ব্যাংক ও আর্থিক খাত

অপরাধ ব্যক্তি ও পর্ষদের, শাস্তি আমানতকারী ও প্রতিষ্ঠানের

ইমামূল হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় গত দশকে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে ব্যাংকটির প্রয়াত চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার ও তার সন্তানদের নেতৃত্বাধীন পর্ষদ। সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। ঋণের নামে ব্যাংকটি থেকে বের করে নেয়া হয়েছে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা। যদিও এ সময়ে ব্যাংকটির পর্ষদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ দেয়া পর্যবেক্ষক ছিলেন। ব্যাংকটির পর্ষদের সব সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনও পেয়েছিল। কিন্তু কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান জয়নুল হক সিকদার। এরপর ব্যাংকটির অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগী হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় ব্যাংকটির ওপর। বন্ধ করে দেয়া হয় ঋণ বিতরণ কার্যক্রম। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন ন্যাশনাল ব্যাংকের ভালো গ্রাহকরা। আর্থিক দুর্দশার কারণে ব্যাংকটির মাধ্যমে অনেক গ্রাহকই ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যর্থ হন। এখন আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধেও হিমশিম খাচ্ছে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকটি। 

২০১৬ সাল-পরবর্তী সাত বছর ধরে অনিয়মে ক্ষতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলোর একটি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। নামে-বেনামে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া হয় অন্তত ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। আর সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংকে অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগী হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটি থেকে আমানতের অর্থ উত্তোলন ও ঋণ বিতরণে আরোপ করা হয় নানা বিধিনিষেধ। এতে ব্যাংকটির আমানতকারীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভালো ঋণগ্রহীতারা। দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংকটির এটিএম বুথ থেকেও চাহিদা অনুযায়ী অর্থ উত্তোলন করা যাচ্ছে না। নগদায়ন হচ্ছে না বিভিন্ন ব্যাংকে জমা পড়া ব্যাংকটির শত শত চেক।

ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের মতোই নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এসব ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যক্তির অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আমানতকারীদের। বিপদের মুখে পড়েছে এসব ব্যাংকের গ্রাহক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোও। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্ষদ ও ব্যক্তির অপরাধের জন্য প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেয়া উচিত হবে না। কোনো ব্যাংক চূড়ান্ত বিপদে পড়লে সেখানকার কর্মসংস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাবেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভালো ঋণগ্রহীতারাও ক্ষতির মুখে পড়বেন। এর বিরূপ প্রভাব অর্থনীতির ওপর পড়বে। ব্যাংকে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমানতকারী কিংবা প্রতিষ্ঠান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক অর্থ সচিব এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির সম্পর্ক আছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। আমানতকারীরা চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছেন না। এটি আমানতকারীদের জন্য এক ধরনের শাস্তি। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতকারীদের অর্থ আটকে পড়েছে। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও যাতে সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহায়তায় এক দশক আগে একাই চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানা দখলে নিয়েছিলেন আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার, পিকে হালদার নামেই যিনি আর্থিক খাতে বেশি পরিচিত। পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) ও এফএএস ফাইন্যান্স নামের চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। 

পিকে হালদারের দুর্নীতির শিকার এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। কয়েক বছর ধরেই আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তারা নিজেদের সঞ্চিত অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য মানববন্ধন, মিছিল, সমাবেশের মতো কর্মসূচিও পালন করে আসছেন। যদিও আমানতকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পরিচালিত হচ্ছে আদালত ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গঠিত পর্ষদের মাধ্যমে। আর পিকে হালদার এখন আটক আছেন ভারতের জেলে। 

এগুলোর বাইরেও দেশের আরো অন্তত এক ডজন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান মারাত্মক সংকটে পড়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়েছে। আর দুর্বল হয়ে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আত্মসাতের অর্থের ভাগ পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই। বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে কিছু ব্যাংককে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন হঠাৎ করে সব সুবিধা বন্ধ করে দিলে ব্যাংকগুলো টিকে থাকতে পারবে না। ২০১৬ সালের দিকে এক পদ্মা ব্যাংকের কারণে পুরো ব্যাংক খাতের ভিত কেঁপে উঠেছিল। এখন পাঁচ-সাতটি ব্যাংক একযোগে অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এতে ব্যাংক খাতের পাশাপাশি গোটা অর্থনীতিই অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।’

আমানতের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় মঙ্গলবার ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটির জন্য একটি নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয়া হয়েছে। আর গতকাল ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়েছে। এ অর্থ আদায় না হওয়া পর্যন্ত গ্রুপটির কোনো পরিচালক ব্যাংকটির পর্ষদে থাকতে পারবেন না। ইসলামী ব্যাংকের যেসব শেয়ার এস আলম গ্রুপের হাতে আছে, সেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এসব শেয়ার বেচাকেনা করা যাবে না। ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থ ফেরত দিলে তারা মালিকানায় ফিরতে পারবেন। আপাতত ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হবে। তারাই ব্যাংকটি পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখবেন।’

এর আগে মঙ্গলবার ব্যবসায়ী নেতারা নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে যান। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে গভর্নর সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার ওপর আমানতকারীদের আস্থা না থাকলে সে ব্যাংক চলতে পারে না। সবসময় এমন ব্যাংককে উদ্ধার করতে যাওয়া ঠিক নয়। এ পরিস্থিতির জন্য ওই ব্যাংক কর্তৃপক্ষই দায়ী; তারা নিজ দায়িত্বে এ অবস্থায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নতুন করে তাদের কোনো সহায়তা দেয়া হবে না। যারা দোষী, তাদের ধরা হবে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হবে না।’

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো ব্যাংকের চেক যাতে প্রত্যাখ্যাত না হয়, বাংলাদেশ ব্যাংককে সেটি নিশ্চিত করার জন্য বলেছি। গত সপ্তাহে ব্যাংক থেকে ২ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করা গেছে। চলতি সপ্তাহে উত্তোলনসীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। আশা করছি, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি দেখা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন