সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে জাতীয় সংলাপ

বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বাড়ানোর আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে গতকাল ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: বৈষম্য ও অধিকার’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে আলোচকরা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, কিন্তু সে অর্জনের সুফল সবার ঘরে পৌঁছায়নি। ফলে অরক্ষিত ও বঞ্চিতদের জন্য নেয়া হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বা সামাজিক সুরক্ষা। বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহুবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ এ খাতে ব্যয় হলেও কর্মসূচিগুলোর প্রকৃত প্রভাব প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম—এমন মন্তব্য করে বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। 

‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: বৈষম্য ও অধিকার’ শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে তারা এ আহ্বান জানান। দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে গতকাল দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ওয়েভ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। 

ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলা অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জাকিয়া আফরোজ। এছাড়া অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ব্যুরো অব ইকোনমিকস রিসার্চের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম জাহিদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. এসএম জুলফিকার আলী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (নিবন্ধন) আইয়ুব খান, কেয়ার বাংলাদেশের চিফ অব পার্টি আমানুর রহমান প্রমুখ। 

সংলাপে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ এম শাহান। প্রকল্পের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী মীর মোস্তাক আহমেদ এবং স্বাগত বক্তব্য ও সঞ্চালনা করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক কানিজ ফাতেমা। এছাড়া যুব ও ছাত্র প্রতিনিধি; লোকমোর্চা ও প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী; নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন এবং মুক্ত আলোচনায় তাদের মতামত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। 

বক্তারা বলেন, জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র (এনএসএসএস) নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। তবে কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের বাছাই প্রক্রিয়া এবং সুবিধাগুলো বণ্টনে সুষ্ঠুতা, অনিয়ম ও বৈষম্য রয়েছে। এছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে বাস্তবায়নাধীন এসব কার্যক্রমের যথাযথ মনিটরিং হয় না; পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের পরে উপকারভোগীদের অবস্থার মূল্যায়ন এবং মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পরিকল্পনা প্রণয়নেরও তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা ব্যবস্থা নেই। ফলে সংখ্যাগত দিক থেকে কত মানুষের দারিদ্র্য অবস্থার উন্নয়ন হলো বা হলো না, তারও যথাযথ বা সঠিক পরিসংখ্যান নেই। 

এ বিষয়ে মহিলা অধিদপ্তরের পরিচালক জাকিয়া আফরোজ বলেন, ‘‌সরকার ভিডব্লিউবির মাধ্যমে নারী ও শিশু সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তবে কর্মসূচি বাস্তবায়নে এখনো নিড অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। ফলে আমাদের প্রকৃত উপকারভোগীর সংখ্যা নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সুবিধাভোগী সিলেকশনের ক্ষেত্রে সঠিক মানুষকে সিলেকশন করতে পারাটাও বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা বাজেট পেয়েছি। ১০ লাখ ৪৪ হাজার লোক এ সুবিধা পাচ্ছে। প্রতি বছর ১০ শতাংশ করে সুবিধাভোগী বাড়ানোর কথা, কিন্তু বাজেটস্বল্পতার জন্য সেটা সম্ভব হয় না। ৩০ কেজি চাল দিলে দারিদ্র্য দূর হবে কিনা সেটাও অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে। নারীদের মধ্যে যাদের আর্থিক সহায়তা করা হয়, অনেক সময় দেখা যাচ্ছে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে না। তাদের স্বামী অথবা পরিবারের কারো অ্যাকাউন্টে টাকা নেয়। ফলে সরাসরি টাকাটা পাচ্ছেন না ওই নারী। আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যেন সরাসরি তারা টাকাটা পান।’

‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কাদের দিতে চাই?’–এমন প্রশ্ন রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ব্যুরো অব ইকোনমিকস রিসার্চের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ বলেন, ‘যদি ২৫ শতাংশ লোককে দিতে চাই তাহলে তিন কোটি মানুষ হবে। এর মধ্যে দেড় কোটি নারী। আমরা দিচ্ছি ১৬ লাখ নারীকে। আবার এমন লোককে আমরা দিচ্ছি যারা প্রাপ্য নয়। প্রয়োজনের তুলনায় ১০ ভাগের এক ভাগও পাচ্ছে না। মৌলিক সমস্যা হলো বণ্টন। জাতীয় বাজেটে কেন দরিদ্রের অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারছি না, তার কারণ জবাবদিহিতা নেই। আর দরিদ্রেরও ভয়েস নেই। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে পারছি কিনা যেখানে দরিদ্ররা অধিকার না পেলে টুঁটি চেপে ধরতে পারবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মেকানিজম চালু করতে হবে।’ 

সংসদ সদস্যরা বিলি-বণ্টন তার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য করেন উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বিলি-বণ্টন বন্ধ করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় অবশ্য এটি সম্ভব না। তাই সংস্কার দরকার। বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যবহার করতে হবে। দরিদ্রের ম্যাপিং করতে হবে। যদি বরিশালে বেশি দরিদ্র থাকে তাহলে সেখানে বেশি বরাদ্দ করতে হবে।’

ড. শহীদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র উত্তরণে আমাদের মতপ্রকাশের অধিকার আছে কিনা তা এখন ভাবতে হবে। আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনে শুধু মৌলিক চাহিদার কথা চিন্তা করলে হবে না, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনা করতে হবে। সেজন্য দায়দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, বরং আত্মোন্নয়নে নিজেকে এগিয়ে নিতে হবে।’ 

সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের ক্ষেত্রে এখনো ঠিকমতো উপকারভোগী বাছাই করা হয় না উল্লেখ করে ড. এসএম জুলফিকার আলী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের এখন একটা সুযোগ এসেছে নির্মোহভাবে এ তালিকা তৈরির ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার। নিরাপত্তা বেষ্টনীর সেবাগুলোকে যত ডিজিটালাইজেশন করা যাবে, বাস্তবায়ন ও জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া তত স্বচ্ছ হবে। সেই সঙ্গে এ কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের জন্য দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।’

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বিস্তৃতর বিষয়ে ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘আমাদের মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন। বাস্তবায়ন ও প্রকৃত উপকারভোগীদের নির্বাচনে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান ও প্রকৃত উপকারভোগীর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষাবলয়ে যে কমিটি আছে সেখানে ভবিষৎ প্রজন্মের প্রতিনিধি থাকতে হবে। ২০২৬ সালের সামাজিক উন্নয়ন কৌশলগত নির্দেশিকায় আমাদের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের কথাগুলো সন্নিবেশ করতে হবে।’

সোয়া কোটি মানুষকে সামাজিক সুরক্ষাবলয়ে আনা সম্ভব হয়েছে জানিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আইয়ুব খান বলেন, ‘সরকার ভাতা প্রদানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে জিটুপি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচনে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। সেজন্য সবার সহায়তা প্রত্যাশা করছি।’ 

সভাপতির বক্তব্যে মহসিন আলী বলেন, ‘ওয়েভ ফাউন্ডেশন টেকসই উন্নয়ন; জলবায়ু ন্যায্যতা; সুশাসন, অধিকার ও ন্যায্যতা–এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে সাফল্য এসেছে সেক্ষেত্রে আমাদের পদ্ধতিগত সংস্কার এবং তা বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া, নগর ও পার্বত্যাঞ্চলে যথেষ্ট বরাদ্দ বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকারের কাঠামো সংস্কার, জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরো কাজ করে যেতে হবে।’ 

প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. আসিফ এম. শাহান বলেন, ‘২০১৫ সালে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল বা এনএসএসএস গৃহীত হয়। এনএসএসএস প্রবর্তনের নয় বছর পরও বিপুলসংখ্যক লোক এ কর্মসূচির আওতায় আসেনি।’ 

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো প্রকৃত উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছাতে সংলাপে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধার হয়। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; প্রকৃত উপকারভোগীদের নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা; সংস্কারের ক্ষেত্রে দায় এবং দরদকে গুরুত্ব দেয়া; সরকারি পর্যায়ে খসড়া সামাজিক সুরক্ষা কৌশলগুলোর অনুমোদন; চাহিদা বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো; স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং সেবাগ্রহীতাদের উত্তরণে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ শক্তিশালী মনিটরিং ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত করা; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা (জিআরএস) সহজতর ও কার্যকর করতে পদক্ষেপ নেয়া; সামাজিক সুরক্ষাসহ সরকারি বিভিন্ন সেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রচারের জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলোর সহায়তা নেয়া এবং বেসরকারি সংগঠনগুলোরও এ-সংক্রান্ত প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখা; নগর দরিদ্রদের চাহিদা বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো; সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী বাছাইকরণ প্রক্রিয়ায় যে ডিজিটালাইজেশন শুরু হয়েছে তার সুফল পেতে হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা; সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রাপ্তিতে যে অধিকার রয়েছে সে বিষয়ে এনজিওর ক্যাম্পেইন কার্যক্রম চলমান রাখা; শহরাঞ্চলের জন্য বিশেষ করে নগর দরিদ্রদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ; সঠিক উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য কর্মসূচিগুলোকে যথাযথভাবে জিজিটালাইজ করা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন