বিশেষ সংখ্যা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ মার্চ রাত

মুহম্মদ আল মুখতাফি

ছবি : বণিক বার্তা

পরদিন শুক্রবার। ঢাকার রাস্তাঘাট ছিল অনেকটাই থমথমে। ঝড়ের আগে যেমনটা থমথমে থাকে, তেমন। অনেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সেটাই হলো। রাতের সে অন্ধকারের আড়ালে শহরে ছড়িয়ে পড়ে একদল ঘাতক সৈন্য। খুনের পরিকল্পনা নিয়ে অবস্থান নেয় পূর্ব নির্দেশনা মোতাবেক। সঙ্গে গোলন্দাজ, সাঁজোয়া, পদাতিক-তিন বাহিনী থেকে বাছাই করা তিন ব্যাটালিয়ন। তাদেরই প্রধান একটা অংশ এসে অবস্থান নিল ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে। তাদের নিশানা তাক করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুহূর্তেই শুরু হলো তাণ্ডব। মর্টার, মেশিনগানের শব্দে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। ভোরের আলো ফোটার আগেই যখন পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাকাণ্ড শেষ হয়, তখন চারদিকে গোরস্তানের নীরবতা। সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কেমন ছিল, তার বর্ণনা দিয়েছেন টিক্কা খানের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক। তিনি তার ‘উইটনেস টু স্যারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলো জরিপ করছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩-১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিল। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা। কিন্তু কোনো অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিল না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ওই অভিযানের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে স্তব্ধ করে দেয়া। আর তাদের প্রধান তিন লক্ষ্যবস্তুর একটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য দুটি লক্ষ্যবস্তু পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন। অভিযানে ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপ, ভারী মর্টার, হালকা মেশিনগানসহ নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্র-শিক্ষক-কর্মীদের বিরুদ্ধে। হত্যা করা হয়েছে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে। তারপর বেশির ভাগ মরদেহ গণকবর দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালিয়ে মাটি সমান করে দেয়া হয়েছে। আবার অনেক মরদেহ উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে। সে রাতে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও হয়নি। বিশদ গবেষণাও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ১৯৫ জনের নাম আছে, যাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে আসা অনেককে হত্যা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫০-৩০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেসের সংলাপেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে।

পাকিস্তানি সৈন্যদের গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট ছিল ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোয় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো এ হল থেকে। একরাশ ক্রুদ্ধতা নিয়ে অন্ধকারের বুক চিড়ে অবিরাম বুলেট, কামান, গ্রেনেড ছুড়ছিল তারা। চারদিকে তখন মৃত্যু আর মানুষের আর্তনাদ। টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং ওই ঘটনার দুদিন পর ইকবাল হলে ঢুকেছিলেন। তিনি সেখানে নিজে ৩০টি মরদেহ গুনে দেখেছিলেন। তার মতে, সেদিন মর্টারের শেল আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিতে শুধু ইকবাল হলেই নিহত হয়েছিলেন ২০০ নিরপরাধ ছাত্র। হামলার দুদিন পরও দেখা যায় পুড়ে যাওয়া রুমের মধ্যে পড়ে থাকা অগণিত মরদেহ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি হত্যাকাণ্ডের বড় অংশটাই ঘটে মূলত জগন্নাথ হলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বইয়ে ড. রতনলাল চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ভোর হবার পূর্ব পর্যন্ত পাকবাহিনী জগন্নাথ হলের কোনো ভবনেই প্রবেশ করেনি। সকালবেলা হলের তালা ভেঙে তারা প্রথমেই হত্যা করে দারোয়ানদের। ভারি বুটের শব্দ, গ্রেনেডের বিস্ফোরণ এবং গুলির আওয়াজে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। তল্লাশি চালিয়ে যাকে যেখানে পাওয়া হয়, হত্যা করা হয়। রতনলাল চক্রবর্তীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা: ১৯৭১ জগন্নাথ হল বইয়ে লিখেছেন, ‘‌জগন্নাথ হলে সে রাতে গণহত্যার শিকার হয়েছিল চার শিক্ষক, ৩৬ ছাত্র এবং ২১ কর্মচারী ও অতিথি। পাকসেনারা জগন্নাথ হলের সব ভবনেই আক্রমণ চালায়।’ সে সময় অ্যাসেম্বলি ভবনের পূর্ব অংশে প্রাধ্যক্ষের কার্যালয় ও আবাসিক শিক্ষকদের বাসস্থান ছিল। পশ্চিম অংশে ছিল ছাত্রদের আবাসিক কক্ষ। সে রাতে অ্যাসেম্বলি ভবন আক্রান্ত হলে হানাদাররা অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে ধরে ফেলে। এর মধ্যে টিনশেড ছাত্রাবাস দুটি ও ক্যান্টিনে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলে বস্তিবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সলিমুল্লাহ হলের ভাগ্যও ইকবাল হল আর জগন্নাথ হলের থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। তবে সেখানে ছাত্রদের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে খুবই কম। বিভিন্ন রুম থেকে খুঁজে খুঁজে ১১ ছাত্রকে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। রক্তে রঙিন হয়ে উঠেছিল সবুজ ঘাস। সলিমুল্লাহ হলের শহীদ ছাত্রদের পঁচা-গলা বিকৃত মরদেহ চার-পাঁচদিন পর ঢাকা পৌরসভার সুইপাররা তুলে নিয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গর্ত করে একত্রে কবর দেয়। একই রাতে আক্রান্ত হয় ঢাকা হল বা তৎকালীন শহীদুল্লাহ হল। সে রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া গোলায় সরাসরি নিহত হন দুই আবাসিক শিক্ষক শরাফত আলি ও আতাউর রহমান খান খাদেম। ২৯ মার্চ ঢাকা হল থেকে চারটি মরদেহ নিয়ে যায় সুইপাররা। বাকি দুটি ছিল দুজন ছাত্রের। এদিকে রোকেয়া হলও সেদিন রেহাই পায়নি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রোকেয়া হলে কী ঘটেছিল, সে ব্যাপারে ঢাকার সে সময়ের মার্কিন কনসাল জেনারেল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি প্রতিবেদন পাঠান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের একটি কক্ষে ছয়টি মেয়ের মরদেহ পা-বাঁধা ও নগ্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। এছাড়া রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় হলের কর্মচারী আহমেদ আলী, আবদুল খালেক, নমি, মো. সোলায়মান খান, মো. নুরুল ইসলাম, মো. হাফিজুদ্দিন ও মো. চুন্নু মিয়াকে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ঢুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেখানকার চার কর্মচারী ও ফজলুল হক হলের সাতজন ছাত্রকে হত্যা করে। সূর্য সেন হলের তৎকালীন নাম ছিল জিন্নাহ হল। জিন্নাহ হল ও মহসীন হলের ছাত্রসংখ্যাও ছিল কম। এ দুই হলে পাকিস্তানি বাহিনী এসেছিল ২৬ মার্চ সকাল ১০টার পরে। সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, সলিমুল্লাহ হল ও ঢাকা হলে অনেক সময় লেগেছিল; সেজন্য মুহসীন হল ও জিন্নাহ হলে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তার পরও হল দুটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কক্ষগুলো তল্লাশি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। তার কারণে বেশ কয়েকজন শহীদ হন। এ দুই হলে নিহত ছাত্রদের মরদেহ তারা গাড়িতে করে নিয়ে যায়। ঢাকা পৌরসভার সুইপারের বয়ানে রোকেয়া হল, ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ হল ও শিববাড়ি কোয়ার্টার থেকে পঁচা-গলা মরদেহ তোলার কথা বলা হয়েছে। তবে মুহসীন হল, সূর্য সেন হল ও ফজলুল হক হলের কথা বলা হয়নি। এর বাইরে ২৬ মার্চ সকালে গুরুদুয়ারা নানক শাহী, শিব ও কালীমন্দিরে ঢুকে সেখানকার পুরোহিতদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৭ মার্চ রমনা কালীমন্দিরে ২৭ জনকে হত্যা করা হয়েছিল।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারীদের গণহত্যার ঘটনার নজির নেই। মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ঢুকে যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়, তা ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে রেখেছে। নিরস্ত্র, নিরীহ জনগণকে হত্যা করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনমানবশূন্য ভূমি তৈরি করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বাংলার বুক চিতিয়ে হানাদারদের কবল থেকে দেশমাতৃকাকে কেবল মুক্তই করল না, পাকিস্তানি নরাধমদের মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণে বাধ্যও করেছিল। কালরাতের সে নির্মম গণহত্যা বাঙালিকে একদিকে যেমন পীড়িত করে, অন্যদিকে তেমন উদ্দীপ্ত করে সামনের পানে ছুটে যেতে।


মুহম্মদ আল মুখতাফি: লেখক