বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

একাই ৭০ মরদেহকে গোসল করান মুজিবুর

ইকবাল মুনাওয়ার

ঢামেক মর্গে ২৪ বছর ধরে কাজ করছেন মুজিবুর রহমান ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গের গোসলঘরে কাজ করেন মুজিবুর রহমান। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ এলে গোসল করানোর পর কাফন পরিয়ে দেয়াই তার দায়িত্ব। ষাটোর্ধ্ব মুজিবুর দীর্ঘ দুই যুগ ধরে এ কাজ করে আসছেন। প্রতিদিন তিন-চারটি মরদেহের গোসল করাতে হয়। তবে গত ৪ আগস্ট ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি। জীবনের প্রথম একদিনেই তাকে ২৪টি মরদেহের গোসল দিতে হয়। 

ওইদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এমন অনেক মরদেহ একসঙ্গে দেখেছিলাম রানা প্লাজা ধসে যাওয়ার সময়। তখন অনেক মানুষের মরদেহ ঢামেকে এসেছিল। কিন্তু ৪ আগস্টের মতো একসঙ্গে এতগুলো কখনো আসেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সব মিলিয়ে ৭০টির মতো মরদেহের গোসল করিয়েছি আমি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে গত ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এরপর পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। প্রায় প্রতিদিনই আসে মৃত্যুর খবর। শুরুর দিকে ছয়-সাতজন করে নিহত হলেও ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ে এ সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রাণ হারায় সহস্রাধিক। ছাত্র, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা কিংবা পরিচয়হীন অনেকেই নাম উঠে আসে সে তালিকায়। তাদের অনেকেরই শেষ গোসল দিয়েছেন মুজিবুর রহমান। 

পাঁচ সন্তানের বাবা মুজিবুর রহমানের বাড়ি কুমিল্লায়। ঢাকায় বাস করছেন ২৪ বছর ধরে। ঢামেক মর্গের গোসলঘরে কাজ করছেন সেই তখন থেকেই। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্টের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সেদিন অন্য রকম পরিবেশ সৃষ্টি হয় মর্গে। যেন এক মৃত্যুর মিছিল। একের পর এক মরদেহ আসতে থাকে। মাথায় গুলি, পায়ে গুলি লেগে এক পা উড়ে যাওয়া মরদেহ, বুক ভেদ করে গুলি বের হয়ে যাওয়া মরদেহ, কপালে গুলি ঢুকে পেছন দিয়ে বের হয়ে যাওয়া মরদেহ, পেটের মধ্যে গুলি লেগে কিডনি ছিন্নভিন্ন হওয়া মরদেহ...। মর্গের আশপাশ পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। গোসলঘরের সামনেও ছিল লাশের স্তূপ। ওই একদিনেই আমি ২৪ জনকে গোসল করাই, যাদের অধিকাংশের পরিবার উপস্থিত নেই। আবার যাদের পরিবার আছে তারা গোসলঘরের বাইরে বসে বসে কান্না করছিল।’ কথা বলতে বলতেই কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে বৃদ্ধ মুজিবুরের। কিছুটা সময় নিয়ে তিনি বললেন, ‘একটা ছেলের মৃতদেহ দেখে আমি থমকে যাই। অনেক বেশি খারাপ লেগেছিল। ছেলেটার বয়স ১৫ বছরের বেশি হবে না। শুনেছি সে ফুটপাতে ভ্যানগাড়িতে জিনিসপত্র বিক্রি করত। কিন্তু গুলিতে তার দেহের বিভিন্ন অংশ ক্ষত হয়ে যায়।’ 

মুজিবুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় একসঙ্গে এমন ছোট ছোট ছেলেকে কখনো গোসল করাইনি। আমারও সন্তান আছে। তাই ছেলেগুলোর মরদেহ দেখে আমার ভেতরে মায়া কাজ করে বেশ। গোসল করানোর পর খুব যত্ন করে কাফন পরিয়ে দিয়েছি।’

বিভিন্ন বয়সের মরদেহ আন্দোলন চলাকালে মর্গের গোসলঘরে এসেছিল জানিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘মধ্যবয়সী, যুবক, তরুণদের মৃতদেহ একে একে এসেছিল। তবে যুবক ও তরুণদের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি। একেক মরদেহের ছিল একেক রকম বৈশিষ্ট্য। কারো বুকে গুলি, কারো মাথায়, কারো শরীরের অন্যান্য জায়গায় গুলি লাগে। কিছু মৃতদেহের তো গোসল করানোই কঠিন হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মর্গে থাকায় দেহের বিভিন্ন অংশে পচতে শুরু করে। সেগুলো গোসল করানোর সময় কিছু অংশ খসে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘গোসলঘরের কাজ করার কারণে মৃতদেহ দেখলে আর খারাপ লাগত না। কিন্তু ছোট ছোট ছেলেদের লাশ দেখার পর আমার মস্তিষ্কে তাদের চেহারা ভাসতে থাকে। এখনো বারবার মনে পড়ে তাদের কথা।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন