সিল্করুট

রামকোটের ইতিহাস পর্যালোচনা

শিরুপন বড়ুয়া

ছবি: ছৈয়দ আলম

রাজারকুল ইউনিয়নে অবস্থিত রামকোট এলাকাটি কক্সবাজারের রামু উপজেলার সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে খ্যাত। এর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব শুধু এ অঞ্চলের নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এখানে। এখানকার ছোট ছোট টিলায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রাচীন ইট ও নানা ধরনের প্রাচীন অবকাঠামোর চিহ্ন। তবে স্থানটির ইতিহাস নিয়ে বেশকিছু ভ্রান্ত ধারণা ও মতবাদ স্থানীয়ভাবে চালু আছে। বলা যায়, স্থানীয় কিছু জনশ্রুতিকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট বিতর্কিত করা হয়েছে রাংকুটের ইতিহাস। 

জনশ্রুতির মধ্যে একটি হচ্ছে রামকোট বা রাংকুটের বৌদ্ধবিহার সম্পর্কে। মনে করা হয় এটি মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট মহামতি অশোক দ্বারা নির্মিত এবং এ বিহারে সংরক্ষিত আছে গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থি বা বুকের হাড়। দ্বিতীয় জনশ্রুতিটি হচ্ছে, এ রাংকুটেই বনবাসের সময় এসেছিলেন রামায়ণের রামচন্দ্র ও সীতা। শুধু তাই নয়, রামকোট হিন্দু মন্দিরে সংরক্ষিত আছে সীতাদেবীর মরিচ বাটার শিলপাটা—এমন বক্তব্যও বিশ্বাস করে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়। কিন্তু বিশ্বাস তো আর পদ্ধতিগত চর্চা ও প্রমাণিক ইতিহাস হতে পারে না। 

রামকোটকে প্রাচীন আমলের হরিকেল রাজ্যের অংশ বলে মনে করা হয়। দেবাতিদেব, কান্তিদেব ও অট্টকরাদেব এ তিনজন বৌদ্ধ রাজা চট্টগ্রামে রাজত্ব করতেন বলে জানা যায়। এদের মধ্যে ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা দেবাতিদেব কর্তৃক হরিকেলিয়াম সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণের জন্য জায়গা দান করার কথা জানা যায়। এখানে হরিকেলিয়াম হচ্ছে হরিকেল রাজ্যের জনগোষ্ঠী। এ দানের বিষয়টি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল একটি তামার ফুলদানিতে। পরবর্তীকালে ওই ফুলদানি চট্টগ্রাম থেকে আবিষ্কৃত হয়, যা বর্তমানে ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায় একটি বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে হরিকেল রাজ্যের রাজা কান্তিদেবের তাম্রলিপি উদ্ধারের পর নিশ্চিত হওয়া গেছে, চট্টগ্রাম একসময় হরিকেল রাজ্যের অংশ ছিল। বাংলাপিডিয়ার ভাষ্যমতে, রামুর রামকোট ছিল প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের একটি অংশ। এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, প্রাচীনকালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের রামু সমতট নয়, বরং হরিকেল রাজ্যেরই একটি অংশ ছিল। নতুবা হরিকেল রাজ্যের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিল।

রামুতে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু হিউয়েন সাং এসেছিলেন কিনা, তা বিতর্কের বিষয়। হিউয়েন সাংয়ের রামু ভ্রমণের বিষয়টি অনেকটা জোর দিয়েই বলেছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং লেখক শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞাবংশ মহাথের তার রচিত ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে’ গ্রন্থটিতে। হিউয়েন সাং সমতটে বেশকিছু বৌদ্ধবিহার ও এর রাজধানীর কাছে সম্রাট অশোক নির্মিত একটি বৌদ্ধ স্তূপের দেখা পেয়েছিলেন। তার ভ্রমণবৃত্তান্তে এটা স্পষ্টভাবে বলা আছে যে এ সমতটের পর দক্ষিণে আরো ছয়টি দেশ আছে, যেখানে তিনি ভ্রমণ করেননি। এছাড়া বিভিন্ন উৎস থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে হিউয়েন সাং অতিমাত্রায় দুর্গমতার জন্য সমতটের পর আরো দক্ষিণে ভ্রমণ করেননি। তার মানে, তিনি আদৌ চট্টগ্রাম ও রামুতে আসেননি। যদি তিনি এ অঞ্চলে আসতেন, তাহলে অবশ্যই তার নিজের ভ্রমণবৃত্তান্ত ছাড়াও পরবর্তী সময়ে অন্যান্য চৈনিক বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং পরিব্রাজকদের ভ্রমণবৃত্তান্তে সেটা উল্লেখ থাকত। 

হিউয়েন সাংয়ের কিছু বছর পর ভারতবর্ষে আসা আরেক বৌদ্ধ ভিক্ষু ইৎ সিঙের (IT sing) বর্ণনায় হরিকেল রাজ্য সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ইৎ সিঙের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে প্রাচীন হরিকেল রাজ্য সমুদ্র-তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত ছিল এবং এ রাজ্যে সমুদ্রবন্দরও ছিল। ইৎ সিঙের হরিকেলবিষয়ক বর্ণনা অমিতাভ ভট্টাচার্য্য রচিত ‘হিস্টোরিক্যাল জিওগ্রাফি অব অ্যানশিয়েন্ট অ্যান্ড আর্লি মেডিয়েভাল বেঙ্গল’ গ্রন্থেও পাওয়া যায়। তার মতে, সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের সমুদ্র-তীরবর্তী এলাকাই হরিকেল। এসব বিবরণী থেকে এটা সুস্পষ্ট যে সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী এলাকায় ‘হরিকেল’ নামে পৃথক একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। ইৎ সিঙ, বো হিং এবং হু লিন এদের কারো ভ্রমণবৃত্তান্তে হরিকেল রাজ্যে সম্রাট অশোক কর্তৃক নির্মিত কোনো বৌদ্ধ স্তূপের কথা উল্লেখ নেই। তাই এটা অনেকটাই নিশ্চিত যে চট্টগ্রাম ও রামু যদি হরিকেল রাজ্যের অংশ হয়, তবে এ এলাকায় সম্রাট অশোক কর্তৃক নির্মিত কোনো বৌদ্ধ স্তূপ কখনই ছিল না। শুধু তাই নয়, হিউয়েন সাং কখনো হরিকেলে আসেননি। তিনি সমতট এলাকায় অশোক নির্মিত বৌদ্ধ স্তূপ দেখে থাকলেও আজকের চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম কখনই সেই সমতটের অংশ ছিল না। 

সুতরাং চট্টগ্রাম ও রামু যদি সমতট হয়, তাহলে হরিকেল হবে ত্রিপুরার আরো পূর্বে অথবা আরাকানের আরো দক্ষিণ-পূর্বে, যা ভারতবর্ষের বাইরে। কিন্তু তা একেবারেই অসম্ভব। রাংকুট সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞাবংশ মহাথের’র লেখা ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে’ গ্রন্থটি নিয়ে আরো আলোচনা করতে চাই। গ্রন্থের লেখক ‘রামু’ শব্দের উৎপত্তি এবং ‘রাংকুট’ কীভাবে ‘রামকোট’ হয়ে গেল তা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। শুধু তাই নয়, তার বক্তব্য জোরালোভাবে দাঁড় করানোর জন্য কিছু যুক্তিও দেখিয়েছেন। লেখকের মতে, ‘রাংউ’ শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ‘রামু’ হয়েছে (পৃষ্ঠা-২৩)। আরো বলেন, ‘রাং’ একটি আরাকান ভাষাজাত শব্দ, যার অর্থ বুকের হাড় বা বক্ষাস্থি এবং ‘উ’ অক্ষরটি আরাকানিরা ব্যবহার করে থাকে কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য। এটা সত্য যে সম্মান প্রদর্শনের জন্য বাংলায় আমরা যেমন ‘শ্রী’, ‘জনাব’, ‘শ্রদ্ধেয়’ শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকি, তদ্রূপ রাখাইনরাও সম্মান জানাতে নামের আগে ‘উ’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। যেমন ‘উ খিজারী’। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সম্মান দেখাতে গিয়ে এক অক্ষরবিশিষ্ট ‘উ’ শব্দটি ‘রাং’ শব্দের পেছনে গিয়ে বসল কোন যুক্তিতে? 

প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো আদান-প্রদানের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের সংস্কৃতিতে এসব প্রভাব বেশ ভালোভাবেই লক্ষণীয়। যেমন থাইল্যান্ডের অন্য নাম সুবর্ণভূমি, মালয়েশিয়ার একটি জায়গার নাম পুত্রজায়া, সিংহপুর থেকে সিঙ্গাপুর, মিয়ানমারের প্রাচীন কিছু নগরের নাম বৈশালী, রম্যবতি,ধন্যবতি প্রভৃতি। ঠিক একইভাবে ‘রামকোট’ নামটিতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব আছে। ‘রামকোট’ নামটিকে একটু বিশ্লেষণ করলে ধারণাটা আরো পরিষ্কার হবে। ‘রামকোট’ নামটির শেষে ‘কোট’ শব্দটি একটি প্রত্যয়, যার অর্থ দুর্গ। ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক শহরের নাম এই ‘কোট’ [kot] প্রত্যয়যোগে গঠিত হয়েছে। যেমন শিয়ালকোট, নাগরকোট, গানদিকোট, মঙ্গলকোট, এমনকি কাশ্মীরের রামকোট। বাংলাদেশেও ‘কোট’ শব্দযুক্ত অনেক স্থান আছে। যেমন বিদ্যাকোট, চট্টগ্রাম জেলার কোটেরপাড়, নোয়াখালীর বীরকোট, সিলেটের বারকোট, নাটোরের আচিলকোট প্রভৃতি। লেখক বিনোদ বিহারী দত্তের মতে, ‘কোট’ শব্দের অর্থ দুর্গ (টাওন প্ল্যানিং ইন অ্যানশিয়েন্ট ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা-৫৩) তবে এই ‘কোট’ শব্দটির সম্পর্কে কিছুটা বাড়তি ধারণা দিয়েছেন চার্লস অ্যালেন তার The Buddha and Fuhrer গ্রন্থে। লেখক বলেন, ‘কোট’ শব্দটি দুর্গ বা টিলার জন্য প্রযোজ্য, যেখানে থাকে রাজ্যের রাজার বাসস্থান (পৃষ্ঠা-১৮৬)। আসলে ‘কোট’ শব্দটির অর্থ যে দুর্গ তৎসমর্থনে উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। 

কিন্তু প্রশ্ন আসে ‘রাম’কে নিয়ে। রামু উপজেলার এই রামকোট নামটাতে ‘রাম’ শব্দটা থাকার কারণে স্থানীয় একটি পক্ষ এই ‘রাম’ শব্দটাকে রামায়ণের রামচন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাবতে পছন্দ করেন। কিন্তু নিজেদের মতো করে ভাবলেই তো আর হবে না, ওই ভাবনার পেছনে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা ও প্রমাণ থাকতে হবে। বিষয়টি নিয়ে এ অধ্যায়ের শেষে কিছুটা আলোচনা করব। আগে রামকোট নামটিতে থাকা ‘রাম’ সম্পর্কে জানা দরকার। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ লেখক L.L.S. O’Malley Eastern Bengal Gazetteers, Chittagong গ্রন্থে কক্সবাজারে জন্মানো ‘রামকেলা’ নামের এক ধরনের বুনো কলা সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘রাম’ [Ram] শব্দটি সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ তথ্য দেন। তিনি বলেন, পাহাড়িরা ‘জঙ্গল’ বোঝাতে ‘রাম’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। Wild plantains [Ramkela, ram being the hillmen’s word for forest], several palms, [Ramgora] and the um, which is cultivated in Cox’s Bazar...।  ‘রাম’ শব্দের অন্য একটি অর্থ হচ্ছে, ‘অতিকায়’ বা ‘উৎকৃষ্ট’, সেই অর্থে ‘রামকোট’-এর অর্থ হয় অতিকায় দুর্গ বা উৎকৃষ্ট দুর্গ। রামু উপজেলার রামকোট নামক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি এখনো পাহাড়ি জঙ্গল বললেই চলে। শুধু তাই নয়, এই রামকোটেই ছিল আরাকানিদের একটি দুর্গ, যা ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মোগলরা জয় করেছিল। তাহলে ‘রামকোট’ নামটিতে আমরা একটি পাহাড়ি দুর্গ বা জঙ্গল দুর্গ সম্পর্কে ইঙ্গিত পাচ্ছি। ইতিহাসবিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া রামকোট বৌদ্ধবিহার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় এই দুর্গের অবস্থান ছিল বলে জানিয়েছেন। 

ইংরেজরা এ অঞ্চলের ক্ষমতা দখলের বহু আগে ১৫৮৩ থেকে ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণ করা রালফ ফিচ রামুকে ‘কিংডম অব রামে’ [Kingdom of Rame] বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ‘কিংডম অব রাং উ’ লেখেননি। মধ্যযুগে আরব দেশীয় লেখকদের লেখায়ও এ অঞ্চলে ‘জাজিরাত-আল-রামি’ [Jazirat-al-Rami] নামক এক রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, এই ‘রামি’ এবং রালফ ফিচের দেখা ‘রামে’ একই রাজ্য, যা আজকের রামু। অথচ তখন কিন্তু রামুতে ছিল বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী আরাকানিদের শাসন। রামুর নাম যদি সত্যিই ‘রাং উ’ হতো, তবে সেটা আরাকানিরা অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করত। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং ইতিহাসে দেখা যায় মধ্যযুগে অঙ্কিত দক্ষিণ এশিয়ার বেশকিছু মানচিত্রে রামুকে ‘রামে’, ‘রামা’ ও ‘রাম্ভু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই ‘রামা কোট’ অথবা ‘রামু কোট’ হতে ‘রামকোট’ শব্দটির উৎপত্তি হওয়াটা অসম্ভব নয়। 

রামকোট বিহার কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, বুদ্ধের বক্ষাস্থি রামুতে স্থাপিত হয়েছে ২৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে হিসেবে ‘রাং’ বা বক্ষাস্থি স্থাপনের কারণে রামুর নাম টলেমির মানচিত্রে ‘রাং উ’ হিসেবে থাকা উচিত ছিল। অথচ তার মানচিত্রে ‘রাং উ’ নামটি দূরে থাক ‘রামু’ শব্দটিরও কোনো অস্তিত্ব নেই, বরং এ এলাকাকে ‘বড়কুরা’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া মধ্যযুগে রামু ভ্রমণ করা ইউরোপীয় পর্যটক রালফ ফিচসহ ম্যানরিক, এবং তারও পরে ব্রিটিশ আমলে রেনেল, বুকানন এদের লেখায় ‘রাং উ’ শব্দটি আমরা অবশ্যই পেতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই রামুর আদিনাম হিসেবে ‘রাং উ’-এর ব্যবহার তাদের লেখা তো বটেই, অন্য কোনো ইতিহাসবিদের লেখায়ও চোখে পড়ে না। 

গৌতম বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় বিশেষ করে উত্তর ভারতের বাইরে অন্য কোথাও ভ্রমণ করেছেন মর্মে ঐতিহাসিক কোনো প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থি সম্পর্কে যে মতবাদ আমরা পাচ্ছি, তা এখনো পর্যন্ত কোনো অকাট্য ঐতিহাসিক উপাদান দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, বুদ্ধের বক্ষাস্থি নিয়ে এই একই গল্প রামুর রামকোটকে ঘিরে কখন তৈরি হলো? বহু ইতিহাসবিদ মনে করেন, প্রাচীনকালে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা তথা চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ রামুর সঙ্গে ‘মন’ নামক এক জাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জাতিটি প্রথমে মেকং নদীর অববাহিকায় বসতি গড়েছিল। পরবর্তীকালে তারা বর্তমানের মিয়ানমারের নিম্নাংশ এবং থাইল্যান্ড সীমান্তে ‘রমন্নাদেশা’ নামে একটি রাজ্য গড়ে তোলে, যার অন্য নাম সুবর্ণভূমি বা কিংডম অব গোল্ড। টলেমিসহ প্রাচীন ইউরোপীয় মানচিত্রকরদের অঙ্কিত কিছু মানচিত্রে এ সুবর্ণভূমির অবস্থান বর্তমানের মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মাঝামাঝি স্থানে দেখানো হয়েছে। ওই সব মানচিত্রে আজকের আরাকান পরিচিত ছিল রৌপ্য রাজ্য বা কিংডম অব সিলভার এবং এর পরই সুবর্ণভূমির অবস্থান। সেই হিসেবে প্রাচীনকালে আজকের মিয়ানমারের নিম্নাংশে ‘মন’ জাতির একটি রাজ্য ছিল। এ বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়। সুবর্ণভূমি পরবর্তীকালে পরিচিতি লাভ করে ‘রমন্নাদেশা’ বা ‘রমন্না’ নামে। বর্তমানে এটি মিয়ানমারের মন প্রদেশ নামে পরিচিত এবং থাটন হচ্ছে এই প্রদেশের একটি সমুদ্রবন্দর। এ সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে প্রাচীন ‘মন’ জাতি ভারত ও শ্রীলংকাসহ চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল, যার প্রমাণ ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। এই মন প্রদেশ থেকে মেকং নদীর অববাহিকায় প্রচলিত ‘বুদ্ধের বক্ষাস্থি’ গল্পটি বা ‘উরঙ্গধাতু উপাখ্যান’ শ্রীলংকাসহ ভারত তথা এ অঞ্চলেও প্রবেশ করতে পারে, সেটা অসম্ভব কিছু নয়। তাছাড়া ‘মন’ জাতির রমন্নাদেশার একটি কালচারাল আউটপোস্ট মনে করা হয় বর্তমান রামুকে। ইতিহাসবিদ হারুন অর রশিদ মনে করেন, প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার জনগোষ্ঠী এই ‘মন’ জাতির সংস্পর্শে ছিল। তার মতে আজকের রামু জনপদটি ‘মন’ জাতির দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত। সেই সূত্র ধরে গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থিকে কেন্দ্র করে মেকং নদীর অববাহিকায় সৃষ্ট হওয়া উরঙ্গধাতু উপাখ্যানটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের রামুতে প্রবেশ করতেই পারে। 

এবার আসি সম্রাট অশোক কর্তৃক রামকোট বৌদ্ধবিহার বা স্তূপ নির্মাণ প্রসঙ্গে। রামকোট বৌদ্ধবিহারের তোরণে ও বিহার প্রাঙ্গণে প্রদর্শিত তথ্য বিবরণীতে দেখা যায়, বিহারটি সম্রাট অশোক কর্তৃক ২৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার একই বিহারের আগের একটি তোরণে প্রতিষ্ঠার সন লেখা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০৮ অব্দ, যা বস্তুত ইতিহাস জ্ঞনের অভাব থাকারই প্রমাণ।

‘মহাবংশ’ এবং ‘দিব্যদান’ গ্রন্থ অনুসারে সম্রাট অশোক পাটালিপুত্রের [বর্তমান পাটনা, বিহার] সিংহাসন দখল করেন খ্রিস্টপূর্ব ২৭৪ অব্দে এবং এর চার বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ২৭০ অব্দে তার রাজ্যাভিষেক হয়। সম্রাট অশোকের তেরোতম শিলালিপিটি মূলত কলিঙ্গ যুদ্ধ সম্পর্কিত। এতে উল্লেখ আছে, সম্রাট অশোকের রাজ্যাভিষেক হওয়ার অষ্টম বছর পর তিনি কলিঙ্গ জয় করেন। তার মানে তিনি আনুমানিক ২৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কলিঙ্গ জয় করেন। কলিঙ্গ জয়ের দুই বছর পর অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। তার অষ্টম শিলালিপি থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, তিনি তার রাজত্বের দশম বছরে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। ইতিহাসবিদ রাধাকুমুদ মুখার্জির মতে, ২৬০ থেকে ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোক মহামানব গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন (Asoka, তৃতীয় সংস্করণ, পাটনা, ১৯৬২, পৃষ্ঠা ৪৪) এমনকি অন্যান্য ইতিহাসবিদ দ্বারা এটা সমর্থিত যে সম্রাট অশোক ২৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বুদ্ধগয়া ভ্রমণ করেন। সে হিসেবে সম্রাট অশোক আনুমানিক ২৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন, এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়। এক বা দুই বছর কম-বেশি হতে পারে, তবে তাতে তেমন কোনো সমস্যা দেখি না। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তো সম্রাট অশোক বৌদ্ধ স্তূপ বা চৈত্য নির্মাণ শুরু করেননি। তাহলে ২৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি রামুর রাংকুট চৈত্য বা রমকোট বৌদ্ধ স্তূপ প্রতিষ্ঠা করেন কীভাবে? তখন তো তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণই করেননি। 

এটা অনেকটাই নিশ্চিত যে চট্টগ্রামসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের রামু কখনো মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না। এ অঞ্চলে মহামতি সম্রাট অশোকের কোনো শিলালিপি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। আর নিজ সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে অশোক বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণ করেছেন, এমন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই বললেই চলে। ঐতিহাসিক কোনো উপাদান ছাড়া রামুর রামকোট বৌদ্ধবিহার বা চৈত্য সম্রাট অশোকের নির্দেশে নির্মিত হয়েছে, তেমনটা ভাবার চেয়ে এটি হরিকেল রাজ্যের অথবা আরাকান বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন—এ ইতিহাসই বেশি যৌক্তিক বলে মনে করছি এবং তাতে রামকোটের ইতিহাস এতটুকুও ক্ষুণ্ন হয় না। আগেই বলেছি, রামু তার নিজস্ব ইতিহাস দ্বারাই সমৃদ্ধ। 

লেখার শেষ পর্যায়ে রামকোটে রাম সীতার বিষয়টি নিয়ে খুব অল্প কিছু কথা বলব। কারণ, এ বিষয়ে বেশি কিছু বলার মতো আদৌ কোনো ঐতিহাসিক উপাদানের অস্তিত্ব নেই। এখানে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা বেশির ভাগই আরাকানি বৌদ্ধ সভ্যতার। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এটা বিশ্বাস করেন, বনবাসের সময় রাম সীতা এখানে এসেছিলেন। এখানে হিন্দু মন্দিরে আছে একটি প্রস্তর খণ্ড, যা দ্বারা সীতাদেবী বনবাসের সময় মরিচ মসলা পিষতেন বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয় হিন্দুরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়াসহ দেশের আরো কয়েকজন গবেষক প্রস্তর খণ্ডটি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং তারা নিশ্চিত হয়েছেন এটি আদৌ কোনো শিলপাটা নয়। বরং ওই প্রস্তর খণ্ডটিতে একসময় কিছু ছোট ছোট মূর্তি খোদাই করা ছিল, যা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘষেমেজে মসৃণ করা হয়েছে (বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, পৃষ্ঠা ৬৯৯)। তাছাড়া এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাম সীতার বনবাসের স্থান পঞ্চবটী বন ভারতের মহারাষ্ট্রে অবস্থিত। রামুতে রাম সীতার আগমনের তেমন কোনো যৌক্তিকতা নেই, যা ঐতিহাসিক উপাদান দ্বারা প্রমাণিত। 

রামুর প্রাচীনত্ব অনেকাংশে নির্ভর করে রামকোট এলাকার ওপর। কিন্তু রামকোট এলাকায় এখনো পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ না করার কারণে অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। রামুর ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া পাতাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রামকোটের পাহাড়ি জঙ্গলে। 

সহায়ক গ্রন্থ

১. Ghosh, Suchandra. The Trans Meghna Region: Making of Sub Regional Identity. Journal of Ancient Indian History, Vol.XXVII, University of Calcutta, Kolkata, 

২. Watters, Thomas. Yuan Chawng’s travels in India, Vol 2, edited by T.W Rhys Davids, & S.W Bushell, Royal Asiatic Society, London, 

৩. Chandra Sen, Benoy. The Antiquities of Some villages of Eastern Bengal. The Calcutta Review, vol.X. [May], Sanders & Cones, Calcutta, 

৪. Bhattacharya, Amitabha. Historical Geography of Ancient and Early Medieval Bengal, Sanskrit Pustok Bhander, Calcutta, 

৫. Luard, C. Echford. Travels of Fray Sebastien Manrique 1629-1643, Hakluyt Society, Oxford,

৬. Tylor, Isaac. Names and Their Histories, Second Edition, Rivingtons, London,

৭. O’Malley, L.L.S. Eastern Bengal Gazetteers, Chittagong, the Bengal Secretariat Book Deput. Calcuta,

৮. যাকারিয়া, আবুল কালাম মোহাম্মদ, বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, জ্ঞানবিচিত্রা প্রকাশনী, আগরতলা, ১৯৯৯,

৯. Yusuf Siddiq, Mohammad. Epigraphy and Islamic Culture, New York,

১০. Qanungo, Shuniti Bhushan. Chittagong under the Arakanese Regime. A History of Chittagong, Vol.I, Dipankar Qanungo, Chittagong,

১১. Strong, John S. Relics of the Buddha, Princeton 

University Press, New Jersy, USA,

১২. Martviset, Yoothapong. The Legendary of Urangadhatu: The Reflection of Cultural in Mekong Besin.

১৩. Rashid, Harun Er. Ancient Association between Bengal and Thailand. Journal of Asiatic society of Bengal, 

১৪. Mookherji, Radhakumud. Asoka, 3rd edition, Patna, 

১৫. জাহান, এমরান, রামুর বৌদ্ধ বিহার: একটি সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্লেষণ, চট্টগ্রাম পরিক্রমা, সংখ্যা তিন, জুন ২০১৬, পৃ. ৯৪

১৬. দাশগুপ্ত, কমলেশ, প্রাচীন চট্টগ্রাম ও সেকালের হিন্দু সমাজ, খড়িমাটি, চট্টগ্রাম, 

শিরুপন বড়ুয়া: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কক্সবাজার। ‘রামু: ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, জনশ্রুতি’ (জাগতিক প্রকাশন, ঢাকা) গ্রন্থের লেখক