উৎপাদনে বড় ধাক্কা কেজিতে মুরগির দাম বাড়ল ১০ টাকা

দেবব্রত রায়,চট্টগ্রাম ব্যুরো

ছবি : বণিক বার্তা

টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরের কয়েক হাজার মুরগির খামার। মারা গেছে লাখ লাখ মুরগি। এ চার জেলায় আগে যেখানে গড়ে প্রতিদিন ডিমের উৎপাদন ছিল প্রায় ৪০ লাখ পিস। এখন তা ২০ লাখে নেমে এসেছে। বন্যাকবলিত অন্য জেলায় কমেছে আরো দেড়-দুই লাখ পিস ডিম উৎপাদন। বাজারে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে মুরগির দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। অনেক স্থানে ডিমের দামও বাড়তে শুরু করেছে।  

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন ডিমের গড় চাহিদা চার-সাড়ে চার কোটি পিস এবং মুরগির মাংসের চাহিদা ৫ হাজার ২০০ টন। এর মধ্যে ব্রয়লার থেকে ৩ হাজার ২০০ এবং সোনালি ও লেয়ার থেকে প্রায় ১ হাজার ৭০০ টন সরবরাহ হয়। দেশে ডিম উৎপাদন হয় প্রায় চার কোটি পিস। বন্যায় চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরের খামারগুলোয় দৈনিক ডিম উৎপাদন হতো প্রায় ৪০ লাখ পিস। বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। 

সংগঠনটির দাবি, ১৬ আগস্ট থেকে বৃষ্টিপাত ও বন্যায় ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে ৭৫ লাখ মুরগি মারা গেছে। এর মধ্যে ব্রয়লার মুরগি প্রায় ৪০ লাখ, সোনালি প্রায় ৩০ লাখ ও লেয়ার মুরগি মারা গেছে অন্তত পাঁচ লাখ। এতে কেবল মুরগিতেই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯২ কোটি টাকা। আর ডিম, ফিড ও অবকাঠামো খাতে ক্ষতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকার বেশি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর যদিও বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদে বিভাগটির বাকি আট জেলায় প্রায় ২৯ লাখ মুরগির মৃত্যু হয়েছে বন্যায়। 

বিপিএর সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যায় শুধু চার জেলাতেই বিভিন্ন জাতের প্রায় ৭৫ লাখ মুরগি মারা গেছে। ফলে মাংস উৎপাদনে ঘাটতির পাশাপাশি কয়েক দিনের ব্যবধানে ডিম উৎপাদন কমেছে ২০-২২ লাখ পিস। একেকটি ডিম পাড়া লেয়ার মুরগির পেছনে শুরু থেকে পূর্ণ বয়স্ক পর্যন্ত লালন-পালন করতে হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। বন্যায় যে পরিমাণ লেয়ার মুরগি মারা গেছে তাতে ডিম উৎপাদন স্বাভাবিকে ফিরতে আরো সময় লাগবে।’ 

সরকারিভাবে চট্টগ্রাম বিভাগে মুরগি মারা যাওয়ার যে তথ্য দেয়া হচ্ছে সেটিকে অসত্য দাবি করে বিপিএ সভাপতি বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যে গরমিল আছে। মাঠ পর্যায়ে গিয়ে খোঁজ-খবর নিলেই সে গলদ ধরা পড়বে।’ 

ক্ষতি পুষিয়ে নিতে খামারিদের সহজ শর্তে, বিনাসুদে, জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে সুমন হাওলাদার আরো বলেন, ‘সরকারকে জামানত নেয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। কভিডের সময় সরকার পোলট্রি খাতে ৭০২ কোটি টাকা প্রণোদনা দিলেও প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের সবাই সে অর্থ পাননি। খামারিদের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকারকে প্রণোদনা দিতে হবে।’ 

এদিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২৯ আগস্টের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বিভাগের ১১ জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ৪৭ লাখ ৯১ হাজার ৮২৮ মুরগি। এর মধ্যে ২৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫০৩টি মারা গেছে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ফেনীতে; ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৫১০টি। এছাড়া চট্টগ্রামে ৩ লাখ ১৮ হাজার ১৩২, নোয়াখালীতে ২ লাখ ১৩ হাজার ১০২ ও লক্ষ্মীপুরে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১০টি মুরগি মারা গেছে। এ বিভাগে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৪৮ হাঁস মারা গেছে, যার মধ্যে ফেনীতে মারা গেছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৭২টি। চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ২ হাজার ৫৪৯টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভাগে শুধু মুরগি খাতে কত টাকার ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করা না হলেও গরু, মুরগি, ছাগলসহ অন্যান্য প্রাণী, খাদ্য, ডিম ও অবকাঠামো খাতে সব মিলিয়ে ৪৫০ কোটি ২৭ লাখ ৬৯ হাজার ৩৮০ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। 

চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. একেএম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরে সবচেয়ে বেশি মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদন হয়। এসব সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলায়। তবে চলমান বন্যায় এসব জেলায় ডিম উৎপাদন এখন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে, মাংস উৎপাদনেও প্রভাব পড়েছে। আমরা খামারিদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি।’ 

ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা বলছেন, বন্যার পানি এবার যেভাবে ঢুকেছে তাতে খামারের মুরগি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়ার সুযোগ পাওয়া যায়নি। এক রাতেই সব শেষ হয়ে যায়। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা থেকে দৈনিক প্রায় দেড় লাখের মতো ডিম বাজারে যেত। এখন সেটা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমেছে। জেলার অন্যান্য উপজেলার অবস্থা আরো ভয়াবহ। বন্যাকবলিত এসব এলাকার হাজার হাজার খামারি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সরকার থেকে এখন প্রণোদনা না দেয়া হলে অনেককেই এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত খামারি ইমদাদুল হক শিমুল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার খামারের ১৩ হাজার লেয়ার মুরগির মধ্যে ১২ হাজারের বেশি মারা গেছে। এক হাজার মুরগির পেছনে প্রায় ৮-১০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। আর একটি লেয়ার মুরগি বছরে ৩২০টির বেশি ডিম দেয়। খামারের সঙ্গে থাকা আমার মাছের পুকুরও ভেসে গেছে। মাছ-মুরগি মিলিয়ে আমার ক্ষতি প্রায় ৭৫ লাখ টাকা।’ 

চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন পাইকারি বাজারের তথ্যমতে, বন্যার আগে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে প্রতি পিস ডিমের দাম ছিল ১১ টাকা ৫০ থেকে ৭০ পয়সা। তবে বন্যা-পরবর্তী গত শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ১৩ টাকা ৫০ পয়সা পিস। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি ১৫ আগস্ট কেজিপ্রতি ১৬০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল ছিল ১৭৫ টাকা। ২৪০-২৫০ টাকার সোনালির কেজি ২৯০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গতকাল। খুচরা বাজারে দাম আরো বেশি বলে জানিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। 

রিয়াজউদ্দিন বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী হাজী আবদুল হামিদ সওদাগর বণিক বার্তাকে জানান, চট্টগ্রাম শহরের পাইকারি বাজারে ডিমের সরবরাহ বন্যার কারণে কমে গেছে। মুরগিরও একই অবস্থা। ফলে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে অনেকটাই দাম বেড়েছে।  

এদিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৬৫ টাকা কেজি দরে, গত সপ্তাহে যা ছিল ১৬০ টাকা। সোনালি ও লেয়ার মুরগিও গত সপ্তাহের চেয়ে ৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। লেয়ার মুরগি ৩০০ ও সোনালি মুরগি ২৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।

কারওয়ান বাজারের মুরগি বিক্রেতা মো. রাসেল বলেন, ‘গত সপ্তাহে মুরগির দাম কিছুটা কমেছিল, তবে এ সপ্তাহে বেড়েছে। দোকানভেদে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে এসব মুরগি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন