এন্ডোমেট্রিওসিস

নারীদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ এন্ডোমেট্রিওসিস

অধ্যাপক ডা. তৃপ্তি রানী দাশ

ছবি : বণিক বার্তা

সারা বিশ্বের ১৯ কোটি নারী এন্ডোমেট্রিওসিস নামক রোগে ভুগছেন। শতকরা ৫-১০ ভাগ নারীর এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে। নারীরা যারা বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে ১০০ নারীর মধ্যে ২৫-৫০ জনের বন্ধ্যাত্বের কারণ এ এন্ডোমেট্রিওসিস। যদিও রোগটি সহজে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় না। কিন্তু রোগীর সার্বক্ষণিক তলপেটে ব্যথা, মাসিকের সময় অসহনীয় ব্যথা, যা রোগীর স্বাভাবিক কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত করে। এমনকি বন্ধ্যাত্ব রোগেও ভোগে।  

জরায়ুর ভেতর তিনটি স্তর থাকে এবং সবচেয়ে ভেতরের স্তরের নাম এন্ডোমেট্রিয়াম। এ এন্ডোমেট্রিয়াম যদি জরায়ুর বাইরে বাসা বাঁধে বা বর্ধিত  হয়, তখন সেই অবস্থাকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় এন্ডোমেট্রিওসিস। এই এন্ডোমেট্রিওসিস সাধারণত ডিম্বাশয়ে (৩০-৪০ ভাগ) বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া জরায়ুর আশপাশে বিভিন্ন লিগামেন্ট, জরায়ুর বাইরের স্তর, পেটের ভেতরের আবরণী পেরিটোনিয়াম, ডিম্বনালি, মূত্রথলি, পায়খানার রাস্তার ভেতরে, মাসিকের রাস্তায়, এমনকি নাভি, কাটা-সেলাইয়ের ওপরও পাওয়া যায়।

এটি যখন ডিম্বাশয়ের ওপর বাড়তে থাকে তখন ডিম্বাণুগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এছাড়া এ রোগ ডিম্ব স্ফুটনেও বাধা তৈরি করে। ডিম্বাশয়ের টিস্যুকে ধ্বংস করে দেয় এবং এর ভেতর মাসিকের সময় রক্ত জমা হতে থাকে। মাসিকের রক্তের জলীয় অংশ প্রাকৃতিক নিয়মে শোষিত হলেও রক্তকণিকাগুলো সিস্টের ভেতর আটকা পড়ে থাকে। এ রক্তকণিকা ঘনীভূত হয়ে তরল চকোলেটসদৃশ হয় বলে একে চকোলেট সিস্ট বা এন্ডোমেট্রিওসিস সিস্টও বলা হয়। এটি ডিম্বনালিকে আক্রান্ত করে ডিম্বনালির গঠন পরিবর্তন করে দেয়।

এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীরা যেসব সমস্যায় ভুগে থাকেন

এ রোগে আক্রান্ত নারীদের বেশকিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা হয়। এ ব্যথার একধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। ব্যথাটা শুরু হয় মাসিকের কিছুদিন আগে থেকে, মাসিক শুরু হলে ব্যথাটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এবং মাসিকের শেষের দিকে ব্যথাটা আরো তীব্র হয়। অনেক সময় দেখা যায় যে মাসিক শেষ হয়ে গেলেও ব্যথা কমে না। এছাড়া অন্যান্য শারীরিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে বন্ধ্যাত্ব বা সন্তান ধারণে অক্ষমতা, সহবাসের সময় অসহ্য ব্যথা এবং মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ অথবা অনিয়মিত মাসিক।

রোগ নির্ণয় 

আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যম এন্ডোমেট্রিওসিস রোগটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় তখনই যখন ডিম্বাশয়ে চকোলেট সিস্ট থাকে। ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে এ রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। 

যেসব নারী ঝুঁকিতে আছেন

৩০-৪০ বছর বয়সের নারী ।

যাদের সন্তান হয়নি বা বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভুগছেন। 

প্রথম সন্তান দেরিতে নিয়েছেন। 

প্রতিকারে করণীয় 

  যাদের উপসর্গ সামান্য ও যাদের মেনোপজের সময় আসন্ন তাদের জন্য তেমন কোনো চিকিৎসা প্রয়োজন নেই; কেবল নির্দিষ্ট সময় পরপর ফলোআপ করলেই হবে। 

  ব্যথা কমাতে আইবুপ্রফেন, মেফেনোমিক অ্যাসিড ভালো কাজ করে। 

  কিশোরী বা অবিবাহিত নারী যারা এ মুহূর্তে সন্তান চাচ্ছেন না তাদের ক্ষেত্রে আমরা ওষুধ দিয়ে মাসিক বন্ধ করে রাখা যায়। কারণ আসল সমস্যাই হচ্ছে মাসিক হলে রক্তক্ষরণের কারণে ব্যথা হয় এবং ডিম্বাশয়ে চকোলেট সিস্ট হয়। 

  মাসিক বন্ধ হওয়ার জন্য একটানা ছয়-নয় মাস স্বল্প মাত্রার জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি অথবা শুধু প্রজেস্টেরন বড়ি দেয়া হয়। 

  লেট্রোজোল, প্রজেস্টেরন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি একত্রে ছয় মাস খেলে উপকার পাওয়া যায় অনেক সময়। 

  যারা বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। যেমন তার বয়স কত, বিয়ে করেছেন কতদিন, কতদিন ধরে বাচ্চা নেয়ার জন্য চেষ্টা করছেন, তাদের ডিম্বাশয়ে ডিমের রিজার্ভ কেমন আছে, এন্ডোমেট্রিওসিস কোন স্টেজে আছে। যদি এন্ডোমেট্রিওসিস প্রাথমিক স্টেজে থাকে সেই ক্ষেত্রে ডিম বড় হওয়ার ওষুধ দিয়ে সহবাসের সময় নির্ধারণ করে নিয়ে বাচ্চা নেয়ার জন্য চেষ্টা করতে পারেন। 

  যেসব নারীর বয়স বেশি, ডিম্বাশয়ের রিজার্ভ কম এবং স্টেজ৩ বা স্টেজ৪ এন্ডোমেট্রিওসিসে ভুগছেন তাদের আইবিএফ বা টেস্ট টিউব বেবির মাধ্যমে সন্তান নেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। অতএব যেসব বিবাহিত নারী এন্ডোমেট্রিওসিসে ভুগছেন, এখনো সন্তান নেননি, তাদের উচিত দেরি না করে তাড়াতাড়ি সন্তান নেয়ার চেষ্টা করা।

যদিও এ রোগ প্রতিরোধের স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেই তথাপি বেশি বয়সে বিয়ে নিরুৎসাহিত করা, স্বেচ্ছায় প্রথম বাচ্চা নষ্ট করা, বারবার ডিএনসি করা থেকে বিরত থাকলে এন্ডোমেট্রিওসিসের মতো রোগের হাত থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যায় । 

লেখক: অধ্যাপক, অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন