ্রোপসিন ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করে। গন্ডোয়ানাল্যান্ড শব্দটি তাই আমাদের সুদূর অতীতকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে হাজির করে। প্রাক-মানব যুগের সঙ্গে বর্তমান সময়ের বস্তুগত সম্পর্কের সবচেয়ে শক্তিশালী নিদর্শনটি হচ্ছে গন্ডোয়ানাল্যান্ড। কিছুটা পৌরাণিক সম্পর্ক থাকায় এর আছে নানা সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণও।

গন্ডোয়ানাল্যান্ড দিয়ে ভূতত্ত্বের ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক জীবনী বিশ্লেষণ করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে গন্ডোয়ানাল্যান্ড জাতীয়তাবাদী পরিবেশ ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে। অনেকের কাছে আজকের দিনে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক এবং অঞ্চলে বিভক্ত মানুষের ভূমিতে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের যে ভিন্নতা দেখা যায় তা যে একসময় সম্পর্কযুক্ত ছিল তা গন্ডোয়ানাল্যান্ড তুলে ধরে। ব্যাপারটা বৈশ্বিক বিস্তৃতি থেকে জাতীয়তাবাদী যুগে প্রবেশের মতো। অস্ট্রেলিয়ার ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসে বলা হয় গন্ডোয়ানাই এ জাতির জন্ম দিয়েছে। দ্বীপ মহাদেশটির উদ্ভব হয়েছে গন্ডোয়ানা থেকে। অধ্যাপক লিবি রবিনের মতে, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ অনেকটা বিদ্রোহী কিশোরের মতো যে গন্ডোয়ানা থেকে আলাদা হয়ে নতুন জাতি গড়ে তুলেছে। টিম ফ্লেনারি তার দ্য ফিউচার ইটারস বেশ প্রভাবশালী কাজ হিসেবে বিবেচিত। এ গ্রন্থে তিনি আজকের দিনের অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার মধ্যে থাকা জৈব-ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তিনি আরো অনেক অস্ট্রেলিয়ান পণ্ডিতের মতোই দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার দক্ষিণাংশ ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ককে সামান্যই গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা বলা যায় ক্ষয়ে যাওয়া আধুনিক গন্ডোয়ানাল্যান্ড। আবার অস্ট্রেলিয়ার বিশিষ্ট পরিবেশ ইতিহাসবিদ টম গ্রিফিথস গন্ডোয়ানার একত্বের ধারণার কঠোর বিরোধী। তিনি মনে করেন, এ তত্ত্ব অস্ট্রেলিয়ার বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় এবং এটি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে আঘাত করে। তার কথায় অস্ট্রেলিয়া ইউরোপীয়, এশীয় কিংবা অস্ট্রেলেশিয়ান নয়, বরং দক্ষিণ গোলার্ধের। অ্যান্টার্কটিকার ক্ষেত্রেও তিনি একই ধরনের মত পোষণ করেন। এসব কিছুর মধ্যে গোণ্ডরা কোথায়? এমন প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। গন্ডোয়ানা নামের প্রাচীন মেগা-মহাদেশের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ মানুষই কিছু না কিছু জানে; তারা জানেন অস্ট্রেলিয়া কোনো এক সময়ে সে ভূখণ্ডের অংশ ছিল। তবে মধ্য ভারতের গোণ্ড জনগোষ্ঠী বা তাদের রাজ্য নিয়ে কোনো অজি কিছু জানে না। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার বসবাস করা ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাও গোণ্ডদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানে এমনটা গবেষণায় পাওয়া যায়নি। বরং অস্ট্রেলিয়ায় গন্ডোয়ানা শব্দটি স্থানীয় আদিবাসীদের কোনো স্থানের নাম থেকে উদ্ভূত বলেই বিবেচনা করা হয়। শ্বেতাঙ্গ অজিদের মধ্যেই এ ধারণা প্রবল। অনেক অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরাও নামটি আপন করে নিয়েছেন। একটি আদিবাসী ওয়াইন কোম্পানির নাম আছে গন্ডোয়ানা ওয়াইন; আবার এক আদিবাসী লেখক গ্যারি ডেভেরেলের বইয়ের নাম গন্ডোয়ানা থিওলজি (২০১৮)। অর্থাৎ অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরাও নামটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের নিজেদের করে নিয়েছে।

গন্ডোয়ানা নামটি অস্ট্রেলিয়ায় খুবই জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড নাম। দেশটির সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে ‘গন্ডোয়ানা’র অর্থ প্রাচীন, খাঁটি। নিজেদের জলবেষ্টিত ভূখণ্ডটি অন্যদের স্পর্শহীন, পবিত্র—এমনটাই এ ধারণার মূল কথা। এ ধারণাকে আধুনিক শ্বেতাঙ্গরা জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন, যা কিছু গভীরভাবে অস্ট্রেলীয় তা-ই গন্ডোয়ানার সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশটির ফোক রক ব্যান্ডের নাম গন্ডোয়ানাল্যান্ড, তারা পশ্চিমা যন্ত্র দিয়ে আদিবাসীদের গান গায়। গন্ডোয়ানা পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, প্রাণিকুল, খনিজ সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। পরিবেশ সংরক্ষণ, ইকো-ট্যুরিজম, খনিজ আহরণের সঙ্গেও জুড়ে যায় গন্ডোয়ানা। গন্ডোয়ানার উপহার—কয়লা, গ্যাস, পেট্রোলিয়াম—জন্ম দিয়েছে মেলবোর্নভিত্তিক গন্ডোয়ানা রিসোর্স লিমিটেডের। এসব থেকে বোঝা যায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বাইরে অস্ট্রেলিয়াজুড়ে গন্ডোয়ানা বিস্তৃত হয়েছে সাংস্কৃতিক, পর্যটন, পরিবেশ সংরক্ষণ, সৃষ্টিশীল কাজের পরিসরে। একদা গন্ডোয়ানা সুপারকন্টিনেন্টে যুক্ত থাকা সব ভূখণ্ডে নামটি একইভাবে প্রভাবশালী নয়। যেমন দক্ষিণ আমেরিকায় নামটি কোনোভাবেই অস্ট্রেলিয়ার মতো আইকনিক নয়। চিলিতে অবশ্য একটি ব্যান্ডের নাম গন্ডোয়ানা। শুধু ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায় গন্ডোয়ানাল্যান্ডের ভিন্ন কিন্তু ‘‌জাতীয়’ ইতিহাস।

এখন প্রশ্ন আসে সে প্রাচীন মেগা মহাদেশ কেন সমকালীন জনচেতনায় সক্রিয় হয়ে আছে? কেমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গন্ডোয়ানার ভূমিকা বদলে যায়? বিজ্ঞানীরা মনে করেন আধুনিক মানুষ তরল, ভঙ্গুর, অস্থির দুনিয়ায় গভীর ইতিহাস-সময়-পৃথিবীকে খুঁজতে গিয়ে গন্ডোয়ানাকে হাজির করে। কেউ তার প্রাচীনত্বকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে গন্ডোয়ানাল্যান্ডকে ব্যবহার করে। এসবের বাইরে এখন অ্যানথ্রোপসিনের ধারণা শক্তিশালী হতে থাকায় গন্ডোয়ানাল্যান্ডের প্রভাব অর্থনীতির ইতিহাসেও পড়ছে। উনিশ শতকে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের কয়লা খনন করে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের ইতিহাসে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে গন্ডোয়ানাল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়া এ কয়লা ব্যবহার করে ধনী দেশ হয়ে গেছে। যদিও দক্ষিণ এশিয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। অনেক ভূতত্ত্ববিদ অর্থনীতির ইতিহাসকে গন্ডোয়ানাল্যান্ড ও অ-গন্ডোয়ানাল্যান্ডে ভাগ করতে চাইছেন, যেখানে প্রথমাংশ শেষের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নতির ফসিল জ্বালানি সরবরাহ করেছে। অনেকে বলছেন, এ ধারণা ভবিষ্যতে ইতিহাস রচনার পদ্ধতিকে বদলে দিতে পারে।

এসএম রশিদ: লেখক