দেয়ালে দেয়ালে বিদ্রোহগাথা

‘‌বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’

শফিকুল ইসলাম

আবু সাঈদের প্রতীকী ছবির সামনে সন্তানদের ছবি তুলছেন এক মা ছবি: মাসফিকুর সোহান

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। খালি গায়ে বুকে-পিঠেস্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক স্লোগান লিখে রাজপথে নেমে এসেছিলেন নূর হোসেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের সেই ছবি আজও হয়ে আছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। কবি শামসুর রাহমানকে স্পর্শ করেছিল সেই ঘটনা। যার প্রকাশ ঘটেছেবুক তার বাংলাদেশের হৃদয় কবিতায়। তিন যুগ পর কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের বন্দুকের সামনে দুই হাত উঁচু করে বুক পেতে দেয়া শহীদ আবু সাঈদের অসীম সাহসিকতাই যেন বলে দিচ্ছে আবু সাঈদের বুক যেন বাংলাদেশের হৃদয়। পুরো আন্দোলনজুড়ে আবু সাঈদের হাত উঁচু করে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেয়ার চিত্রই হয়ে ওঠে এক প্রতিবাদের প্রতীক। আনুপ্রেরণা জুগিয়েছে শত শত শহীদ ছাত্র-জনতাকে। সাঁজোয়া যানের সামনে স্কুলছাত্রকেও দেখা গেছে বুক পেতে দিয়ে বলতে, ‘আঙ্কেল গুলি করেন দেয়ালে দেয়ালে স্থান পাওয়া আবু সাঈদের সেই প্রতীকী ছবির সামনে এখনো তার সেই ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে দেখা যায় আগামীর প্রজন্মকে। যেন তারা একেকজন আবু সাঈদ। আর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি ক্যামেরাবন্দি করছেন মা।

রাজধানী ঢাকাসহ মফস্বল শহর, স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস। হাতের লেখা কিংবা আঁকা যতটা আনাড়িই হোক না কেন প্রতিটি দেয়াল যেন আন্দোলনের দিনগুলোর হারানো শোক, অভ্যুত্থান-পরবর্তী শান্তি, সহমর্মিতা, সংস্কার আর নতুন বাংলাদেশের বার্তা দিচ্ছে। যে দেয়াল ছিল স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিবাদের ভাষায় বিবর্ণ সে দেয়াল হয়ে উঠল আরেক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের হাতে রংতুলি আর স্প্রে ক্যান নিয়ে নেমে পড়েন রাস্তায়। চিত্র শুধু ঢাকার নয়, বরং সারা দেশের বিভিন্ন শহরের অলিগলির চিত্রই যেন রঙে রঙে পাল্টে গেছে। দেয়ালের ভাষাই যেন এখন জনমানুষের মনের ভাষা। গ্রাফিতিতে স্থান পাওয়া বিষয়বস্তু দেখলেই বোঝা যায়রাজনীতিবিমুখ প্রজন্ম বলা জেনজিরা কতটা রাজনীতি সচেতন।

মুছে যাওয়া বিপ্লবের রঙ

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে তার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন কোনো কথা বলার যেমন স্বাধীনতা ছিল না, তেমনি স্বাধীনতা ছিল না লেখার। হোক সেটা কংক্রিটের দেয়াল কিংবা ফেসবুকের ওয়াল। আগস্টের আগে আন্দোলনের দিনগুলোয় শিক্ষার্থীদের যেসব দেয়াল লিখন চোখে পড়ে তার অধিকাংশই খুব অল্প সময়ে লিখে কোনোমতো জায়গা প্রস্থান করেছেন তারা। অনেকটা ভয়, আতঙ্ক আর শঙ্কা নিয়েই ছিল দেয়াল লিখনগুলো। সেখানে ফুটে উঠেছে নানা দাবি, ক্ষোভ, প্রতিবাদ আর বিপ্লবের চিত্র। আর অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেয়াল লিখন ছিল মূলত শৈল্পিক ছাপ, রাষ্ট্র মেরামত কিংবা সংস্কারের আহ্বান, নতুন বাংলাদেশের আহ্বান। জায়গা পেয়েছে আন্দোলনের দিনগুলোয় শিক্ষার্থীদের ওপর প্রশাসনের মিথ্যা বুলির প্রতিচ্ছবি আর বর্বরতার চিত্রও। অভ্যুত্থান-পূর্ব গ্রাফিতি মুছে ফেলা হবে এমন আশঙ্কা থেকে - আগস্টের মাঝে ঢাবি, বুয়েট ঢাকার বনশ্রী থেকে ১৯৭টি গ্রাফিতির ছবি সংগ্রহ করেছেন হিপহপ কালচার গবেষক স্কুলশিক্ষক মুজাহিদুল ইসলাম তিমু। তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক সপ্তাহেই পুরনো সব গ্রাফিতি মুছে সেখানে নতুন করে দেয়াল লিখন করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, গ্রাফিতি আর স্ট্রিট আর্টের পার্থক্য আছে। গ্রাফিতি যেখানে বিনা অনুমতিতে লেখা হয়, সেখানে স্ট্রিট আর্ট অনুমতি নিয়েই আঁকা হয়। জেনজিরা বলছে, তারা দেয়ালের সৌন্দর্য ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু এত বড় অভ্যুত্থানের স্মৃতি এত দ্রুত মুছে যাবে তা ভাবিনি। ওইসব গ্রাফিতির জায়গায় নতুন দেয়াল লিখন (স্ট্রিট আর্ট) আসছে কিন্তু সেগুলোয় বিপ্লবের আবেদন নেই। নতুন স্ট্রিট আর্টে নান্দনিকতা রাষ্ট্র সংস্কারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

আন্দোলনের দিনগুলোয় গ্রাফিতি

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকালে গ্রাফিতি বা দেয়াল লিখন মুছে করা নতুন গ্রাফিতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে অনেক প্রতিবাদী ভাষা। ওই সময়ের দেয়াল লিখনের মধ্যে অন্যতম ছিলকে রাজাকার?, না দিয়ে অধিকার বলে রাজাকার, লাশ দাফন হবে কোন কোটায়, মেধা হত্যার বিচার চাই, লাশের ভেতর জীবন দে নাইলে গদি ছাইড়া দে, দেশটা কারো বাপের না, ১৮ কোটি বুলেট আছে তোদের?, স্বৈরাচার আর কয়দিন, অধিকারের লড়াই, বয়স হার মানার নয়, নেট নিয়া মারে ঝলক নাম তার nigga পলক, মোরা সাঈদ, মোরা রাফি, মোরা মুগ্ধ সময়ের আলোড়নে হব সিংহ, পানি লাগবে কারো? পানি?, শহীদ মীর মুগ্ধ, দফা, হাসিনাকে নামতে হবে, বিপ্লবের রং মোছা যায় না, আমরা ৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি, শোকের মাস জুলাই আগস্ট নয়, শেখ হাসিনারে চিপায় ফালান, বাংলা ছাড়, বদলা নিন, অস্ত্র কাড়ুন জনগণের বাহিনী গড়ুন, তারা কি ফিরবে আজ সুপ্রভাতে, গণজোয়ার, খুনি কে?, চলছে রক্তের ফাগুন, দেশ আমার কারো বাপের না, এখানে FASCISM নিষিদ্ধ, গদি ছাড় স্বৈরাচার, কুমিরের কান্না, খুনি হাসিনা, বিবেক কোথায়?, বিবেক লাগবে?, ওরা মোর মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়, রক্ত চোষা শেখ হাসিনা ভালো হয়ে যা, চুপ করতে চাইলেই কি চুপ করানো যায়, লাশের দেশ, স্বৈরাচার শাসক, রক্ত! রাজাকার, এত সহজেই?, নাটক কম কর পিও, জয় বাংলা Gen Z সামলা, বুকের ভেতর অনেক ঝড় বুক পেতেছি গুলি কর, লাগবে না তোর অধিকার, ফিরিয়ে দে ভাই আমার, চব্বিশের জনযুদ্ধ ইত্যাদি।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী স্ট্রিট আর্ট

অভ্যুত্থান শেষে দেয়ালের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে নতুন রঙে সাজে সব দেয়াল। এসব দেয়ালে স্থান পেয়েছে রাজনৈতিক স্যাটায়ার, দেশ সংস্কার, আর নতুন বাংলাদেশের আহ্বান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোশেখ হাসিনা পালায় না, দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় জানালা দিয়ে, ব্লাডি জুলাই, দিস ইজ নিউ বাংলাদেশ, ফ্যাসিস্টকে তাড়িয়েছি এখন ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাকেও তাড়াতে হবে, স্বাধীনতা এনেছি অধিকারও আনব, স্বাধীনতার সূর্যোদয়, সব টা আয়না ভেঙে দাও, বলেছিল রাজাকার ভেঙে দিলাম রাজার আকার, তুমি আমি আমরাই বাংলাদেশ, বিকল্প কে? আমরাই বিকল্প, বড় করেস্বাধীনতা’, তে হত্যাকারী, তে হাসিনা, গণহত্যা ....১৩.....২৪বিচার বিভাগের সংস্কার চাই, খুনি হাসিনার বিচার চাই, আমার ভাই কবরে খুনি কেন বাহিরে, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত, পলকে পলকে চলে যেত, পলকের নেট রাখি কোই, রেসপেক্ট দ্য জেন-জি, রেডিয়েট পজিটিভিটি, এই আকাশ শহীদ আবু সাঈদের, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার আদিবাসী সুরক্ষার দায়িত্ব সবার, আমাদের নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ, চাঁদাবাজি বন্ধ করো, আমার রঙে স্বাধীনতা, আদালত তোমার বিচার করবে কে?, ৩৬শে জুলাই, এখন দরকার জনগণের সরকার, স্বজন হারানোর ব্যথা আমিও বুঝি, গুলি করি, মরে একটা, একটাই যায় স্যার। বাকিডি যায় না প্রভৃতি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন