সিল্করুট

সিন্ধুর জল বিবাদ

ফারিহা আজমিন

সিন্ধু জল চুক্তি স্বাক্ষর করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান; তাদের পাশে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ইলিফ, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০ ছবি: বিশ্বব্যাংক আর্কাইভ

ভারত-পাকিস্তান। নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন, ’৪৭-এ দেশ ভাগের পর দুই অঞ্চলের নদী-উপনদীগুলোও লড়াইয়ের একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছিল। বলা যায় ’৪৭-এ দেশভাগের পর সিন্ধু নদের পানি বণ্টন নিয়ে দুই রাষ্ট্রের লড়াই নতুন চেহারায় শুরু হয়ে গিয়েছিল।

সিন্ধু এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ একটি নদ। এটি মানস সরোবর হ্রদের পার্শ্ববর্তী তিব্বত মালভূমি থেকে উৎপত্তি লাভ করে। সেখান থেকে নদীটি জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে গিলগিট-বালতিস্তান ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার দিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং তারপর সিন্ধু পাকিস্তানের করাচির বন্দর নগরীর নিকটবর্তী আরব সাগরে মিলিত হওয়ার জন্য পাকিস্তানজুড়ে দক্ষিণ অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। অবস্থান ও গতিপথের কারণে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের জন্যই সিন্ধু হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। এ নদের পানির অধিকার নিয়ে দেশভাগের পর পরই বাধে ভারত-পাকিস্তান পানি বিবাদ।

সিন্ধুর পানি সেচের কাজে অনাদিকাল থেকেই ব্যবহার হয়ে এসেছে। যদিও আধুনিক সেচ প্রকল্পের কাজ ১৮৫০-এর দশকে শুরু হয়। তবে দীর্ঘদিন ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীন থাকায় ব্রিটিশরা নিজ প্রয়োজনেই সেখানে বড় বড় খাল খননের ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি প্লাবিত চ্যানেলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়, সেই সঙ্গে আধুনিকীকরণও। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। ফলে সৃষ্টি হয়েছিল দুটি স্বাধীন দেশ—ভারত ও পাকিস্তান। এ স্বাধীনতায় কেবল দেশের রাজনৈতিক সীমানার পরিবর্তন বয়ে আনেনি, পাশাপাশি দেশের সম্পদের বিভাজনে হয়েছিল। তখন থেকেই উপমহাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খালগুলোর পানি সরবরাহব্যবস্থা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। ভারত ও পাকিস্তানকে বিভাজনকারী র‍্যাডক্লিফ রেখা বিভাজিত করে পাঞ্জাবকেও। এর ফলে পূর্ব পাঞ্জাব ভারতে ও পশ্চিম পাঞ্জাব পাকিস্তানে পড়ে। এ বিভাজনরেখা থেকেই সিন্ধু অববাহিকায় প্রবাহিত নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে তৈরি হয় বিরোধ। কারণ সিন্ধু অববাহিকার উৎস থেকে উৎপত্তি হওয়া তার পাঁচ উপনদী ছিল ভারতে। তাই এ নদীগুলোর পানি দুই দেশে ন্যায্যভাবে ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘ সময় চলেছে বিরোধ। এ নদীগুলো হলো সিন্ধু অববাহিকার পূর্ব দিকের তিনটি নদী বিপাশা (বিয়াস), ইরাবতী (রবি) ও শতদ্রু (সতলুজ) এবং পশ্চিমে চন্দ্রভাগা (চেনাব), বিতস্তা (ঝিলম) ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। পশ্চিমে নদীগুলো পাকিস্তানের অংশে জল সরবরাহকারী উপনদীগুলোর ওপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলে পাকিস্তান বিপাকে পড়ে। কারণ সমগ্র পাকিস্তানে কৃষিক্ষেত্রের শতকরা ৮০ ভাগ সেচের পানি এ নদীগুলো থেকেই সরবরাহ করা হয়। তাই যখন পানি নিয়ে বিবাদ শুরু হয়, তখন পাকিস্তান জীবিকায় হুমকি অনুভব করেছিল। দেশভাগের প্রথম বছরগুলোয় সিন্ধুর পানি নিয়ে আন্তঃআধিপত্য চুক্তির মাধ্যমে পানি বণ্টন করা হয়েছিল, যা ১৯৪৮ সালের ৪ মে নির্ধারিত হয়। স্বল্পমেয়াদি এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ’৪৮-এর ১ এপ্রিল এবং মেয়াদ শেষ হতেই ভারত পাকিস্তানে প্রবাহিত খালগুলোয় পানি প্রবাহ রুখে দেয়া শুরু করে। এমনকি সিন্ধুর পানি বণ্টন সমস্যা থেকেই সে বছর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধও হয়েছিল। পরে একই বছরের ৪ মে দুই দেশের আন্তঃডোমিনিয়ন অ্যাকর্ড বা আন্তঃঅধিরাজ্য চুক্তি নামে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

সিন্ধু জল চুক্তিতে বলা হয়, ভারত সরকারকে পাকিস্তান বার্ষিক অর্থ প্রদানের বিনিময়েই সিন্ধু অববাহিকার পাকিস্তানের অংশে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করতে ভারত বাধ্য থাকবে। চুক্তিটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছার আশায় পরবর্তী আলোচনার ভাবনা রেখেই তাৎক্ষণিক এটি স্টপগ্যাপ ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। তাই বলা যায়, উভয় দেশ নিজেদের সমস্যাগুলো সাময়িকভাবে কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যেই এ চুক্তি করেছিল। স্থায়ী সমাধানে প্রয়োজন ছিল পরবর্তী সময়ে দুই দেশের আলোচনা। তবে কোনো পক্ষই তাদের নিজ নিজ অবস্থানের সঙ্গে আপস করতে রাজি ছিল না। তাই তাদের আলোচনাও সে অর্থে সুফল বয়ে আনেনি। ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সে সময়ে নদীগুলোর পানিপ্রবাহ সরাসরি করে দেয়ার যেকোনো পরিকল্পনা থেকে ভারতকে বাধা দেয়ার জন্য পাকিস্তানের পক্ষে কিছুই বলার ছিল না।

যদিও পাকিস্তান বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ভারত বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের যুক্তি ছিল সংঘর্ষ এড়াতে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের প্রয়োজন। কিন্তু ১৯৫১ সাল পর্যন্ত উভয় পক্ষের বিষয়টি সমাধানে আর কোনো বৈঠক হয়নি এবং পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। তবে সে সময়ে পাকিস্তান কিছুটা কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিল। কারণ পানি বণ্টন সঠিকভাবে না হওয়া এবং ভারতের পানি বন্ধ করে দেয়ার মতো ঘটনাগুলো পাকিস্তানের কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। দেশে মোট ফলন অনেকাংশে কমে যায়। সব মিলিয়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যদিও আদি থেকেই ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব, তবে দেশভাগের পর আরো সুস্পষ্ট হয়েছে এর পেছনের কারণগুলো। এর মধ্যে সে সময় সিন্ধুর পানি বণ্টনই ছিল অন্যতম।

’৪৭-এ আপস করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উভয় জাতি একটি সমাধান খুঁজতে উদ্বিগ্ন ছিল। কারণ সিন্ধু বিরোধ অমীমাংসিত হলে নিজেদের মধ্যে সে সময়ে উত্তেজনা বাড়বে অথবা প্রকাশ্য শক্রতার দিকে নিয়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে ১৯৫১ সালে ডেভিড লিলিয়েনথাল, টেনেসি ভ্যালি অথরিটি ও ইউএস অ্যাটমিক এনার্জি উভয় কমিশনের সাবেক প্রধান, বিখ্যাত মার্কিন ম্যাগাজিন কোলিয়ারের জন্য কিছু নিবন্ধ লেখার উদ্দেশ্যে গবেষণার কাজে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনি সে সময়ে পরামর্শও দিয়েছিলেন ভারত ও পাকিস্তানের উচিত বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ এবং অর্থায়নে যৌথভাবে সিন্ধু নদ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য একটি চুক্তির দিকে কাজ করা।

তৎকালীন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইউজিন আর-ব্ল্যাক। তিনি দুটি দেশ পরিদর্শন করেন এবং ভারত, পাকিস্তান ও বিশ্বব্যাংকের প্রকৌশলীদের একটি ওয়ার্কিং পার্টির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যেন পানি বণ্টন সমস্যা মোকাবেলা করা যায়। তাদের প্রস্তাবে প্রাথমিকভাবে দুই দেশ এ মধ্যস্থতা মেনে নেয়। 

ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪ সালের পূর্বদিকের তিনটি নদী ভারতে এবং পশ্চিমের তিনটি নদীর পানি পাকিস্তান ব্যবহারের জন্য বণ্টন করে একটি খসড়া প্রস্তাব প্রদান করে বিশ্বব্যাংক। দুই দেশের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং দীর্ঘ ছয় বছর দফায় দফায় দুই দেশের সিন্ধু কমিশন এ বিষয়ে আলোচনার পর অবশেষে ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এবং বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি বা সিন্ধু জল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটিতে পশ্চিমের নদী—সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের পানি পাকিস্তানকে এবং পূর্বের নদীগুলো—রাভি, বিয়াস ও সতলেজের পানি ব্যবহারে ভারতকে অনুমতি দেয়া হয়। এ চুক্তিতে উভয় দেশকে বিশেষ কিছু শর্তও জুড়ে দেয়া হয়। যেন দুই দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। বলা হয় ভূখণ্ডের নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৬০ বছরে ভারত-পাকিস্তানকে বেশকিছু সীমান্ত সংঘাত-বিবাদে জড়াতে দেখা গেলেও সিন্ধু জল চুক্তি সেখানে সফলতা পেয়েছে।

ফারিহা আজমিন: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা