শহীদ চান্দু ক্রিকেট স্টেডিয়াম

মুশফিকদের শহরে চার-ছক্কার উৎসব কবে?

এইচ আলিম, বগুড়া

বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম। ২০০৬ সালে এ মাঠে পাঁচটি ওয়ানডে ও একটি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেও দীর্ঘ ১৮ বছর কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়নি ছবি: ফেসবুক

২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে লাল-সবুজের উৎসব হলো। তখনকার ক্রিকেট পরাশক্তি শ্রীলংকাকে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে উইকেটে হারিয়ে দিল হাবিবুল বাশারের বাংলাদেশ দল। মোহাম্মদ আশরাফুলের ফিফটি (৫১) ভিত গড়ে দেয়ার পর বাশার আফতাব আহমেদের ব্যাটে ভর করে ২১৩ রানের টার্গেট ছুঁয়ে ঐতিহাসিক জয় তুলে নেয় স্বাগতিকরা। ১৯৮৬ সাল থেকে টানা ১৫ হারের পর প্রথমবারের মতো ওয়ানডে ম্যাচে শ্রীলংকাকে হারায় টাইগাররা।

খালেদ মাসুদ পাইলটের ব্যাট থেকে জয়সূচক রান আসার পরই মাশরাফি বিন মর্তুজা, অধিনায়ক বাশার, মোহাম্মদ রফিক, শাহরিয়ার নাফিসরা ড্রেসিংরুম থেকে দৌড়ে মাঠে প্রবেশ করে সতীর্থদের সঙ্গে জয়োৎসব করেন। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তখন লাল-সবুজের ঢেউ। উৎসব যেন শেষই হতে চাচ্ছিল না। উৎসবের ঢেউ লাগে গোটা দেশে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সেদিন ক্রিকেট পিপাসু মানুষ নাচে-গানে জয়োৎসব করেন।

সেই ক্রিকেট উন্মাদনার স্মৃতিচারণ করে বগুড়ার ক্রিকেটার মাইশুকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি অনূর্ধ্ব-১৩, অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলে খেলেছি। ২০০৬ সালে বগুড়ায় বাংলাদেশ শ্রীলংকার ওয়ানডে ম্যাচের সময় আমি বয়সভিত্তিক দলে খেলি। আমার মনে পড়ে, বাংলাদেশের জয়ের দিন মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ ছিল এবং বাইরে অনেক দর্শক ছিল, যারা ভেতরে ঢুকতে পারেনি। তখন ক্রিকেটের দারুণ একটা পরিবেশ ছিল। নিজের এলাকায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়ের সাক্ষী হতে পেরে ছেলেরা ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছিল, তেমনি অভিভাবকরাও সন্তানকে ক্রিকেটে দিতে দ্বিধা করেননি। এটা মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে, স্বপ্ন দেখায়। তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল একদিন জাতীয় দলে খেলব। এখনো জাতীয় দলে খেলার আশা করে যাচ্ছি।

মাইশুকুর জাতীয় দলে সুযোগ না পেলেও বগুড়ার রয়েছে গর্ব করার মতো প্রতিনিধি। বগুড়ার ছেলে মুশফিকুর রহিম মিতু, তাওহীদ হৃদয়, তানজিদ হাসান তামিমরা আজ বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাতাচ্ছেন। ভিন্ন ফরম্যাটে তারা জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ। অথচ বগুড়াবাসী তাদের ঘরের মাঠে ঘরের ছেলেদের খেলা দেখতে পায় না। শহীদ চান্দু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয় না সেই ২০০৬ সাল থেকে। মুশফিক, তাওহীদরা মাঠে চার-ছক্কায় দর্শকদের মাতোয়ারা করবেন অপেক্ষায় আছেন বগুড়াসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলের মানুষ।

রাজনৈতিক রোষানলের শিকার হয়ে ২০০৬ সাল থেকে পতিত পড়ে আছে দেশের অন্যতম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আবার আশা জেগেছে। মাঠে আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের বল গড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন উত্তরের ক্রিকেটপ্রেমীরা।

পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে বগুড়া শহরে নির্মিত হয় শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম। ১৯৭০ সাল থেকে ফুটবল, ক্রিকেটসহ স্থানীয় বিভিন্ন টুর্নামেন্টের খেলা হতো স্টেডিয়ামে। ২০০৩ সালে প্রথমবার স্টেডিয়ামটির ক্রীড়া কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এক বছর পরই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় স্টেডিয়ামে কার্যক্রম। আইসিসির স্বীকৃতি পাওয়ার পর সেখানে একটি টেস্ট পাঁচটি ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে এখানে বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দীর্ঘ হাহাকার।

বগুড়ার ক্রীড়া সংগঠকরা বলছেন, আরাফাত রহমান কোকোর হাতে গড়া বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম গত ১৮ বছর ছিল অবহেলিত। স্টেডিয়ামটি শুধু রাজনৈতিক কারণে প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। মাঠের উইকেট অত্যন্ত ভালোমানের হওয়ার পরও বিসিবির নেতারা মাঠটি থেকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ সরিয়ে নিয়ে যায়। বগুড়া থেকে আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বীকৃতি তুলে নেয় আইসিসি। ধীরে ধীরে বগুড়ার জায়গা নেয় সিলেট। ম্যাচ না থাকায় সংস্কারসহ অবকাঠামোর কোনো উন্নয়নও করা হয়নি। লাখ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখা হয়েছে। ফ্লাডলাইট স্ট্যান্ড থেকে দামি লাইটগুলোও খুলে নেয়া হয়েছে।

প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্টেডিয়ামটি ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ম্যাচ দিয়ে যাত্রা বগুড়ার স্টেডিয়ামটির। আইসিসির স্বীকৃতি পাওয়ার পর একটি টেস্ট পাঁচটি ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। একমাত্র টেস্টে শ্রীলংকার কাছে ১০ উইকেটে হেরেছে বাংলাদেশ। পাঁচ ওয়ানডের মধ্যে চারটি জয় একটি হার দেখেছে স্বাগতিকরা। ওয়ানডেতে শ্রীলংকার কাছে এক ম্যাচে হারের পর তাদেরও হারের স্বাদ দেয় টাইগাররা। এছাড়া মাঠে জিম্বাবুয়েকে দুই ম্যাচে কেনিয়াকে এক ম্যাচে হারায় বাংলাদেশ। সেই থেকে ১৮ বছর মাঠে চার-ছক্কার উৎসব হয় না।

যেন স্রোতহীন মরা গাঙ। আন্তর্জাতিক ম্যাচ না হওয়ায় পরিচর্যা নেই। মাঠের অবস্থা বেশ জীর্ণ। আউটফিল্ড, পিচ, ইনডোর, জিমনেশিয়াম এখন প্রায় অকেজো। সবকিছুরই সংস্কার করা প্রয়োজন। স্টেডিয়ামের সঙ্গে নির্মাণ করা সুইমিংপুলটি মাঝে কয়েকবার চালু হলেও প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাঠে কুচকাওয়াজ, বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান পালন করা হয়েছে, শুধু ক্রিকেটটাই হয়নি। পরে জেলা ক্রীড়া সংস্থা অলিখিত একটি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক নির্বাহী সদস্য ক্রীড়া সংগঠক অ্যাথলেট শাজাহান আলী বাবু বলেন, ‘বগুড়ার স্টেডিয়াম থেকেই উঠে এসেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অন্যতম ক্রিকেটার মুশফিকুর রহীম, তাওহীদ হৃদয়, তানজিদ তামিম, শফিউল ইসলাম সুহাস। সঙ্গে রয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী ক্রিকেটার। সবাই সুনামের সঙ্গে জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করছেন। বগুড়া থেকে জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য ক্রিকেটার, ফুটবলার তৈরি হয়েছে। অথচ সেই বগুড়াকে জাতীয় পর্যায়ে রাখা হয়েছিল অবহেলিত করে। দীর্ঘদিন অবহেলায় থাকা স্টেডিয়ামকে সংস্কার করার মতো অর্থ নেই। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া, সুইমিংপুল বন্ধ, ইনডোরের অবস্থা খুবই খারাপ, পিচ ঠিক থাকলেও এর আউটফিল্ড ঠিক নেই। স্টেডিয়ামের পূর্ণাঙ্গভাবে মেরামত করতে হবে। শুধু প্রতিহিংসার কারণে আধুনিক স্টেডিয়ামটি নষ্ট করা হয়েছে। স্টেডিয়ামটি সংস্কার করে আবারো আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সবাই মিলেই চেষ্টা করব। আগামী দিনে আরো ভালো খেলোয়াড় যাতে তৈরি হয় সে বিষয়ে কাজ করে যাব।

বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বগুড়ার একঝাঁক ক্রিকেটার আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনামের সঙ্গে খেলে জাতীয় ক্রিকেট দলে অবদান রেখে যাচ্ছেন। ঢাকার বাইরে যেসব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম আছে তার মধ্যে বগুড়া উল্লেখযোগ্য। বগুড়ার আবাসন ব্যবস্থাও উন্নত। আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-মোটেল রয়েছে। বগুড়ায় যোগাযোগ সুবিধাও ভালো। তারপরও বগুড়ার স্টেডিয়ামকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বঞ্চনার শিকার হয়ে এসেছে। আগামীতে আমরা মাঠে আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের জন্য যা যা করণীয় তার সবই করব।

ক্ষোভ প্রকাশ করে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের ভেন্যু ম্যানেজার জামিলুর রহমান বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের একমাত্র টেস্ট ভেন্যু হলো বগুড়া। এখানে উন্নতমানের উইকেট থাকায় ভালো কিছু হওয়া সম্ভব। তবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অবকাঠামোগত জটিলতা দেখা দিয়েছে। কিছু ভবন গ্যালারির সংস্কার করা অত্যন্ত প্রয়োজন। মাঠের পানি নিষ্কাশনের জন্যও কিছু কাজ করতে হবে। সংস্কার করা হলেই এটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের উপযোগী হয়ে উঠবে।

ক্রিকেটার মাইশুকুর অভিযোগের সুরে বলেন, ‘শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম তো আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম ছিল এবং সেখানে আন্তর্জাতিক খেলাও হয়েছে। এখানের উইকেটও বাংলাদেশের কয়েকটি ভালো উইকেটের মধ্যে অন্যতম। সেরা উইকেট। মাঠটাও। এখানে খেলা থেকে বঞ্চিত করে রাখা মানে ওরা ক্রিকেটটাকেও বঞ্চিত করে রাখছিল। ক্রিকেট যেন এগোতে না পারে, আমাদের অঞ্চলভিত্তিক যেন ডেভেলপ না করতে পারে এবং এখান থেকে যেন ক্রিকেটাররা না উঠে আসে। যখন কোনো আন্তর্জাতিক খেলা হয় তখন ওই এলাকায় খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়ে, একটা উন্মাদনা তৈরি হয়। একে ঘিরে নতুন নতুন সংগঠক তৈরি হয়, খেলোয়াড়রাও আগ্রহী হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, ‘স্টেডিয়ামটা তো জাতীয় সম্পদ। খেলাটাও গণমানুষের। এটাকে নষ্ট করে আমাদের পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খেলার প্রতি যারা আগ্রহ প্রকাশ করত পরে কিন্তু তারা সেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন