সিল্করুট

যাদের নামে সুপার কন্টিনেন্ট

ফারিহা আজমিন

গোন্ডদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ছবি: রমেশ লালওয়ানি

প্রাচীন একটি সুপারমহাদেশ গন্ডোয়ানাল্যান্ড। যার অবস্থান আমেরিকা, আফ্রিকা, অ্যান্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া, মাদাগাস্কার, জিল্যান্ডিয়া, আরব ও ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু ভূখণ্ডসহ মহাদেশীয় অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নিয়েই ছিল। গন্ডোয়ানা পৃথিবীর ভূত্বকের বেশ কয়েকটি স্থিতিশীল ব্লক বা ক্র্যাটন দ্বারা গঠিত একটি একক বৃহৎ স্থলভাগ নিয়ে ছিল, যা প্যালিওজয়িক যুগের মহাদেশীয় ভূত্বকের বৃহত্তম অংশে পরিণত হয়। পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকাজুড়েই এ সুপারমহাদেশের অবস্থান ছিল।

তবে প্রশ্ন জাগতে পারে এ সুপার মহাদেশের নাম গন্ডোয়ানা বা গন্ডোয়ানাল্যান্ডই কেন হলো। গন্ডোয়ানা নামটি দেন ঊনবিংশ শতব্দীর অস্ট্রিয়ান একজন ভূগোলবিদ এডুয়ার্স সুয়েস। তিনি ভারতের মধ্য-উত্তর অংশের গোণ্ডবন অঞ্চলের নামানুসারে গন্ডোয়ানা মহাদেশের নামকরণ করেছেন। শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। মূলত এডুয়ার্স মধ্য ভারতের কাঠামোর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন এ অঞ্চলের। তাই সুপার মহাদেশটির নাম দেন গন্ডোয়ানাল্যান্ড। এর আগে অবশ্য বিজ্ঞানী আলফ্রেড ভেনগার এ মহাদেশের একত্র অবস্থানকে প্যানজিয়া নামে চিহ্নিত করেছিলেন। তবে মধ্য ভারতীয় গোণ্ড জাতিগোষ্ঠীরা নিজেদের কোতোর নামেও পরিচয় দিত। মূলত ভারতের মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহারসহ ওড়িশার রাজ্যেরও বেশকিছু এলাকাজুড়ে গোণ্ড জাতির বসবাস। ভারতীয় উপজাতি হিসেবে স্বীকৃত এ গোষ্ঠী। যাদের মাতৃভাষা গণ্ডি। অনেকের মতে, গণ্ডি ভাষার সঙ্গে তেলেগু ভাষা কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ।

ঐতিহাসিকভাবেই গোণ্ডরা ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য শাসন করেছিল বলে জানা যায়। গন্ডোয়ানা ভারতের গন্ডোয়ানা অঞ্চলের শাসক রাজ্য ছিল। তেমনি এর মধ্যে পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের একটি অঞ্চল বিদর্ভও ছিল। যে রাজ্যের পূর্ব অংশ অমরাবতী ও নাগপুর বিভাগ নিয়ে গঠিত। বলা হয় আত্মরক্ষার জন্যই গোণ্ডরা এ অঞ্চল থেকে ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১১ সালে ভারতের আদমশুমারি অনুসারে গোণ্ড উপগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষ গণ্ডি ভাষা ও এর ২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মানুষ ম্যাক্রো ভাষায় কথা বলে। প্রায় ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার গোণ্ড মানুষের উৎপত্তি নিয়ে আছে নানা মত। কিছু গবেষকদের দাবি, গোণ্ডরা ছিল ভিন্ন ভিন্ন উপজাতিদের একটি মিশ্রণ, যারা শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে একটি প্রোটো-গণ্ডি ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

তবে ভারতের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের মুণ্ডা জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে গোণ্ডদের সখ্যকে গবেষকরা তাদের ভাষা পরিবর্তনের কারণ হিসেবে দেখেছেন। এছাড়া ভারতের দক্ষিণ থেকে গোণ্ডরা এসেছে বলেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মুসলিম লেখকরা চৌদ্দ শতকের পরবর্তী সময়কে গোণ্ড রাজত্বের উত্থানে সময় হিসেবে বর্ণনা দিয়েছেন। পণ্ডিতরা বিশ্বাস করেন, গোণ্ডরাই খ্রিস্টীয় তেরো-উনিশ শতক সময়ের মধ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। যা বর্তমান পূর্ব মধ্যপ্রদেশ থেকে পশ্চিম ওড়িশা এবং উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে উত্তর প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা। এ অঞ্চলে গন্ডি এবং অন্যান্য উপজাতির দ্বারা বেশ কয়েকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে ১৩৯৮ সালে মধ্যপ্রদেশের খেরলার রাজা নরসিংহ রাই একাই গন্ডোদের সব অঞ্চল শাসন করেছিলেন বলেই ইতিহাসবিদ ফারিশতার মতবাদ। তবে কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি মালওয়ার রাজার কাছে পরাজিত হন। চৌদ্দ-আঠারো শতকের মধ্যে চারটি প্রধান গোণ্ড রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় মাণ্ডলা, দেওগড় ও চন্দ্র-সিরপুরের কথা। তবে মাণ্ডলা, দেওগড় ও চান্দা-সিরপুর তিনটি গোণ্ডি রাজ্য নামমাত্র মোগল সম্রাটদের অধীনে ছিল। কারণ সে সময়েও অঞ্চলগুলোয় গোণ্ড রাজাদের আধিপত্য ছিল।

তবে মোগলদের পতনের পর সে সমস্ত এলাকা বুন্দেলা ও মারাঠা সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। গোণ্ডদের প্রথম রাজ্যটি ছিল চন্দ্র, যা ১২০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চন্দ্রের গোণ্ডদের উৎপত্তি সিরপুর থেকে, যা এখন উত্তর তেলেঙ্গানা। বলা হয় এ গোণ্ডরাই মান রাজবংশকে উৎখাত করেছিল। ১৩১৮ সালের দিকে কাকাতিয়াদের পতনের পর সিরপুরের গোণ্ডরা রাজ্যের বাইরে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজস্ব রাজ্য গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিল। চন্দ্র রাজ্যে ব্যাপক সেচ ব্যবস্থা ও রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এটি দুর্গ নির্মাণও শুরু করা হয়েছিল। রাজগোণ্ড রাজ্যের শাসক খণ্ডখ্যা বল্লাল শাহ চন্দ্রপুর শহর প্রতিষ্ঠা এবং সিরপুর থেকে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন যে সময়ে।

এমনকি আইন-ই-আকবরিতেও রাজ্যটির উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে লেখা ছিল চন্দ্রপুরের কথা। এ রাজ্যগুলো মোগলদের অধীনে বেশ স্বল্প সময়ের জন্য ছিল। এরপর গোণ্ডরা রাজ্যগুলো পুনরুদ্ধার করে। তবে ১৭৪০ সালে মারাঠা আক্রমণ শুরু হলে গোণ্ড রাজা ও প্রজা উভয়ই সমভূমি থেকে বন এবং পাহাড়ের নানা জায়গায় পালিয়ে যায়। মারাঠা সম্রাট রাঘোজি ভোঁসলে গড়হা-মাণ্ডলার গোণ্ড রাজাদের বাধ্য করেছিল তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। গোণ্ড রাজাদের ভূখণ্ডগুলো চলে যায় মারাঠাদের দখলে। তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ পর্যন্ত এ অবস্থাই বিরাজ করেছিল। ব্রিটিশরা সে সময়ে গোণ্ডদের"লুণ্ঠনকারী বলেই বিবেচনা করত। তবে স্বাধীন ভারতে গোণ্ডদের সেভাবে আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা কিছুটা ভীত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের নানা স্থানে। কেবল ভারত নয়, ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও আছে এ আদিবাসী জাতির বাস। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নাটোর জেলায়ও গোণ্ড বা গন্দ জাতি হিসেবে বসবাস করছে তারা। স্থানীয় গোণ্ডদের মতে, বাংলাদেশে ১০-১২ হাজার গোণ্ড জাতির লোক রয়েছে। তবে কেবল নাটোর নয়, সিলেটেও রয়েছে এদের বাস। আদি বাসস্থান ভারতের নাগপুর ও বিহারের রাঁচি অঞ্চলে হলেও মূলত নিজেদের আত্মপরিচয় লুকিয়ে জীবনযাপন করতেই গোণ্ডরা ভারতসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে বলা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ড. মেসবাহ কামালের বাংলাদেশের আদিবাসী এথনোগ্রাফির গবেষণা বইটির তৃতীয় খণ্ডে বাংলাদেশে বসবাসরত গোণ্ডদের নিয়ে আছে বেশকিছু আলোচনা। জানা যায়, গোণ্ডরা ওরাওঁ, পাহান, মাহালী, মালো ও মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের লীন করে বেঁচে থাকা চেষ্টা করে। কারণ হিসেবে স্থানীয় জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সদস্য নিপেন শিং জানিয়েছেন, এ সময়ে সিংরা নামের শেষে ভগবান সিং লিখত কিন্তু যখন নিক্ষত্রীকরণ শুরু হয়, তখন তারা ভগবান বাদ দিয়ে সিং পরিচয় দেয়া শুরু করে এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। এভাবেই হাজার হাজার বছর আগের এ আদিবাসী গোষ্ঠী আজও টিকে আছে।

ফারিহা আজমিন: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা