জুলাই-আগস্ট আন্দোলন

স্বাভাবিক জীবনে কবে ফিরতে পারবেন জানেন না হাসপাতালে চিকিৎসাধীনরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অনেকেই এখনো শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট বগুড়া সদর থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন শহরের নারুলীর মো. শামীম (৩৮)। শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে ওইদিন মিছিল নিয়ে শহরের মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হন বেশ কয়েকজন। তাদের উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আহত অনেকেই এরই মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তবে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শামীম। 

অনেক গুলি লেগেছে শামীমের দুই পায়ে। কোনো রকমে হাঁটতে পারলেও ভর দিতে হয় লাঠিতে। মাঝে মাঝে অবশ হয়ে যায় তার পা। ব্যথায় ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেন না। এখনো গুলির মতো কোনো শব্দ শুনলে ভয়ে আঁতকে ওঠেন। তবে সব ভয় কাটিয়ে মুক্ত বাতাসে হাঁটতে চান এ যুবক। 

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসাসেবা দিতে সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছে চীনের একটি মেডিকেল টিম। এরই মধ্যে তারা দেড় শতাধিক রোগীর চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাতে তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বলে গতকাল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) ড. শাহ্ মো. হেলাল উদ্দীন। 

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দলটি বাংলাদেশে এসেছে ২২ সেপ্টেম্বর। কাজ শুরু করেছে ২৩ সেপ্টেম্বর। এ সময়ের মধ্যে তারা ১৬০ রোগী পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর মধ্যে ১০৫ রোগীর মেডিকেল রেকর্ডস পরীক্ষা করেছেন তারা।

শাহ্ মো. হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘চীনের রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আহতদের জন্য মেডিকেল টিম গঠন করে চীন সরকার। আর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ টিমকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে তারা। এটা অসাধারণ একটা ব্যাপার। চীনের মেডিকেল টিমের সদস্যরা এ সীমিত সময়ের মধ্যে পাঁচটি হাসপাতাল ভিজিট করেছেন। তারা রোগীদের দেখে চিকিৎসার ব্যাপারে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া রোগীদের কয়েকজনের অবস্থা খুবই গুরুতর বলেও জানিয়েছেন তারা।’  

চীন থেকে আসা টিমটি মূলত একটি অ্যাসেসমেন্ট টিম বলে জানান শাহ্ মো. হেলাল উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘তারা গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট পাঠাবেন। গুরুতর আহত রয়েছেন তিনজন। এর মধ্যে দুজন আইসিইউতে আছেন। একজন চোখে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। নার্ভ ইনজুরড কিছু রোগী রয়েছেন। তাদের ব্যাপারে আমাদের প্রাথমিক চেষ্টা থাকবে যাতে বাংলাদেশে সুচিকিৎসা করা যায়। চীনের মেডিকেল অ্যাসেসমেন্ট টিমের রিপোর্ট দেখে তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নেব। আমরা চেষ্টা করছি চাইনিজ এক্সপার্টদের দেশে এনে আহতদের চিকিৎসা দেয়ার। আমাদের প্রয়োজনীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতি বা দক্ষতার ঘাটতি থাকলে তাদের বিদেশে পাঠানোর চিন্তাভাবনাও করছি। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আন্তরিক।’

তিনি জানান, গণ-অভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং তাদের চিকিৎসা আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুযায়ী হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছে চীন থেকে আসা মেডিকেল টিম। বিদেশী চিকিৎসকদের ওই দল চিকিৎসায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসক ও যন্ত্রাংশের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে কিনা তাও পর্যালোচনা করেছেন চীনের চিকিৎসকরা। এক্ষেত্রে অনেক জায়গায় কিছু ঘাটতি আছে বলে উল্লেখ করেন ড. হেলাল উদ্দীন।

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই আন্দোলনে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুরুতে এ আন্দোলন অহিংস ছিল। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেপরোয়া হলে ১৫ জুলাই থেকে আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। কেউ হয়েছেন চিরতরে পঙ্গু, কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। বগুড়ার শজিমেক হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন ২৪ জন। শরীরের বিভিন্ন স্থান তাদের গুলিবিদ্ধ। অনেকের চোখে গুলি লেগেছে, ঠিকমতো দেখতেও পারছেন না। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় দিন গুনছেন তারা। 

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে সাতজন নিহত হন বগুড়ায়। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন চার শতাধিক। সবচেয়ে বেশি ভর্তি হন ৪ আগস্ট। এদিন আহতদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে চিকিৎসকদের। আহতদের মধ্যে কেউ কেউ কয়েক দিন ভর্তিও ছিলেন। কারো কারো করতে হয়েছে অস্ত্রোপচার। তাদের অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। বর্তমানে শজিমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের কারো পায়ে, হাতে, বুকে ও মাথায় এখনো অনেক গুলি রয়ে গেছে। কারো দেহে রয়েছে শতাধিক রাবার বুলেট বা ছররা গুলির ক্ষত।

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থানার সামনে ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন কাহালু উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামের হেলালুর রহমান (৩০)। এর পর থেকে শজিমেক হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তবে অবস্থার অবনতি হলে ২১ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বগুড়া প্রতিনিধি এইচ আলীম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন