পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতায় ডুবছে খুলনার নিম্নাঞ্চল

শুভ্র শচীন, খুলনা

জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ডুমুরিয়া উপজেলা। এ অঞ্চলের মাছের ঘের ও ফসলের খেত এখনো তলিয়ে রয়েছে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

খুলনায় আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ৬৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৫৪ মিলিমিটার। বৃষ্টির পানি মূলত খাল দিয়ে নদ-নদীতে চলে যায়। তবে জেলার বেশির ভাগ খাল দখল-দূষণে নাব্য হারিয়েছে। পলি জমেছে নদ-নদীতে থাকা জলকপাটে। ফলে দ্রুত সময়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এ কারণে অতিবৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চলে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ডুমুরিয়া উপজেলা। গুটুদিয়া, রংপুর, খর্ণিয়া, রঘুনাথপুর, ধামালিয়া, আটলিয়া ও মাগুরাঘোনা ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম এখনো জলাবদ্ধ। এসব গ্রামের মানুষের থাকার জায়গা নেই, রান্না করার জায়গা নেই। পুকুর, মাছের ঘের, ফসলের খেত সবই তলিয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৪৫ হেক্টর জমির ফসল। শুধু ডুমুরিয়া নয়, এখনো তলিয়ে রয়েছে ফুলতলা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার শতাধিক গ্রাম। বাড়ির আশপাশ ও সড়ক ডুবে থাকায় এসব গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ ভোগান্তি পোহাচ্ছে। অনেক পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।

সরজমিনে দেখা গেছে, ডুমুরিয়া উপজেলার সাড়াভিটা নরেন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথ, খেলার মাঠ, সামনে থাকা মন্দির, শহীদ চত্বরসহ সবখানেই পানি। সড়ক ও মাঠের পানিতে চলছে ডিঙি নৌকা। চাকরি বাঁচাতে এর মধ্যেই এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নৌকায় আসা-যাওয়া করছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপংকর সরকার বলেন, ‘তিন বছর আগেও উপজেলার শৈলমারী জলকপাট দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো। তবে খালগুলো দখল হওয়ায় পানি প্রবাহের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের চারদিকে পানি। এখন নৌকা আমাদের একমাত্র ভরসা। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে জানিয়েও কোনো সমাধান হয়নি।’

খুলনার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৪২৭টি খাল রয়েছে। এর মধ্যে ভরাট ও সরু হয়ে নাব্য হারিয়েছে ২৭২টি। এছাড়া ইজারা দেয়া ১১৬টিতে নেট-পাটা ও বাঁধ দিয়ে চলছে মাছ চাষ। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির প্রবাহ। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। পানিবন্দি হচ্ছে আশপাশের শত শত মানুষ।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতির ২১ ধারা অনুযায়ী বন্দোবস্ত করা বা ইজারা নেয়া জলমহালের কোথাও প্রবহমান প্রাকৃতিক পানি আটকে রাখা যাবে না। এরপরের ধারায় আছে, যেসব জলমহাল থেকে (নদী, হাওর ও খাল) জমিতে সেচ দেয়া হয়, সেখান থেকে সেচের মৌসুমে পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। তার পরও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সুপারিশে তাদের অনুসারীরাই এসব খাল ইজারা পান। ইজারার পর খাল দখলে নিয়ে সহ-ইজারাদার নিয়োগ দেয়া হয়। তারা ইজারার শর্ত ভেঙে খালে বাঁধ নির্মাণ ও বাঁশের বেড়া দিয়ে মাছ চাষ করছেন। এতে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও গ্রীষ্ম মৌসুমে সেচ দিতে না পারায় কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি খালে কোনো অবস্থাতে বাঁধ কিংবা নেট-পাটা দিয়ে পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুযোগ নেই। জেলার জলাশয়গুলো মুক্ত রাখতে দ্রুত উচ্ছেদ অভিযানের পাশাপাশি ইজারা বাতিল করতে কমিটি গঠন করা হবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে ৪৮৬টি জলকপাট রয়েছে এর মধ্যে একেবারেই অকার্যকর ৭০টি। আরো শতাধিক জলকপাট কখনো কাজ করে, আবার কখনো করে না। কার্যকর থাকা জলকপাটগুলো নিয়মিত পরিচালনাও করা হয় না। পলিও অপসারণ করা হয় না। ফলে এসব জলকপাট দিয়ে পানি নিষ্কাশন ও নিয়ন্ত্রণ না করতে পারায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে ১১টি নদ-নদী বয়ে গেছে। এসব নদ-নদীর সঙ্গে যুক্ত খালে ৭৫টি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে জলকপাটগুলোর ২৩টি একেবারে অকেজো হয়ে পড়েছে। ১১টি আংশিক কাজ করে। আর ২০টির মতো জলকপাটের মুখ পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। বাকি ২১টি সচল থাকলেও সেগুলো খুব একটা কাজে আসছে না।

এ ব্যাপারে ডুমুরিয়া উত্তরাঞ্চল বিল রক্ষা সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক জিএম আমানুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শৈলমারী রেগুলেটরের আওতায় ডুমুরিয়ার বিল ডাকাতিয়াসহ ছোট-বড় ২৪টি বিল রয়েছে। যার অধিকাংশই জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিল ডাকাতিয়ার যশোর অংশে পাম্প বসিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। একইভাবে খুলনা অংশে বিল বাঁচাতে দ্রুতই বড় পাম্প বসিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। শৈলমারী রেগুলেটরের ওপর পাম্প বসাতে হবে। এছাড়া মধ্যমমেয়াদি পরিকল্পনায় দুটি ড্রেজারের একটা শৈলমারী রেগুলেটরের সামনে, অন্যটি গ্যাংরাইল নদীতে থাকবে। এতে নদীর নাব্য ঠিক থাকবে ও রেগুলেটরের সামনে পলি জমবে না। পরে দীর্ঘমেয়াদে হামকুড়া ও হরি নদী খনন করতে হবে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড বাস্তব অবস্থা না বুঝে প্রকল্প নেয়ায় জটিলতা তৈরি হয়।’

ডুমুরিয়া উপজেলাটি পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ-১-এর আওতায়। ওই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান তাজকিয়া বলেন, ‘জলকপাট দিয়ে পানি সরতে না পারায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। যেসব জলকপাটের সামনের অংশ পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে, সেগুলো সচল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন