সিল্করুট

উপনিবেশ-উত্তর দক্ষিণ এশিয়ায় সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে পানি

আহমেদ দীন রুমি

ছবি: গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস

ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিল ব্রিটিশরাজ। শাসনদণ্ড হাতে তুলে দেয়ার জন্য নির্বাচন করা হলো দুটি পরস্পরবিরোধী প্রতিনিধি দলকে। এতদিন দক্ষিণ এশিয়ার উপনিবেশ একটা ‘ইউনিট’ আকারে শাসিত হলেও এবার বিভাজিত হলো। পাকিস্তানের সংকট ভারতের জন্য ‘অপর’ ও ভারতের সংকট পাকিস্তানের ‘অপর’ হয়ে উঠল। কিন্তু বিভাজন দিয়ে তো আর নদীর গতিপথ বদলে ফেলা যায় না। ফলে উপনিবেশ-পরবর্তী ভারত ও পাকিস্তান এবং আরো পর দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সম্পর্ক নির্ধারণে নদী পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা। ভারত একদিকে ‘সার্বভৌমত্ব’-এর সংজ্ঞাকে রাজনৈতিক স্বার্থে প্রভাবিত করেছে, অন্যদিকে পানিকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী দেশের ওপর চালিয়েছে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের কূটনৈতিক, প্রকৌশলী ও রাজনীতিবিদদের প্রস্তাব ছিল শতদ্রু নদী থেকে খাল খননের মাধ্যমে চাষাবাদ করা। কিন্তু নদীটি যে পথ ধরে বাহিত হয়েছে, তার নিম্নাঞ্চলে রয়েছে পাকিস্তান। অর্থাৎ খাল খননের মাধ্যমে পানি অন্যদিকে চালনা করলে সৃষ্ট সংকটে বাধাগ্রস্ত হবে পাকিস্তানের চাষাবাদ। কিন্তু নিজেদের পক্ষে সমর্থন তৈরি এবং খাল খননের নৈতিক ও আইনি ব্যাখ্যায় ভারত সামনে আনে সার্বভৌমত্বের ধারণা। যেহেতু সার্বভৌমত্বের মানে রাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সবকিছুর ওপর একচ্ছত্র অধিকার। সে অধিকার ভূমির ওপর যতটুকু, ততটুকুই পানির ওপর। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকেও ভারত যেহেতু এগিয়ে গিয়েছিল, কমনওয়েলথের আশ্রয়েই নদীর পানিপ্রবাহ প্রশ্নে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান ছিল আধিপত্যবাদী। 

সার্বভৌমত্বের গড়পড়তা সংজ্ঞা হলো রাষ্ট্রের চূড়ান্ত, অবাধ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এ ক্ষমতাবলেই রাষ্ট্র তার ভেতরে সবাইকে আদেশ ও নির্দেশ দান করে এবং সবার কাছ থেকে আনুগত্য লাভ করে। বাইরের কোনো প্রভাব থেকে রাষ্ট্র থাকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত। রাষ্ট্রের বর্তমান ধারণা যেহেতু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফসল, ফলে ‘ভেতর’ ও ‘বাইরে’ ধারণা নিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রভাবিত করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে। সম্ভবত এ কারণেই ইদানীং অনেক পণ্ডিত সার্বভৌমত্বকে সর্বশেষ হিসেবে মানতে নারাজ। বরং তারা একে আপেক্ষিক বলে মনে করতে চান। যা-ই হোক, গবেষক ড্যানিয়েল হাইনস তার Disputed Rivers : Sovereignty, Territory and State-Making in South Asia গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন, ১৯৪৮-৫১ সালে ভারতের পানিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে সার্বভৌমত্বের এ ‘ভেতর’ ও ‘বাইরে’ সমীকরণ ভূমিকা রেখেছে। যেহেতু স্বাধীনতার পর ভারত একটি আঞ্চলিক ও সার্বভৌম পরিচয় আর পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে ভারতের বাইরে; ফলে ভারতের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতের একচ্ছত্র অধিকার। যেহেতু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়ের নদীগুলোর বড় অংশই ভারত থেকে প্রবেশ করেছে, ফলে পানিপ্রবাহে ভারতের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। সার্বভৌমত্বের নামে ভারতের সেই সুযোগ লুফে নেয়া প্রভাবিত করেছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তার আচরণকে।

১৯৪৮ সালের মে মাসেই দাবি করা হয়, নিজ দেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পানি ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বিশ্বের এমন সব স্বাধীন রাষ্ট্র সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে কমনওয়েলথ। কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে ভারত তার ভেতর-বাহির দ্বৈত ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে, যা মধ্যকার জটিলতাকে আরো বাড়িয়েছে। কারণ একটা অঞ্চল কেবল একটা অঞ্চল মাত্র নয়, তার নিজস্ব ইতিহাসও থাকে। আছে নিজস্ব গল্পও। ঔপনিবেশিক শাসনের পর কাশ্মীর, বাংলা ও পাঞ্জাব আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। সম্প্রদায়গত পরিচয়কে ‍মুখ্য করে তোলায় বিষয়টি রূপ নিয়েছিল আরো জটিল। দুই দেশের মধ্যে সীমানা, শরণার্থী ও ব্রিটিশ শাসকদের রেখে যাওয়া সম্পদ বণ্টন প্রাথমিক কার্য হিসেবে দেখা দেয়। ক্রমে দুই দেশই নিজ নিজ জনগণ, প্রতিষ্ঠান, আইন ও বিধানাবলির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। দেশের অভ্যন্তরে এভাবে একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার অধীন। পানির বিষয়টি নজরে আসতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। পানি এমন এক সম্পদ, যা নিজের মতো করেই প্রবাহিত হয়। কোনো বাঁধাধরা নিয়ম-কানুন কিংবা সীমান্তরেখা মানে না। ফলে জাতীয়তাবাদের যুগে নির্মিত সার্বভৌমত্বের যে গতানুগতিক সংজ্ঞায়ন, তাতে তৈরি হয় ভূরাজনৈতিক সমস্যা।

পাঞ্জাব ভাগ করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পর সিন্ধু নদের অববাহিকাও বিভক্ত হয়ে যায় দুই ভাগে। কিন্তু উজানের দিকে অবস্থান থাকার কারণে পানিপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ভারতের হাতে। উপনিবেশ-উত্তরকালে ভারত পরিণত হয় উজানের দেশ হিসেবে। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশেই প্রবাহিত অধিকাংশ নদীর পানি ভারত থেকেই প্রবেশ করে। যা হোক সীমারেখা টানার ব্যাপারে স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফ জানিয়েছিলেন, বিভাগের পর যেন চাষাবাদ, রেল স্থাপনা, বিদ্যুৎ ও অন্য বিষয়াবলি বাধাগ্রস্ত না হয় সেটা তারা মাথায় রেখেছেন। তিনি চাইছিলেন ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মতো করেই যেন বিষয়টির মীমাংসা করে নেয়। কিন্তু পানির সমস্যার সুরাহা হওয়ার চেয়ে জটিলতর হয়। পশ্চিম পাঞ্জাবের চাষাবাদ পূর্ব পাঞ্জাব হয়ে আসা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। অথচ পশ্চিম পাঞ্জাব তথা পাকিস্তানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ খালেই পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয় পূর্ব পাঞ্জাব তথা ভারত। ১৯৪৮ সালের ৪ মে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দল দিল্লিতে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুসারে বার্ষিক মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পাকিস্তান পূর্ব পাঞ্জাব থেকে পানি পাবে। তবে অনেক দিক থেকেই চুক্তিটি ছিল বেআইনি। 

পানিপ্রবাহের ওপর অধিকারের প্রশ্ন তুলে ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরা বারবার পাকিস্তানকে ‘অপর’ কিংবা ‘অন্য দেশ’ হিসেবে হাজির করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের দাবি ছিল, ঐতিহাসিকভাবেই পাঞ্জাবের মানুষ নদীর পানির ব্যবহার করে আসছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হিসেবেই তারা অধিক হকদার পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ পাকিস্তানের চোখে দেখলে পানি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম প্রশ্নের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু ভারতের দিক থেকে দাবিটি ছিল উল্টো। তারা তৎপর ছিল কোনটা ভারতীয় আর কোনটা ভারতীয় নয়, সেটার সংজ্ঞায়নে। যা কিছু ভারতে আছে; তার সবকিছুই ভারতীয়; নদীর পানিও। ফলে তার ব্যবহারও ভারতীয়—যে নদী ও খাল ধরে পানি পাকিস্তানের দিকে যায়; তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকারও ভারতের রয়েছে। পূর্ব পাঞ্জাব উজানের পানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে সার্বভৌমত্ব মনে করতে শুরু করেন ভারতীয় প্রশাসন। 

এদিকে একটা ভিন্ন দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। পূর্ব পাঞ্জাব খোদ ভারতের ভেতরে বিকানুরের মতো অঞ্চলে পানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রেও বার্ষিক অর্থ ধার্য করে চুক্তি করেছিল। অর্থাৎ এক রাষ্ট্রের দুটি প্রদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর জন্যও পানির সরবরাহ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু ছিল। এটাকে অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার জন্য ব্যবস্থা নেন ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা। তারা একদিকে প্রাদেশিক ইউনিটগুলোর মধ্যে পার্থক্য কমাতে চেয়েছেন, বিপরীতে পাকিস্তানের বিপরীতে কঠোর হতে চেয়েছেন। তাদের ভাষ্য ছিল, আন্তঃপ্রাদেশিক টানাপড়েন থাকলে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধে সুবিধা করা যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের সাংবিধানিক ক্ষমতার বদলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাট্টা থাকাই পরিণত হয় মূল উদ্দেশ্যে। এভাবে যে বিরোধ শুরু হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে তা শেষ হলো ভারত-পাকিস্তান বিরোধ হিসেবে। 

ব্রিটিশ আমলেই ঔপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের তত্ত্বাবধানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। তার পরও ঔপনিবেশিক সরকার পানিসংক্রান্ত বিবাদকে কমনওয়েলথের বাইরে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই সুযোগ নিয়েছিল ভারত। স্বাধীনতার পর ভারত যেহেতু ব্রিটিশ নীতির উত্তরাধিকার লাভ করে সেহেতু ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে থাকা আন্তর্জাতিক চুক্তি মোতাবেক চলতে থাকে। এড়িয়ে চলতে থাকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে। বিপরীতে স্বাধীনতার পর পরই পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের তত্ত্বাবধানকে। পাকিস্তান ১৯৪৯ সালে সিন্ধুর পানি সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় ভারতকে। কিন্তু ভারত বাধা দেয়। পাকিস্তান বিষয়টিকে বারবার আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নেয়ার চেষ্টা করলেও ভারত নারাজ ছিল। তারপর ১৯৫৭ সালে বিশ্বব্যাংক বিষয়টির দিকে নজর দেয়। 

ভারতের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এড়িয়ে চলার প্রধান কারণ ছিল বিষয়টিকে আদালতের বাইরে রাখতে পারাটা লাভজনক। পানি নিয়ে বিবাবদকে তারা দেখাতে চাইত কমনওয়েলথভুক্ত দুটি অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে। ১৯৫৩ সালে কমনওয়েলথের আদালত ভারতের ব্যাখ্যাকেই গ্রহণ করে। শতদ্রু নদীর উজানের পানি নিয়ন্ত্রণ করাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেই ঘোষণা করা হয়। পানিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনার সুবিধা পেয়ে ভারত আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানের আবেদনকে উপেক্ষা করে যায়। এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায় ভারতের দ্বৈত অবস্থান। দেশটি একদিক থেকে নাকচ করে যাচ্ছে, যেন সিন্ধু নদের পানি আন্তর্জাতিক বিষয় নয়; বরং কমনওয়েলথভুক্ত ডমিনিয়নের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ফলে আন্তর্জাতিক আদালতে নেয়ার দরকার নেই। একই সময়ে এটাও দাবি করছে পাকিস্তান একটা আলাদা সার্বভৌম দেশ। ভারতীয় নদীর ওপর দেশটির ঐতিহাসিক কোনো অধিকার নেই। অর্থাৎ পাঞ্জাবের পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে অভ্যন্তরীণ হিসেবে তকমা দেয়া হচ্ছে। ভারত সার্বভৌমত্বকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, যার মধ্য দিয়ে কেবল সে নিজেই লাভবান হয়। আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিবেশীর ওপর।  

৪ মে চুক্তিটি ছিল বিতর্কিত। এমনকি নেহরু নিজেই মনে করতেন, বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক হিসেবে হাজির করা যাবে না, বিবেচিত করতে হবে অভ্যন্তরীণ হিসেবে। অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন অনেক কর্তাব্যক্তিই মনে করতেন বিষয়টি আন্তর্জাতিক। পাকিস্তান একটি বিদেশী রাষ্ট্র। এখানেই শেষ হয়নি। ১৯৫০ সালের মে মাসে জাতিসংঘ ভারত ও পাকিস্তানের বেশকিছু চুক্তি নিবন্ধিত করে। তার আগে পানিসংক্রান্ত ইস্যুর সুরাহার জন্য পাকিস্তান যখন তৎপর হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে, ভারত তখন ভিন্ন পথ নেয়। ভারতের পক্ষ থেকে কেবল ৪ মে চুক্তি না, দুই দেশের মধ্যে বিভাগ-পরবর্তী অন্য চুক্তিগুলো নিয়েও হাজির হয়। এটা ছিল নয়া রাজনৈতিক কৌশল। উদ্দেশ্য ছিল, যদি অনেকগুলো চুক্তিকে একসঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির করা হয় তাহলে আদালতের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করা সম্ভব হবে। এর মধ্য দিয়ে বিতর্কিত চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা হবে কম। 

উপনিবেশ-পরবর্তী পানি বন্টন বিবাদ নিয়ে ভারতের এ রকম অবস্থান কয়েকটি বিষয়কে সামনে আনে। পাকিস্তানকে তখন নিজের রাজনৈতিক সুবিধামতো একই সঙ্গে কমনওয়েলথভুক্ত ডমিনিয়ন এবং বিদেশী রাষ্ট্র বিবেচনা করতে চাচ্ছিল ভারত। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মুখোমুখি হওয়া এড়াতে ভারত একদিকে বিদেশী রাষ্ট্র বলতে নারাজ। অন্যদিকে উজানের দেশ হিসেবে পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে জোর দাবি ছিল পাকিস্তান বিদেশী রাষ্ট্র। তাহলে ৪ মে চুক্তিটি দুটি ডমিনিয়নের মধ্যে হয়েছে নাকি দুটি দেশের মধ্যে—সেই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর ভারত দিতে পারেনি। মূলত ভারতীয় সার্বভৌমত্ব ধারণার উদ্দেশ্য ছিল পানিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক অঙ্গগুলো সেই সংজ্ঞা থেকেই সুবিধা নিয়েছে। ধোঁয়াশা তৈরি করেছে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। সার্বভৌমত্ব এখানে রাষ্ট্রের সক্ষমতার সঙ্গে জড়িত নয়, জড়িত ভূগোল ও আরো বড় করে বললে রাজনীতির সঙ্গে। 

পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এ সম্পর্ক বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান সীমান্তের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য অধিকাংশ নদী ভারত হয়ে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে নেপাল ও ভুটান হয়ে নদী প্রবেশ করেছে ভারতে। দুই দিকে ভারতের নীতি দুই রকম ছিল। ভারত কী পরিমাণ পানি দিতে রাজি, তার ওপর নির্ভর করতে হয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নদীগুলোকে। অন্যদিকে ভারত কী পরিমাণ পানি গ্রহণ করতে রাজি তা মেনে নিতে হয় নেপাল ও ভুটানকে। ভারত তার সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে যে কৌশল গ্রহণ করেছে, তা প্রতিবেশী দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞায়নকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

আহমেদ দীন রুমি: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা