দুর্জয় তারুণ্যের নির্ভয় বলিদান

গুলি লেগে মগজ ছিটকে সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিল সাজিদের

আনিসুর রহমান

জবি শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদ

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে করা আন্দোলনে শহীদ ইকরামুল হক সাজিদ। ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তার মাথার পেছন দিয়ে গুলি ঢুকে ডান চোখের পেছনে আটকে যায়। পরে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। সে সময় মগজ ছিটকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিল। গুলিতে এ শহীদের মাথার একটি অংশ পুরোপুরি বিধ্বস্ত ছিল। এ অবস্থায় টানা ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১৪ আগস্ট না-ফেরার দেশে চলে যান। এমনটিই জানান সাজিদের সহযোদ্ধা, চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্যরা।

সাজিদের বিষয়ে তার চিকিৎসক মশিউল মনির গণমাধ্যমে বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের সময় তার মাথার হাড় কেটে ফেলা হয়। আমরা যখন সাজিদকে হাসপাতালে পাই, তখনই অবস্থা মারাত্মক খারাপ ছিল। মগজ ছিটকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। অস্ত্রোপচার করে দেখা যায়, গুলিতে মাথার একটি অংশ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু বুলেট মাথায় এত কঠিনভাবে আঘাত করেছিল, সেখান থেকে ওভারকাম করা ছিল কঠিন।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ মেধাবী শিক্ষার্থী অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। সাজিদের সহপাঠীদের ভাষ্যমতে, শেখ হাসিনার পলায়নের আগের দিন ৪ আগস্ট মিরপুরের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। মাথার ওপর হেলিকপ্টার দিয়ে টহল দিচ্ছিল র‍্যাব। শিক্ষার্থী-পুলিশের মধ্যে চলছে সংঘর্ষ। একপর্যায়ে আশপাশের বাসার ছাদে অবস্থান নেয় পুলিশ বাহিনী। এ রকম পরিস্থিতিতে ওপর থেকে একটি গুলি এসে লাগে সাজিদের মাথার উপরিভাগে। তাদের দাবি, এ গুলি হতে পারে ছাদে অবস্থানরত পুলিশ কিংবা হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া। তাকে দ্রুত হাই-টেক মাল্টিকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ওই দিনই গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে নেয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ আগস্ট বেলা সোয়া ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। ওই দিন রাত ৯টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শহীদ সাজিদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে গ্রামের বাড়ি সখীপুরে শহীদ ইকরামুল হক সাজিদকে সশ্রদ্ধচিত্তে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তার  শিক্ষক, সহপাঠী ও সহযোদ্ধারা শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।

গ্রামের বাড়ি রাজধানীর অদূরে অবস্থিত টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলায়। তার বাবা জিয়াউল হক ছিলেন বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সাজিদ ছিলেন ছোট। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী এ শিক্ষার্থী রাজধানীর বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১৬ সালে এসএসসি এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ২০১৮ সালে এইচএসসিতে সম্মানজনক ফলাফল নিয়ে কৃতকার্য হন। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিবিএ সম্পন্নের পর একই বিভাগের এমবিএতে ভর্তি হন। তার স্বপ্ন ছিল ‘প্রফেশনাল অ্যাকাউন্ট্যাট অফিসার’ হওয়া। তাই এমবিএর পাশাপাশি ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ থেকে শর্ট কোর্স হিসেবে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টসে অধ্যয়নরত ছিলেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না! এসব কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা নাজমা খাতুন। বিলাপ করে তিনি বলেন, ‘আমার বুকের ধন হারিয়ে গেল। ও আমাকে বলছিল, মা আমার কিছুই হবে না। আমার ছেলে আর ফিরল না। ওর স্বপ্ন হাসিনার বুলেট কেড়ে নিল।’

দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে ছেলে হারানোর শোক সামান্য সার্থক হবে বলে জানান বাবা জিয়াউল হক। যিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রাক্তন মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই যে হাজার হাজার বাবা-মায়ের বুক খালি হয়েছে। শহীদরা জীবন দিয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের আবেদন হলো বাংলাদেশে যেন ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কোনো ধরনের অন্যায়, ঘুস, দুর্নীতি, তদবির না থাকে। বাংলাদেশ যেন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হয়। এটাই আমার চাওয়া।’ ছেলে হারানো এ বাবা আরো বলেন, ‘কেউ ঘুস খাবে না, কেউ দেবে না। সরকারি কাজ হবে বিনা উৎকোচে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি—সব অন্যায় দূর করতে হবে। যেই উদ্দেশ্যে শহীদরা জীবন দিয়েছে সেই উদ্দেশ্য যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলেই শহীদদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। শহীদদের রক্তের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন