জেটনেট-বিডি’র যাত্রা শুরু

ছবি : বণিক বার্তা

জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (জেটনেট-বিডি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, ন্যায্য এবং টেকসই জ্বালানি ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আজকের দিনটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ৭০টিরও বেশি নাগরিক সংগঠন (সিএসও), দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, স্থানীয় সংগঠন, জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধির সমন্বয়ে জেটনেট-বিডি আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর ও পরিবেশ সুরক্ষায় এই নেটওয়ার্ক সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করবে। জেটনেট-বিডি’র সদস্যদের পাশাপাশি দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত হচ্ছে একটি উপদেষ্টামণ্ডলী, যাদের দিক নির্দেশনায় এগিয়ে যাবে নেটওয়ার্কটি। একইসাথে জেটনেট-বিডি’র গঠন প্রক্রিয়ায়, ১৫০টিরও বেশি নাগরিক সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ১৪ দফা দাবি সম্বলিত ‘বাংলাদেশে ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর: নাগরিক দাবি’ পুস্তিকার মোড়ক উন্মোচন করা হবে।  

জেটনেট-বিডি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের ন্যায্য এবং টেকসই জ্বালানি ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু সহিষ্ণু নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালনে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ।

বাংলাদেশে ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর: নাগরিক দাবি

> ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজসহ সকল অংশীদারের সমন্বয়ে বিদ্যমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি ও পরিকল্পনার অসামঞ্জস্যতা সংশোধনপূর্বক ‘জাতীয় জ্বালানি রূপান্তর নীতিমালা’ প্রণয়ন করতে হবে। উক্ত ‘জাতীয় জ্বালানি রূপান্তর নীতিমালা’ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন এবং এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে । 

> প্রস্তাবিত ‘জাতীয় জ্বালানি রূপান্তর নীতিমালা’র ভিত্তিতে, ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনি কাঠামো ও বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে। একই সাথে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে মোট ব্যবহার্য জ্বালানির ৩০ শতাংশ, ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য ও সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। 

> বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে প্রতিযোগিতামূলক ও সাশ্রয়ী বাজার তৈরিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও টেকসই জ্বালানি বাজার তৈরি ও সুনির্দিষ্ট গণ-ক্রয়সংক্রান্ত কাঠামো/নীতিমালা প্রয়োগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ বাতিল অথবা যথাযথ সংস্কার করতে হবে। একইভাবে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জনস্বার্থ উপেক্ষাকারী ও আন্ত:দেশীয় কর্পোরেট স্বার্থ সংরক্ষণকারী যে কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি (যেমন- ‘এনার্জি চার্টার ট্রিটি’) স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকতে হবে। 

> ২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে ৫,০০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য ২০২৭ সালের পর থেকে নতুন কোন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বন্ধ করা, ২০২৭ সালের মধ্যে বিদ্যমান কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বন্ধ করা এবং পাইপলাইনে থাকা নতুন কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো ‘নো কোল পলিসি’র আওতায় বাতিল করার লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ২০২৭ সালের মধ্যে ডিজেল-চালিত সেচ পাম্পের ৪০% সৌর-ভিত্তিক পাম্পে রূপান্তর নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্যাপটিভসহ এইচএফও-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর ৬০% বন্ধ করতে হবে। 

> বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন ২০০৩’ পরিমার্জন করে বিইআরসি’কে একটি স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সক্ষম শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।

> বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাত উন্নয়নে প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগ ও বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রতিযোগিতাবিহীন যে কোনো বিনিয়োগ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে, সরকারকে পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশসহ একটি ওয়ান-স্টপ বিনিয়োগ পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে।

> সমানাধিকার ও সহযোগিতার নীতিতে এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবুজ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি সহজলভ্য করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পক্ষসমূহের সাথে প্রযুক্তি বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি মন্ত্রণালয় হিসেবে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)’র উন্নয়ন ঘটাতে হবে।  

> জ্বালানি আমদানি চাহিদা ন্যূনতম ১০ শতাংশে হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে একই নীতির উপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

> বিদ্যুৎ ও জ্বালানি স্বনির্ভরতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে বিদ্যমান বৃহৎ অবকাঠামোভিত্তিক ও কর্পোরেট নির্ভর মডেলের আমূল সংস্কার করতে হবে এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও  ভৌগোলিক স্বতন্ত্রতা বিবেচনায় রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ী গ্রাম ও এলাকাভিত্তিক সমাজ নির্ভর মডেল গড়ে তুলতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ক্রমে সরে আসা ও বায়ু দূষণ রোধে ন্যায্য কার্বন-কর আরোপ করতে হবে। তাছাড়া দেশব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাব্য উৎস ও বিকাশের ক্ষেত্র যাচাইকরণ এবং এই লক্ষ্যে অর্থায়নের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। 

> বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনসহ অন্যান্য অবকাঠামো আধুনিকায়নের পাশাপাশি নেট মিটারিং ব্যবস্থা সহজলভ্য করতে হবে, যাতে করে ব্যক্তি ও সমবায়গতভাবে সকল গ্রাহক সহজেই এ সুবিধা নিতে পারে।

> বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে কৃষি ও পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ করতে হবে। ভূমি অধিগ্রহণের আগে বিকল্প উৎস যেমন, বাড়ির ছাদ, পতিত ও অব্যবহৃত জায়গা ইত্যাদির কার্যকরী ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে কৃষিজমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমি মালিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ওই জমি থেকে কৃষক ও জাতীয় অর্থনীতি ভবিষ্যতে যে পরিমাণ আয়ের সুযোগ হারাবে তা বিবেচনায় নিয়ে কৃষক ও জাতীয় কৃষি ব্যবস্থাপনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

> বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই খাতে নারীদের সুনির্দিষ্ট চাহিদা মূল্যায়নপূর্বক নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যকরী প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর প্রকল্পের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের উপর জোর দিতে হবে।

> নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির বিকাশে গবেষণা ও উদ্যোগে এমনভাবে প্রণোদনা দিতে হবে যাতে অদূর ভবিষ্যতে এটি একটি রপ্তানিযোগ্য খাত হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির ভিত্তিতে, সবুজ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিকাশে তরুণদের অংশগ্রহণ ও তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যমান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ সংক্রান্ত কারিগরি শিক্ষার জন্য সহায়ক কারিকুলাম তৈরিসহ হাতেকলমে কাজ শেখার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষাক্রমে ব্যবহারিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি সুনিশ্চিত করতে হবে। 

> সবুজ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস এবং সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশের উপর কর রেয়াত এবং প্রণোদনার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সবুজ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিকাশে স্থানীয় উদ্ভাবন, উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি তহবিলের যথাযথ ও স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

- বিজ্ঞপ্তি 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন