বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

মানসিক ট্রমা কাটছে না আহত শিক্ষার্থীদের

শফিকুল ইসলাম

ছবি: ফাইল/তাওহীদুজ্জামান তপু

অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সরকারি বাহিনী ও দলীয় কর্মীদের হামলা, গুলিবর্ষণ, রাতের আঁধারে বাসায় বাসায় তল্লাশি, নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক, গুম, নির্যাতন, মামলা—শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এমন সব অভিজ্ঞতা যেন এক বিভীষিকাময় কালো অধ্যায়। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবি থেকে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পতন হলেও আন্দোলনের দিনগুলোয় শিক্ষার্থীরা যে বর্বরতা ও নৃশংসতার শিকার হয়েছেন তা বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনো। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না অনেকেই। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে এক অকল্পনীয় চিত্র। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যে প্রশাসন ছাত্র-জনতার নিরাপত্তার দায়িত্বে তারাই যেন হয়ে উঠেছিল নিরাপত্তার বড় হুমকি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে শত শত শিক্ষার্থী-জনতার রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হবে, গুলিবিদ্ধ হয়ে হাত-পা, চোখ হারাবে, পঙ্গুত্ব বরণ করবে বিষয়টিই মানতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। গতকাল রোববার থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি খুলে দেয়া হয়েছে। তবে ট্রমা কাটিয়ে এখনই পড়ার টেবিলে বসতে পারছেন না এসব শিক্ষার্থী। কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে ১৫ জুলাই নৃশংসভাবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর প্রথম হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এ হামলায় গুরুতর আহত হন ঢাবির তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ও এসএম হলের আবাসিক ছাত্র মাহমুদুল হাসান রায়হান। মাথায় ধারালো অস্ত্রের কোপে সাদা টি-শার্ট রক্তে লাল হয়ে যায়। মাথায় প্রায় তিন ইঞ্চির মতো ক্ষতের তৈরি হয়, মোট তিনটি কোপ লাগে মাথায়, সারা শরীরেও লাঠির আঘাত। এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘‌এখনো আতঙ্কে আছি। অনেকের টার্গেটে রয়ে গেছি। এখনো ফোন করে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। বাবা-মা বলেন পড়াশোনার দরকার নেই। বাড়িতে চলে আয়। কখনো রাজনীতি করিনি। যেকোনো সময় আবার হামলা হতে পারে এটাই এক আতঙ্ক। পরিস্থিতি আসলে কোন দিকে যাবে সেটাও জানি না।’

দৈনন্দিন জীবনে বড় প্রভাব ফেলেছে জানিয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘‌সরকারি বাহিনী ও সরকারদলীয় লোকের হামলার ঘটনা যা দেখেছি সেটার একরকম প্রভাব রয়েছে আবার নিজে সরাসরি যে হামলার শিকার হয়েছি তার প্রভাবটা তীব্র। স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য এমন হামলা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। ৪ আগস্ট বাড্ডা-নতুন বাজার থেকে রিকশা নিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার সময় লিংক রোডে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফোন চেক করেন। লাল প্রোফাইল দেখেই হঠাৎ এলোপাতারিভাবে ছাত্রলীগ আমাদের দুজনের ওপর রড, লাঠি, পাইপ নিয়ে হামলা করে। বর্বরভাবে আমাদের পেটানো হয়। আমার বন্ধুর এক হাত ভেঙে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেয়ায় এমন দমন-নিপীড়নের মুহূর্তগুলো বার বারই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।’

গত ১৮ জুলাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে এলাকা থেকে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির সদস্যদের হাত উঁচু করে ক্যাম্পাস ছাড়তে দেখা যায়। দেশের আর কোনো ক্যাম্পাসে এমন চিত্র দেখা যায়নি, যেখানে পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাবের সদস্যরা সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করে ক্যাম্পাস ছাড়া হয়েছেন। এদিন হামলার শিকার বিশ্ববিদ্যালয়টির মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী দোদুল ফরাজী বলেন, ‘পুলিশ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে রণক্ষেত্র পরিণত হয় ববি ক্যাম্পাস। ওইদিন আমার ১২টি রাবার বুলেট হাতে-পায়ে-বুকে-পিঠে বিদ্ধ হয়। এদিনের পর থেকে আমিসহ আহতরা একরকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।৷শরীরের ভেতরে রক্তপাত নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।৷ এছাড়া আমার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।৷ যার জন্য পরিবারসহ সহপাঠীরা ফোন দিচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ফোনও বন্ধ করে রাখতে হয়েছে। আমি এখনো ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না।’

গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ ক্যাম্পাসেই আন্দোলন করে আসছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৬ জুলাই রাতে ইউজিসির ঘোষণায় শিক্ষার্থীদের হল ছাড়া করা হলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলে চট্টগ্রামের ষোলশহর, আন্দরকিল্লা, চকবাজার ও জিইসি মোড়কেন্দ্রিক। ৪ আগস্ট আন্দরকিল্লায় আহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ফুয়াদ মন্ডল। তিনি বলেন, ‘‌আন্দোলন করতে গেলে ছাত্রলীগ সবসময় বাধা দিত, বিভিন্ন হুমকি দিত যেন আন্দোলন করতে না পারি। আমি যখন আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম, তখন সেখানে দেখি আমার থেকেও গুরুতর আহত শিক্ষার্থীরা বেডে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। সে ভাইদের হাহাকার আমাকে আজও কাঁদায়। কারো গুলি লেগেছে, কারো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে অক্সিজেন লাগিয়ে রাখছে, কেউ ব্যথায় কান্না করছে, কারো আত্মীয়-স্বজন আহাজারি করে মরদেহ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। সে ভাইদের কথা মনে হলে আমি এখনো খাইতে পারি না এবং চোখ ভিজে যায়, কারণ খাইতে গেলে আমার মনে হয় তারা বেঁচে থাকলে এ সময়ে স্বাধীন দেশে খাবার খেত।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন