বন্যায় চালের দাম কিছুটা বাড়লেও মজুদ পর্যাপ্ত

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলা। এতে মানুষের বসতভিটা, ফসলি জমি ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দীর্ঘ সময় সড়ক ও রেলপথ বন্ধ থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। গুরুত্বপূর্ণ এ পথে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়ে সারা দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায়। এতে চালের বাজারে কেজিপ্রতি দাম বেড়ে যায় ৩-৪ টাকা। যদিও দেশের খাদ্য মজুদের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। বিশেষ করে চালের মজুদ তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ১ লাখ ৫৮ হাজার টন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৫৬ হাজার টনে। 

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্যার কারণে চালের দাম কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে খোলাবাজারে বিক্রি বাড়াতে হবে। কারণ এবার চালের সরকারি-বেসরকারি পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তবে বাজারে নজরদারি জোরদার করার পরামর্শও দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৫২-৫৫ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৫০-৫৪ টাকা। মাঝারি ও সরু চালের দামও কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়েছে। 

কেজিতে ২-৩ টাকা বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে কারওয়ান বাজারের চাতাল রাইস মিলের বিক্রেতা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মোকাম থেকেই বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কম দামে কিনতে পারলে আমরাও কমে বিক্রি করব।’

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৮ আগস্ট পর্যন্ত দেশে খাদ্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৭২ হাজার ৫৫৮ টন। এর মধ্যে চাল ছিল ১৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৯ টন। তিন সপ্তাহ আগে ৭ আগস্টও চালের মজুদ ছিল ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৪ টন। অর্থাৎ দেড় লাখ টনের বেশি মজুদ বেড়েছে। তবে মজুদ বাড়লেও এ সময়ে খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়ছে।

চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বন্যাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। কারওয়ান বাজারের এমআর ট্রেডার্সের আনিস খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যায় মাল কম আসায় দাম বেড়েছে। তাছাড়া ত্রাণ হিসেবে অনেকে চাল কিনতে আসছেন। ফলে চাল বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেড়েছে। সরবরাহের তুলনায় বিক্রি বাড়ায় মিলাররা দাম বাড়িয়েছে। তাই কেজিতে ৩-৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সরকার চাপ দিলে হয়তো দাম কমবে। নয়তো সিজন শেষে আরো বেড়ে যেতে পারে চালের দাম।’

সাধারণত আমন ও বোরো দুই মৌসুমে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ টন, যা বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া গত বোরো মৌসুমেও রেকর্ড চাল উৎপাদন হয়। ২ লাখ ২২ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদন হয় ২ লাখ ২৪ হাজার টন। উৎপাদনের এমন রেকর্ড সৃষ্টি হওয়ায় গত অর্থবছর কোনো চাল আমদানি করতে হয়নি। গত অর্থবছর দেশে চালের কোনো সংকটও তৈরি হয়নি। ফলে চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরেও চাল আমদানি করা লাগবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে দেশে সরকারিভাবে কোনো চাল আমদানি হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানি হয় ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়। 

বন্যার কারণে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হলেও বাজার তদারকি জোরদার করার কথা বলছেন বিশ্লেষকরা। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ন্যূনতম ১২ লাখ টন চালের মজুদ থাকতে হয়। সে হিসেবে আমাদের মজুদ এখন বেশি আছে। গত আমন ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন বেশি হওয়ায় মজুদ বেড়েছে। এবার চালের কোনো অভাব নেই। বেসরকারি ও কৃষক পর্যায়েও যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। চাল আমদানিরও প্রয়োজন পড়বে না হয়তো। তাই দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীরা বন্যার কথা বললেও তারা মূলত আগের মতো কারসাজির চেষ্টা করছে।’

দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের করণীয় নিয়ে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সরকারের খোলাবাজারে বিক্রি বাড়ানো উচিত। এখন কিছুটা ট্রাকসেল করা হলেও ওএমএস সেভাবে শুরু হয়নি। মজুদ গুদামে রেখে দিলে বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না। তাই এখনই সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। তাছাড়া বাজার নজরদারি বাড়াতে হবে। মূলত দুর্বল ব্যবস্থাপনায় চালের দাম বাড়ে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন