বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাফটিং টমেটো নার্সারি

মৌলভীবাজারে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ পাচ্ছেন না ঋণগ্রস্ত চাষীরা

আফরোজ আহমদ, মৌলভীবাজার

বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে টমেটো গাছ। মালচিং পেপারের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে খুঁটি ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর, ইসলামপুর মাধবপুর ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি গ্রাফটিং টমেটো চাষ হয়। প্রায় তিন দশকে ভাগ্য বদলেছে অনেকের। সময়ে মাঠ ভরা টমেটো থাকার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক বন্যা সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিন শতাধিক কৃষক। বিভিন্ন এনজিও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করা টমেটো নার্সারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষীরা। অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের আশায় গ্রাম ছেড়েছেন। কেউ কেউ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। তবুও ঋণ পরিশোধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।

সাধারণত বন বেগুন চারার গোড়ার দিকের অংশের সঙ্গে টমেটোর চারার ওপরের অংশ জোড়া দিয়ে গ্রাফটিং করা হয়। এভাবে লাগানো টমেটোর চারা বড় হয়ে ঢলে পড়ে না, রোগ-বালাইও তেমন হয় না। ফলন হয় প্রচুর। যেখানে সাধারণ একটি গাছে পাঁচ-দশ কেজি টমেটো মেলে, সেখানে গ্রাফটিং করা প্রতি গাছে মেলে ২০-২৫ কেজি।

আদমপুর ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামে সবচেয়ে বেশি টমেটোর নার্সারি রয়েছে। ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, পলিথিন দিয়ে তৈরি নার্সারির ছোট ছোট শেড খালি পড়ে রয়েছে। শেডের ভেতরে লাগানো চারা বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে। একই অবস্থা টমেটো খেতের। জমিতে মালচিং পেপারের ওপর টমেটো গাছের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। নিচে টমেটো গাছের পচা গুঁড়ি পড়ে রয়েছে। একই অবস্থা আদমপুর, ইসলামপুর মাধবপুর ইউনিয়ের অধিকাংশ টমেটো খেতের।

বনগাঁও গ্রামের কৃষকরা জানান, তাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নার্সারি থেকে টমেটো চারা উৎপাদন করেন। চারা মানভেদে -১৫ টাকা দামে বিক্রি হয়। স্থানীয় চাষীরা ছাড়াও পার্শ্ববতী হবিগঞ্জ জেলা থেকে কৃষকরা চারা কিনে নিয়ে যান। গ্রামের অনেকে আবার টমেটো খেত করেন। কেউ কেউ চারা উৎপাদন খেত দুটোই করেন। টমেটো খেতের জন্য তুলনামুলক উঁচু জমির প্রয়োজন হয়। সে রকম জমি সবার না থাকায় অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষীরা টমেটো চাষ করেন। প্রতি কিয়ার জমি (৩০ শতক) এক বছরের জন্য ২০-২৫ হাজার টাকা দিতে হয়।

টমেটো চাষীরা জানান, অধিকাংশ কৃষক চাষাবাদের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি এনজিওর কাছ থেকে ঋণ করেন। আবার চারা ফসল দেয়ার চুক্তিতে অনেকে পাইকার চারা ক্রয়কারী চাষীদের কাছ থেকে অগ্রীম টাকা নেন। এছাড়া সার কীটনাশক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাকিতে তারা পণ্য ক্রয় করেন। ফসল তোলার আগেই বেশির ভাগ কৃষক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফসল উৎপাদন ভালো হলে ন্যায্যমূল্য না পেলেও কোনোভাবে চলা যায়। কিন্তু এবার বন্যায় সব কৃষক সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ঋণের দায় পরিশোধের দুশ্চিন্তায় অনেকে গ্রাম ছেড়েছেন। অনেকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন বিভিন্ন কৃষি খেতে।

কমলগঞ্জ উপজেলার বনগাঁও গ্রামের সেলিম মিয়া জানান, লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে তার। প্রায় পুরোটাই ঋণ করেছিলেন। খেত নষ্ট হয়েছে। কিন্তু পাওনাদারের টাকা তো দিতে হবে। এজন্য পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের অন্য একটি কৃষি খেতে কাজ করছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।

একই কথা বলেন কৃষক কাদির মিয়া। তিনি জানান, ঋণের দায়ে কিছুদিন গ্রামের বাইরে ছিলেন। এখন আবার ফিরে এসেছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছেন। পাওনাদারের সঙ্গে আলাপ করে সময় নিয়েছেন। নতুন করে কৃষি খেত করতে পুঁজি দরকার। কিন্তু এখনো ব্যবস্থা হয়নি।

চাষীরা জানান, কমলগঞ্জ উপজেলায় টমেটো চাষ চারার বাজার কয়েক কোটি টাকার। এসব খেতে অস্থায়ী কর্মসংস্থান হয় অনেক মানুষের। বিশেষ করে চা বাগানে বেকার নারীরা কাজ করে সংসার চালান। এবার বন্যায় চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খেতে কাজ করা শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

টমেটো চাষী মনির মিয়া জানান, এক কিয়ার জমিতে (৩০ শতক) টমেটো চাষ করতে প্রায় দুই-আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়। ফলন ভালো হলে - লাখ টাকার ফসল বিক্রি করা যায়। এবার টমেটোর চাষ ভালো হয়েছিল এবং দামও ভালো পাওয়ার কথা। কিন্তু বন্যায় সব শেষ করে দিয়েছে।

কমলগঞ্জ উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। বন্যায় নষ্ট হয়েছে ১২ হেক্টর জমি ৩২ লাখ চারা।

তবে মাঠ পর্যায়ে দেখা যায়, কৃষি বিভাগের তথ্যের চেয়ে জমি ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত চারার পরিমাণ কমপক্ষে ৫০ লাখ। প্রতিটি চারার দাম গড়ে টাকা ধরা হলে কোটি টাকার চারা নষ্ট হয়েছে। কৃষকদের দাবি, ১২-১৬ কোটি টাকার টমেটো খেত নষ্ট হয়েছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য মাঠ পর্যায়ের তথ্যের গরমিলের বিষয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার রায় বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অল্প পার্থক্য হতে পারে। অনেকে চাষের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন, হয়তো আমাদের হিসাবে সেটি আসেনি। তবে ক্ষতি নির্ধারণের কাজ এখনো চলমান। লোকবল সংকটের কারণে কাজের গতি কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা আমরা ৩৫০ জন পেয়েছি। তবে সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। সরকারি অনুদান পাওয়া গেলে বিতরণ করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন