আত্মগোপনে ঠিকাদার, স্থবির খুলনা নগর উন্নয়নকাজ

শুভ্র শচীন I খুলনা

খুলনা নগরের নিউমার্কেটে সড়ক খুঁড়ে রাখা হয়েছে। পাইপ ও ম্যানহোল নির্মাণ করা হলেও সড়ক সংস্কার হয়নি ছবি : নিজস্ব আলোকচিত্রী

খুলনা নগরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের জুনে শুরু করে ওয়াসা। প্রকল্পের আওতায় নগরের বিভিন্ন সড়কে পাইপলাইন, ম্যানহোল বসানো হচ্ছে। ৫৯ কিলোমিটার পয়োনিষ্কাশন পাইপ ও সাড়ে চার হাজার ম্যানহোল নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সড়কগুলো সংস্কার করা হয়নি। ৫ আগস্টের পর ৩৫টি কাজের ঠিকাদার আত্মগোপনে রয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ও হামলার আশঙ্কায় চায়না টেকনিশিয়ানরা নিরাপদ বোধ না করায় সড়কের কাজ শুরু করেননি। ফলে পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে।

নগরবাসী বলছেন, সিটি করপোরেশনের তদারকির অভাব, দুর্নীতি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খামখেয়ালির কারণে উন্নয়নকাজের ধীরগতিতে ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। সড়ক মেরামত ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের অন্তত ৩৫টি কাজের ঠিকাদার আত্মগোপনে রয়েছেন। নগরের কেডিএ জীবনবীমা অফিস থেকে গোবরচাকা ন্যাশনাল স্কুল পর্যন্ত খোঁড়াখুঁড়ির কারণে যান চলাচল বন্ধ। এছাড়া ন্যাশনাল স্কুল থেকে গাবতলা হয়ে মোল্লাবাড়ি মোড় পর্যন্ত সড়ক উন্নয়নকাজের কারণে যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। একইভাবে করিমনগর, শান্তিনগর ড্রেন নির্মাণকাজ, ক্ষেত্রখালি খাল খনন, সুরিখালে ড্রেন নির্মাণ, কলেজ বাউন্ডারি সড়ক, বিআইডিসি সড়ক, সোনাডাঙ্গা তৃতীয় ফেজের ১ নম্বর সড়ক, খানজাহান আলী রোডের পিটিআই থেকে রূপসা পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণকাজ, খালিশপুর ১৮ নম্বর সড়ক, বয়রা মেইন সড়ক, জাহিদুর রহমান সড়ক, টুটপাড়া মেইন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে যাতায়াতে দুর্ভোগের শেষ নেই। কবে নাগাদ এ কাজ শেষ হবে তা বলতে পারছেন না কেউ।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের সময় সিন্ডিকেটের কারণে প্রভাবশালী ও দলীয় ঠিকাদাররাই বেশি কাজ পেয়েছেন। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় খোঁড়াখুঁড়ির পর বছরের পর বছর ধরে ওইসব কাজ ফেলে রাখা হয়।

এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. মশিউজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নাগরিক ভোগান্তি কমাতে সময়মতো ওয়াসার কাজ শেষ করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সময়মতো কাজ শেষ না করায় এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিয়াউল ট্রেডার্স ও হোসেন ট্রেডার্সকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ১২ জন ঠিকাদারকে ‘কেন কার্যাদেশ বাতিল করা হবে না’ মর্মে শোকজ করা হয়েছে। আরো ২৫টি কাজের ঠিকাদারকে চিঠি দেয়া হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালের জুন থেকে খুলনা নগরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করে ওয়াসা। প্রকল্পের আওতায় নগরের বিভিন্ন সড়কে পাইপলাইন, ম্যানহোল বসানো হচ্ছে। পয়োনিষ্কাশন পাইপ বসাতে এরই মধ্যে শতাধিক সড়ক খুঁড়ে ৫৯ কিলোমিটার পাইপ ও সাড়ে ৪ হাজার ম্যানহোল নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ শেষ হলেও সড়কগুলো সংস্কার করা হয়নি। এজন্য সিটি করপোরেশনকে দায়ী করছে ওয়াসা। তিনটি ধাপে সিটি করপোরেশনকে ৯২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেসব সড়কে সংস্কারকাজ করেনি।

এ ব্যাপারে ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক খান সেলিম আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কগুলো যাতে মেরামত করা হয়, এজন্য সিটি করপোরেশনকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। তারা দ্রুত সড়ক মেরামত করলে ভোগান্তি কমবে।’

এদিকে দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় ঝোপঝাঁড়ে ঢাকা পড়েছে নগরের সড়ক বিভাজক। আগাছা বিভাজক ছাপিয়ে চলে এসেছে সড়কে। দুই পাশে নেই কোনো রোলিং ও ট্রাফিক সাইনও। পুরোপুরি অরক্ষিত বিভাজকে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড। মজিদ সরণির সড়ক বিভাজক, যশোর সড়কের ডাকবাংলো থেকে শিববাড়ী, জলিল সরণি রোডের বয়রা কলেজ মোড় থেকে বয়রা বাজার, রূপসা মোড় থেকে রূপসা বাস টার্মিনাল, কেডিএ অ্যাভিনিউ সড়কের রয়্যাল মোড় থেকে শিববাড়ী, এমএ বারিক সড়কের গল্লামারী থেকে সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল, জব্বার সরণি সড়কের মিনা বাজার থেকে পুরনো রেলস্টেশন, যশোর রোডের শিববাড়ী থেকে জোড়াগেট বিভাজকের একই দশা দেখা গেছে।

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ৪৫ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনে ৩১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সিটি করপোরেশন অধিক্ষেত্রে ৩৫২টি প্রতিষ্ঠানকে সড়ক ও বিভাজকে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন ও সৌন্দর্যবর্ধনে বরাদ্দ দেয়া হয়।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজ্ঞাপনী ও বিলবোর্ড ব্যবসায়ীরা নগরের সড়ক বিভাজক সৌন্দর্যবর্ধন ও বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের জন্য বরাদ্দ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিলেও সিটি করপোরেশনের রাজস্ব পরিশোধ করে না। বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ কর বকেয়া রেখে একসময় তারা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৩৫২টি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের কাছে করপোরেশনের বকেয়া পাওনা সাড়ে ১৯ কোটি টাকা। বিলবোর্ড ও সড়ক বিভাজকে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করেও গত ১০ বছরে তারা এ কর পরিশোধ করেনি। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান টাকা বকেয়া রেখে চলে গেছে। কাজের মেয়াদও নবায়ন করেনি তারা। সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড-শিববাড়ী সড়কের রিজেন্স অ্যাড ৮ লাখ টাকা এবং সোনাডাঙ্গা-বয়রা বাজার সড়কের ফরনেক্স ১৬ লাখ টাকা বকেয়া রেখে চলে যায়। প্রতিষ্ঠান দুটি অনেক ইউনিপোল ও বিলবোর্ড রেখে যায়। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন