শিল্পপ্রেমে অনন্য দম্পতির ধূসর কর্মকাণ্ড

মেহেদী হাসান রাহাত

রাজীব ও নাদিয়া সামদানী দম্পতি ছবি: নূর ফটোফেস ৩২৭-এর সৌজন্যে নিউজডটআর্টনেটডটকমে প্রকাশিত

দেশ-বিদেশের শিল্পকর্ম নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে আয়োজন হচ্ছে ‘ঢাকা আর্ট সামিট’। এতে অংশ নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী, বোদ্ধা, শিল্পরসিক ও সংগ্রাহক। এটি আয়োজন করছে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন, যার কর্ণধার রাজীব ও নাদিয়া সামদানী দম্পতি। তাদের নিজেদের শিল্পকর্ম সংগ্রহের তালিকাটি বেশ ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের চিত্রকর্ম থেকে শুরু করে অধুনাকালের কোরীয় ভাস্কর হেগুয়ে ইয়াংয়ের শিল্পকর্মও আছে এ তালিকায়।

শুধু শিল্পকর্ম সংগ্রাহক নয়, সরবরাহকারী হিসেবেও সাম্প্রতিক সময় আলোচনায় এসেছেন রাজীব সামদানী। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদচ্যুতির পর তার ছোট বোন শেখ রেহানার গুলশানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সে সময় সেখান থেকে বেশকিছু মূল্যবান শিল্পকর্ম লুট হওয়ার ঘটনাও ঘটে। বলা হয়, এসব শিল্পকর্ম মূলত রাজীব সামদানীর সরবরাহ করা। 

সিটি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক রাজীব সামদানী গত এক যুগে দেশ-বিদেশের শিল্পকর্ম বোদ্ধা ও রসিকদের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। জানা যায়, যুক্তরাজ্যের টেট গ্যালারি বেশ কয়েকটি কমিটির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে চিত্র ও শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে থাকে। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ এশিয়া অধিগ্রহণ কমিটি (এসিসি) প্রতিষ্ঠা করে। এ কমিটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজীব সামদানী ও লেখা পোদ্দার। পরে নাদিয়া সামদানীও এ কমিটিতে যুক্ত হন। ২০১২ সালেই সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ঢাকা আর্ট সামিট অনুষ্ঠিত হয়। দ্য আর্ট নিউজপেপার ডটকমের তথ্য বলছে, রাজীব সামদানী যুক্তরাজ্যের প্যারাসল ইউনিট ও ডেলফিনা ফাউন্ডেশন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মিউজিয়াম, সুইজারল্যান্ডের কুনসথ্যালে বাসেল এবং দুবাইয়ের আলসারকেল এভিনিউর সাংস্কৃতিক কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এগুলোর সবই শিল্প ও চিত্রকর্ম সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান।

বিশেষ করে দ্বিবার্ষিক ঢাকা আর্ট সামিটের মধ্য দিয়ে দেশে ক্ষমতাসীনদেরও নজরে আসেন রাজীব সামদানী। এখন পর্যন্ত ঢাকা আর্ট সামিটের ছয়টি আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম আসরটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার আলোকচিত্র সংগ্রহ নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনী হয়। এতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এসেছিলেন। সেখানেই শেখ পরিবারের কাছাকাছি আসেন রাজীব ও নাদিয়া সামদানী দম্পতি। শেখ হাসিনার সুনজরে আসতে পরের বছর ২০২১ সালে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সঙ্গে যৌথভাবে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১-৭২ সালের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেন তিনি।

দেশ-বিদেশের শিল্প অনুরাগী ও সংগ্রাহকদের একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল ঢাকা আর্ট সামিট। মধ্যপ্রাচ্যের শৌখিন বিত্তশালীরা তাদের সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছেন। তাদের একটি অংশ বাংলাদেশ থেকেও বেশকিছু শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আর্ট সামিটে সরাসরি কোনো শিল্পকর্ম কেনাবেচা করা হতো না। তবে এটি শিল্প সংগ্রাহকদের নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য বড় একটি প্লাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায়।

বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার ও কালো টাকা সাদা করার একটি বড় মাধ্যম হলো শিল্পকর্মে বিনিয়োগ। বৈশ্বিক প্রত্ন ও শিল্পসম্পদের বাজার পর্যবেক্ষণকারী তথ্যসেবা সংস্থা আর্ট অ্যান্ড অবজেক্ট এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধ পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান কমপ্লাই অ্যাডভান্টেজের তথ্য অনুযায়ী, প্রত্ন বা শিল্পসম্পদের ক্রেতারা এগুলো সংগ্রহ করেন সাধারণত নিলামের মাধ্যমে। প্রকাশ্য নিলামে এগুলোকে নিরাপদে উপস্থাপন করতে তা আগে কয়েক দফায় বেচাকেনা করা হয়। আবার এ সম্পদ হস্তগত করার পর তা হয়ে ওঠে ব্ল্যাক মানি বা অবৈধ অর্থকে বৈধ করার হাতিয়ার। এক্ষেত্রেও কয়েক দফা কেনাবেচার মাধ্যমে কালো টাকাকে আড়াল করা হয়ে থাকে। এভাবে অবৈধ অর্থ বৈধ করার প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘লেয়ারিং’। সংশ্লিষ্ট নীতিমালার অভাবে বিশ্বের সবখানেই এ ধরনের সম্পদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি জটিল। এর সুযোগ নিয়ে কালো টাকা সাদা করার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। আবার প্রত্ন ও শিল্পসম্পদের নিলামগুলোয় ক্রেতার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্ত থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে এ-সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করে আনতেও হিমশিম খেতে হয়।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে আর্থিক লুণ্ঠনের মাধ্যমে দেশে একটি বড় অলিগার্ক শ্রেণী তৈরি হয়। শিল্পকর্ম সংগ্রহ ও কেনাবেচাকে অর্থ পাচারের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলেন তারা। ঢাকা আর্ট সামিট তাদের একত্র হওয়ার সুযোগকে আরো অবারিত করে তোলে। এ অলিগার্করা তাদের অঢেল অর্থের একটি অংশ ব্যয় করেন শখের চিত্রকর্ম সংগ্রহের কাজে। এতে দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের চিত্রকর্মের দামও ক্রমেই বেড়েছে। অভিযোগ আছে, ঢাকা আর্ট সামিটের মধ্য দিয়ে ওই শ্রেণীর অংশ হয়ে উঠেছিলেন রাজীব সামদানীও। এরই মধ্যে তিনি ক্যারিবীয় দ্বীপদেশ সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সম্পত্তি কিনেছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও। 

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজীব সামদানীকে ৫০ লাখ ১৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুরে পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট বানানোর জন্য পার্শ্ববর্তী টিলার মাটি কেটে নিজের জমি ভরাটের অভিযোগে তাকে এ জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি তার মালিকানাধীন ফতেহপুর এস্টেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে অবস্থানগত ছাড়পত্র ছাড়াই এ রিসোর্ট প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুরও অভিযোগ ছিল। 

অভিযোগ আছে, ৫ আগস্ট শেখ রেহানা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাড়ি থেকে অনেকগুলো শিল্পকর্ম লুট হয়। এর মধ্যে শেখ রেহানার বাড়ি থেকে লুই পিজা, এসএম সুলতান, কামরুল হাসান ও মুর্তজা বশীরের মূল্যবান কিছু শিল্পকর্ম লুট হয়, যার মূল্য অন্তত ৭৫ কোটি। একই সঙ্গে সালমান এফ রহমানের বাড়ি থেকে মূল্যবান শিল্পকর্ম লুট হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের। একটি সূত্র বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, এসব লুণ্ঠনের সঙ্গে রাজীব সামদানী জড়িত থাকতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। 

প্রতিবেশীরাও জানিয়েছেন, এসব বাড়িতে যখন ধ্বংসযজ্ঞ চলছিল তখন আশপাশের অভিজাতরাই মূল্যবান শিল্প ও চিত্রকর্মগুলো নিয়ে যান।

বর্তমানে অন্য সবকিছু ছাপিয়ে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের কর্ণধার ও ঢাকা আর্ট সামিটের উদ্যোক্তা হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত রাজীব সামদানী। তবে দেশের ব্যবসায়ী অঙ্গনে তিনি প্রথম পরিচিতি পেয়েছিলেন গোল্ডেন হারভেস্ট গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার হিসেবে। গ্রুপটির যাত্রা হয়েছিল কমোডিটি ব্যবসার মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটি পরে হিমায়িত খাদ্যের ব্যবসায়ও যুক্ত হয়। ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে দেশে ডোমিনোজ পিৎজা নিয়ে আসেন আহমেদ রাজীব সামদানী। 

তবে গত দশকে তার গড়ে তোলা ফাউন্ডেশনের প্রতিপত্তি যত বেড়েছে ততটাই দুর্বল হয়েছে গ্রুপটির তালিকাভুক্ত কোম্পানি গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। বন্ডে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত না দিতে পারার পাশাপাশি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে নেয়া অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যয়ের অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্থ ফাউন্ডেশনের জন্য ব্যয়ের অভিযোগও রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে গোল্ডেন হারভেস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সামদানী ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি আহমেদ রাজীব সামদানীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

দেশব্যাপী কোল্ডচেইন নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। এতে যৌথ উদ্যোগে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনেরও (আইএফসি) সম্পৃক্ত হওয়ার কথা ছিল। যদিও সে উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৯ সালে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে দেশে ডোমিনোজ পিৎজার ফ্যাঞ্চাইজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গোল্ডেন হারভেস্ট। যদিও পরে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে নিজেদের ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেয় গোল্ডেন হারভেস্ট।

জানা গেছে, দেশের হিমায়িত খাদ্যের বাজার কিংবা নতুন উদ্যোগ নিয়ে একটি সময় পর্যন্ত আহমেদ রাজীব সামদানী বেশ সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু পরে ঢাকা আর্ট সামিটের পরিধি বাড়তে শুরু করলে তিনি তাতেই বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির আর্থিক ও ব্যবসায়িক অবস্থা ক্রমেই নিম্নমুখী হতে থাকে। অবশ্য এজন্য কোম্পানিটির পক্ষ থেকে কভিডের অভিঘাতের প্রভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অন্যান্য খাতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কভিডের প্রভাব আরো আগেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

গোল্ডেন হারভেস্টের ব্যবসার যাত্রা ১৯৯৭ সালে কমোডিটির মাধ্যমে। পরে তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, অবকাঠামো উন্নয়ন, লজিস্টিক, ডেইরি, এভিয়েশন ও বীমা খাতের ব্যবসায়ও যুক্ত হয় গ্রুপটি। ২০১৩ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিটি শেয়ার ২৫ টাকা (১৫ টাকা প্রিমিয়াম) বিক্রি করে সে সময় পুঁজিবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। ২০১৭ সালে ৫০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করে কোম্পানিটি। এর দুই বছর পর ২০১৯ সালে ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে গোল্ডেন হারভেস্ট। এ বছরের মার্চ শেষে গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১৫ কোটি টাকায়।

পুঁজিবাজারে আসার পর থেকে ২০১৮-১৯ হিসাব বছর পর্যন্ত গোল্ডেন হারভেস্টের আয় ও মুনাফার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী ছিল। তবে ২০১৯-২০ হিসাব বছর থেকেই কোম্পানিটির আর্থিক ও ব্যবসায়িক অবস্থা ক্রমেই নিম্নমুখী। টানা তিন বছর ধরে লোকসানে রয়েছে কোম্পানিটি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকেও (জুলাই-মার্চ) ৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে কোম্পানিটির।

গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. শহীদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোম্পানির ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো না থাকার কারণে প্রত্যাশিত হারে আয় হয়নি। এ কারণে বন্ডের অর্থ ফেরত দেয়া সম্ভব হয়নি। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়টি সমাধান করা হবে। বিএসইসির তদন্ত কার্যক্রম এখনো চলমান। তারা আমাদের কাছে যেসব তথ্য চেয়েছে আমরা সেটি দিচ্ছি। তদন্ত শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন জমা না দেয়ার আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’ 

স্পন্সর হিসেবে ঢাকা আর্ট সামিটের সঙ্গে গোল্ডেন হারভেস্টের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আর্ট সামিটে দেশী-বিদেশী অনেকেরই অংশগ্রহণ থাকে। এক্ষেত্রে কোম্পানির ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হিসেবে স্পন্সর করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সামিট আয়োজনের জন্য কোনো অর্থ দেয়া হয়নি। তবে সামিটের প্রচারণায় ব্যবহৃত ব্যানার তৈরির ক্ষেত্রে কিছু অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।’

পুঁজিবাজার থেকে অর্থ নেয়ার আগে যে খাতে ব্যয় করার কথা ছিল সে খাতে ব্যয় না করার অভিযোগও রয়েছে গোল্ডেন হারভেস্টের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টি বর্তমানে অনুসন্ধান করে দেখছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সম্প্রতি বিএসইসির কর্মকর্তারা কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শন করে এসেছেন। কোম্পানি রাইট শেয়ারের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। এছাড়া কারখানায় বিনিয়োগ ও রেফ্রিজারেটর কেনা বাবদ যে অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে, সেটিও প্রকৃতপক্ষে সেখানে ব্যয় করা হয়নি। এছাড়া অব্যয়িত অর্থ ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে রাখা হলেও প্রায় এর সমপরিমাণ অর্থ আবার এফডিআরের বিপরীতে ঋণও নিয়েছে কোম্পানিটি। বিএসইসির অনুসন্ধান এখনো চলমান রয়েছে। তবে সংস্থাটির কর্মকর্তারা মনে করছেন, রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে নেয়া অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যয়ের মাধ্যমে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। 

২০১৭ সালে ৫০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর উদ্যোগ নিয়েছিল গোল্ডেন হারভেস্ট। যদিও শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারে ৩৪ কোটি টাকা। কোম্পানিটির বন্ডে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইপিডিসি, আইআইডিএফসি ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু বন্ড ইস্যুর পর থেকেই এর অর্থ পরিশোধ করছে না কোম্পানিটি। শুরুর দিকে বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে আংশিক কুপনের অর্থ পরিশোধ করা হলেও পরে সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। এ অবস্থায় বন্ডে বিনিয়োগের অর্থ আদায়ে বিএসইসি ও ট্রাস্টি গ্রীন ডেল্টা ক্যাপিটালের দ্বারস্থ হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। 

গোল্ডেন হারভেস্টের বন্ডে ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এখন পর্যন্ত কোম্পানিটি বন্ডে বিনিয়োগের মূল অর্থ ও কুপনের টাকা ফেরত পায়নি। এ বিষয়ে বিএসইসির কাছেও অভিযোগ দিয়েছে বীমা কোম্পানিটি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মিল্টন ব্যাপারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বছরের আগস্ট শেষে বন্ডে বিনিয়োগের মূল অর্থ ও সুদ মিলিয়ে ২৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা পাওনা দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গোল্ডেন হারভেস্ট অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা ট্রাস্টি ও বিএসইসির কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। এখনো পাওনা আদায়ের কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি।’

গোল্ডেন হারভেস্টের বন্ডে একইভাবে বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসি লিমিটেড। বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম সারওয়ার ভূইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে কোনো রিটার্ন পাচ্ছি না। টাকা আদায়ের জন্য আমরা বিএসইসি ও ট্রাস্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’

গোল্ডেন হারভেস্টের বন্ডের ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করছে গ্রীন ডেল্টা ক্যাপিটাল লিমিটেড। ট্রাস্টির পক্ষ থেকে বন্ডের বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত না দেয়ার বিষয়টি বিএসইসিকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বিএসইসিতে শুনানিতে উপস্থিত হয়েছিলেন গোল্ডেন হারভেস্টের কর্মকর্তারা। তারা অর্থ ফেরত দেয়ার একটি পরিকল্পনা জানানোর কথা বললেও পরে আর সেটি জমা দেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রীন ডেল্টা ক্যাপিটালের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল অর্থ ও কুপনের অর্থ মিলিয়ে পাঁচ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন হারভেস্টের কাছ থেকে ৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা পাবে। অর্থ পরিশোধের বিষয়ে সর্বশেষ গত ২৯ আগস্ট গোল্ডেন হারভেস্টকে চিঠি দেয়া হয়েছে। যদিও এখনো এর কোনো জবাব দেয়নি তারা।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন