স্টোরের মূল্যবান যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিচ্ছেন রেলকর্মীরা!

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

ছবি : বণিক বার্তা

ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০১৬ সালের আগস্টে ১৫০টি ব্রড গেজ ও মিটার গেজ কোচ আমদানি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ১০০টি মিটার গেজ কোচের সঙ্গে ক্যাপিটাল স্পেয়ার পার্টসও দেয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রেলওয়ের সরঞ্জাম শাখা এসব যন্ত্রাংশ রেলের বৈদ্যুতিক শাখাকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি। একাধিকবার চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এক-চতুর্থাংশ মূল্যমান যন্ত্রাংশ বুঝিয়ে দিলেও স্টোরে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের স্টোরসহ বিভিন্ন স্থাপনা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে রেলওয়ের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও গুরুত্বপূর্ণ মালামাল। স্টোরে সুরক্ষিত মালামাল পাহারায় থাকা সত্ত্বেও উধাও হয়ে যাওয়ার সঙ্গে কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশগুলো সরঞ্জাম শাখায় রক্ষিত থাকলেও সেগুলো অবৈধ পন্থায় বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এ অভিযোগে একাধিকার ফেরত দিতে চিঠি ও নির্দেশনা দেয়া সত্ত্বেও সেটি আমলে নেননি সরঞ্জাম শাখার (পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম) এসএই (এস) মো. গোলাম মোস্তফা। তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে চুরির বিষয়টি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ কিংবা মূল্যবান যন্ত্রাংশ আদায়ের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। 

রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোচের সঙ্গে দেয়া টেম্পারেচার সেন্সরগুলোর অভাবে কোচ মেরামত করতে না পেরে শপে অলস পড়ে আছে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা মিটার গেজের একাধিক এসি কোচ। এতে যাত্রী চাহিদার কারণে প্রয়োজন থাকলেও বিভিন্ন ট্রেনে বাড়তি কোচ সংযোজন করতে পারছে না রেলওয়ে। 

রেলওয়ের এ-সংক্রান্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে আগত ১০০ এমজি কোচের ক্যাপিটাল স্পেয়ার পার্টসের সঙ্গে এসি ইউনিটের দুই ধরনের টেম্পারেচার সেন্সর ২০টি করে মোট ৪০টি সরবরাহ করা হয়। ওই ৪০টি মালামালের মধ্যে ১০টি এসএসএই ইনচার্জ (এসি), পাহাড়তলী ডিপো থেকে সরবরাহ নিলেও বাকি ৩০টি মালামাল সরবরাহ না পাওয়ায় পূর্বাঞ্চল রেলের বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি মো. গোলাম মোস্তফাকে দায়ী করে তার কাছ থেকে মালামালের বর্তমান বাজারমূল্য হিসেবে সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি এসব মালামালের একক মূল্য নির্ধারণ করে জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তরকে জানাতে চিঠি দেয়। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া কোচের বিকল্প যন্ত্রাংশগুলো স্টোরে না পেয়ে কারণ অনুসন্ধানে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলওয়ে। তদন্তে উঠে আসে—ইন্দোনেশিয়ান কোচের সঙ্গে ফ্রিতে পাওয়া ৪০টি টেম্পারেচার সেন্সর স্টোর ডিপোতে রাখা ছিল। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও এসব পার্টস সরবরাহ করা হয়নি। পরে চাহিদার বিপরীতে মৌখিক অনুরোধে ১০টি সেন্সর দেয়া হলেও কোনো ধরনের ফরওয়ার্ডিং মেমো ও গেট পাস দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে স্টোরের দায়িত্বে থাকা এসএই (এস) মো. গোলাম মোস্তফাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এসব সেন্সর সরবরাহ করেছেন দাবি করলেও এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। এ কারণে মো. গোলাম মোস্তফাকে টেম্পারেচার সেন্সর চুরিতে দায়ী করে আর্থিক ক্ষতি নির্ধারণপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। 

এদিকে ২০২৩ সালের ২৬ আগস্ট কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকা থেকে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর টুল ভ্যানের প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের মালামাল চুরি হয়। রেলকর্মীরা ট্রেনের কোচ মেরামতের যন্ত্রাংশ সংগ্রহে গেলে চুরির বিষয়টি নজরে আসে। রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের অধীনে থাকা স্টোরে গত এক বছরে ৪-৫ কোটি টাকার চুরি ও যন্ত্রাংশ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় রেলওয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি মামলা দায়ের করলেও মালামাল উদ্ধার হয়নি।

এ বিষয়ে রেলওয়ের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) আনোয়ারুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ান কোচের নিয়ন্ত্রক উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুদণ্ড প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়টি রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মো. গোলাম মোস্তফা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি হওয়া কোচের যন্ত্রাংশ উধাও হয়ে যাওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো সঠিক নয়। আমার তত্ত্বাবধানে রাখা ৮৫টি আইটেমের যন্ত্রাংশ যথা নিয়মে ফেরত দেয়া হয়েছে। ৪০টি টেম্পারেচার সেন্সরও আমি ফেরত দিয়েছি। তদন্ত কমিটির চাওয়া জবাবে ৩০টি সেন্সর ফেরত দেয়া হলেও কেন তদন্ত কমিটি আমাকে দোষী করেছেন সেটি আমি জানি না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন