শ্বেতি রোগ

শ্বেতি রোগের আধুনিক চিকিৎসা

ডা. মো. কামরুল হাসান চৌধুরী

ছবি: আইস্টক

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি মানুষ শ্বেতি বা ভিটিলিগো রোগে আক্রান্ত। এ রোগ সম্পর্কে আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার। অনেকেই শ্বেতি রোগকে ছোঁয়াচে বলে মনে করেন এবং এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকেন। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি অস্বস্তি ও মানসিক অবসাদে ভোগেন। আবার অনেকেই শ্বেত রোগকে মনে করেন কুষ্ঠ রোগ, যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। শ্বেতি ছোঁয়াচে বা প্রাণঘাতী কোনো রোগ নয়। বর্তমানে এ রোগের রয়েছে নানা আধুনিক চিকিৎসা, যার মাধ্যমে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।

শ্বেতি রোগ

শ্বেতি মূলত এক ধরনের অটোইমিউন ডিজিজ, যা একটি চর্মরোগ বা ত্বকের ব্যাধি। রোগে শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বকে বিশেষ করে মুখ, ঠোঁট, হাত, কনুই, ঘাড়, গলা চোখের চারপাশে ছোট ছোট সাদা দাগ দেখা দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় দাগগুলোর আকার ছোট হলেও ক্রমেই দাগ বড় হতে থাকে এবং মুখের ভেতরের অংশের ত্বক মাথার ত্বকে ছড়িয়ে পড়ে। রোগে ভ্রু, চোখের পাপড়িসহ চুল-দাড়িও ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে।

কারণ

শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে শ্বেতি রোগের কারণ বংশগত। বাবা-মা রোগে ভুগে থাকলে কিংবা শ্বেত রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া রোগের অন্যতম প্রধান কারণ মেলানিনের ভারসাম্যহীনতা। আমাদের শরীরে যখন কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে সেটিকে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু যদি অটোইমিউন ডিজিজ থাকে, তাহলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের শরীরেরই কোনো কোষকে অনিরাপদ মনে করে এবং তাকে ধ্বংস করে ফেলে। শ্বেতি রোগের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ত্বকের স্বাভাবিক রঙের ভারসাম্য রক্ষাকারী উপাদান মেলানিন উৎপাদনকারী কোষ মেলানোসাইটকে ক্ষতিকর মনে করে এবং সেটিকে নষ্ট করে ফেলে। এতে আক্রান্ত ত্বকে মেলানোসাইট না থাকায় মেলানিন তৈরি হতে পারে না। ফলে আক্রান্ত ত্বক সাদা দেখা যায়। তাছাড়া থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, বিভিন্ন প্রসাধনীর ব্যবহার, শারীরিক মানসিক চাপ, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ এবং বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ দেহের মেলানোসাইট কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

রোগ নির্ণয় : ত্বকে সাদা দাগ মানেই শ্বেতি নয়। অনেক সময় শরীরের কোনো স্থানের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে সেই স্থান সাদা হয়ে যেতে পারে। আবার রোদে পুড়ে বা সানবার্ন হলেও ত্বকে সাদা দাগ হতে পারে। তাই রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা জরুরি। সাধারণত শ্বেতি রোগ নির্ণয়ে উডস ল্যাম্প নামক একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। একটি অন্ধকার ঘরে উডস ল্যাম্প দিয়ে ত্বকের ওপর আলো ফেলা হয়। আলোতে যদি দেখা যায়, আক্রান্ত স্থানের ত্বকের রং চকের মতো চকচকে সাদা তাহলে অবশ্যই এটি শ্বেতি রোগ। 

চিকিৎসা পদ্ধতি

সাধারণত চারটি পদ্ধতিতে শ্বেতি রোগের চিকিৎসা করা হয়।

ওষুধ মলমের দ্বারা: যেসব রোগীর ১০-২০ ভাগ ত্বক শ্বেতিতে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ব্যবহারের জন্য কিছু মলম বা ক্রিম মুখে খাওয়ার ওষুধ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ট্যাক্রোলিমাস ক্রিম, ইমিউনোসপ্রেসিভ ড্রাগ স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ ভালো কাজ করে। তবে দাগ দ্রুত বড় হতে থাকলে রোগীকে জেএকে ইনহিবিটর নামক ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়।

ফটোথেরাপি: শ্বেতি রোগের অত্যন্ত কার্যকর নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি হলো ফটোথেরাপি বা আলোকথেরাপি। পদ্ধতিতে সূর্যের আলোয় থাকা আল্ট্রাভায়োলেট- আল্ট্রাভায়োলেট-বি রশ্মিকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যবহার করে ত্বকের চিকিৎসা করা হয়। রোগীর চামড়ার ধরনের ওপর ভিত্তি করে ফটোথেরাপির ধরন নির্ধারণ করা হয়। তবে শ্বেত রোগের চিকিৎসায় ন্যারো ব্যান্ড ইউভিবি, ইউভিএ পিইউভিএ ফটোথেরাপি বেশি ব্যবহৃত হয়।

লেজার চিকিৎসা: শ্বেত রোগ যদি শরীরের অল্প কিছু স্থানে হয়ে থাকে তাহলে লেজার চিকিৎসা সবচেয়ে ভালো কাজ করে। এক্ষেত্রে এক্সাইমার লেজারের মাধ্যমে আক্রান্ত স্থানে চিকিৎসা দেয়া হয়। এক্সাইমার লেজার একটি বিশেষ ধরনের লেজার, যা ৩০৮ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে। একে টার্গেটেড ফটোথেরাপিও বলে। পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি সম্পূর্ণ ব্যথাহীন কাটাছেঁড়ামুক্ত।

অস্ত্রোপচার: শ্বেতি রোগ বিগত এক-দুই বছর ধরে একই পর্যায়ে থাকলে রোগীর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। সাধারণত শ্বেতির চিকিৎসায় পাঞ্চ গ্রাফটিং বা স্কিন গ্রাফটিং নামক অস্ত্রোপচার করা হয়। পদ্ধতিতে ত্বকের স্বাভাবিক অংশ থেকে চামড়া নিয়ে আক্রান্ত স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়। কিংবা চামড়ায় কৃত্রিম ফোসকা বা ব্লিস্টার তৈরি করে সেই ফোসকার ওপরের চামড়া কেটে আক্রান্ত স্থানে লাগানো হয়। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচারে নন কালচার মেলানোসাইট ট্রান্সপ্লানটেশন পদ্ধতি অধিক প্রয়োগ করা হয়। পদ্ধতিতে শরীরের সুস্থ কোনো অংশ থেকে ত্বক চুলের রং নির্ধারণকারী কোষ মেলানোসাইটকে কালচার করে আক্রান্ত ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়। ত্বকের রং গঠন স্বাভাবিক রাখতে পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর।

শ্বেতি রোগ নিয়ন্ত্রণে করণীয় 

আমরা জানি যে সূর্যের বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আলোকরশ্মি শ্বেতি রোগের জন্য খুব ক্ষতিকর। তাই অযথা শ্বেতি রোগীকে রোদে ঘোরাঘুরি করা যাবে না অথবা রোদে বের হওয়ার আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে, ফুলহাতা জামা পরতে হবে এবং মাথায় টুপি ব্যবহার করতে হবে।

যেকোনো রকমের আঘাত থেকে শ্বেতি রোগ শুরু হতে পারে অথবা যেকোনো আঘাত শ্বেতি রোগকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই শ্বেতি রোগীকে অবশ্যই নিজের ত্বকের যথাযথ যত্ন নিতে হবে এবং কোনো রকম কাটাছেঁড়া করা যাবে না।

শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর জন্য প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল খেতে হবে এবং রাত জাগা যাবে না।

যেহেতু শ্বেতি রোগের সঙ্গে আরো কিছু রোগের সংযোগ থাকে তাই বছরে অবশ্যই একবার একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, রক্তশূন্যতাসহ আরো কিছু রোগের স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হবে।

লেখক: চর্ম, যৌন, অ্যালার্জি, লেজার অ্যান্ড হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন

কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন