বিশ্বে প্রতি চারজনের একজন থ্রম্বোসিসের জটিলতায় মারা যান। আমাদের দেশেও কেউ না কেউ প্রতিদিনই থ্রম্বোসিসজনিত রোগ বা এর জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে, পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই এ রোগ সম্পর্কে সচেতন নন। বর্তমান বিশ্বে মৃত্যুর বড় কারণ স্ট্রোক ও হৃদরোগের পেছনেও থ্রম্বোসিস দায়ী। সে কারণে এ রোগের প্রতিরোধ জরুরি। কোনো কারণে শরীরের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, একে থ্রম্বোসিস বলে। জমাট বাঁধা রক্তের দলাকে বলা হয় থ্রম্বাস আর জমাট বাঁধার পদ্ধতিটির নাম থ্রম্বোসিস।
থ্রম্বোসিস বলতে রক্তনালিতে অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধাকে বোঝায়। যদি কোনো কারণে অস্বাভাবিকভাবে রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধে, তবে রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে আক্রান্ত অংশের কার্যক্ষমতা আংশিক বা পুরোপুরি হ্রাস পেতে পারে, যেমন হার্ট ও মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে স্ট্রোক হতে পারে। মানুষের শরীরে দুই ধরনের রক্তনালি রয়েছে, একটা দিয়ে বিশুদ্ধ রক্ত আসে, তাকে ধমনি (আর্টারি) বলে এবং আরেকটা দিয়ে দূষিত রক্ত ফেরত যায় হৃৎপিণ্ডে। ফেরত যাওয়ার পথটাকে শিরা বা ইংরেজিতে ভেইন বলা হয়। এ শিরাগুলোর মধ্যে যখন কোনো কারণে রক্ত জমাট বেঁধে যায় তখন তাকে থ্রম্বোসিস বলা হয়।
কারণ: অসুস্থতা বা যেকোনো কারণে দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে আছেন এমন ব্যক্তিদের রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে নড়াচড়া না করলেও এমনটা হতে পারে, বিশেষ করে বয়স্কদের বেলায়। যেমন বিমান বা সড়কে দীর্ঘ সময় ভ্রমণ করলেও এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। বিমানে দীর্ঘ সময় ভ্রমণে একভাবে বসে থাকা ও পায়ের নড়াচড়া বন্ধ থাকার কারণে রক্ত চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। এতে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। রক্তনালির ভেতরের দেয়ালে যদি কোনো ইনজুরি হয়, তাতেও রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। শরীরে রক্ত তরল রাখার জন্য কিছু বিশেষ উপাদান আছে, যেগুলো রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। যেমন প্রোটিন-সি, প্রোটিন-এস, অ্যান্টিথ্রম্বিন-৩ ও ফ্যাক্টর-৫। কারো শরীরে যদি জন্মগতভাবে এসব উপাদানের ঘাটতি থাকে, তাহলে তাদের রক্ত সহজে জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।
ভেনাস থ্রম্বোইম্বোলিজমসহ অনেক রোগীর ক্ষেত্রে একটি বা একাধিক ঝুঁকির কারণ থাকতে পারে।
এ কারণগুলোকে দুটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়—বংশগত ও অর্জিত। এসব রোগীর মধ্যে প্রায়ই একাধিক কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে বংশগত ও অর্জিত উভয় কারণ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। শিরায় থ্রম্বোসিসের সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পায়ের গভীর শিরা থ্রম্বোসিস ও পালমোনারি অ্যামবলিজম।
ভেনাস থ্রম্বোইম্বোলিজমের প্যাথোজেনেসিসের মূল তিনটি কারণ:
রক্তপ্রবাহের পরিবর্তন (অর্থাৎ স্ট্যাসিস)
ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াল আঘাত বা ইনজুরি
রক্তের উপাদানের পরিবর্তন (যেমন রক্তে ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া বা হাইপারকোগুলেবল আবস্থা)।
কারা বেশি ঝুঁকিতে
যাদের দীর্ঘক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়
যারা দীর্ঘ সময় একনাগাড়ে গাড়ি চালান
ভ্রমণে দীর্ঘ সময় নড়াচড়া করতে পারেন না যারা
দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে আছেন এমন রোগী
ক্যান্সার ও করোনা আক্রান্ত রোগী
যাদের রক্তে ন্যাচারাল অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্টগুলোর ঘাটতি আছে
অন্তঃসত্ত্বা ও দীর্ঘদিন গর্ভনিরোধক পিল সেবনকারী নারী
যাদের এ রোগের পারিবারিক রোগ-ইতিহাস রয়েছে
ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি
অস্ত্রোপচারের সময় থ্রম্বোটিক ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে অর্থোপেডিক, প্রধান ভাস্কুলার, নিউরোসার্জারি ও ক্যান্সার সার্জারি। এ ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বার্ধক্য, পূর্ববর্তী শিরায় থ্রম্বোইম্বোলিজম, ম্যালিগন্যান্সি বা অসুস্থতার সহাবস্থান (যেমন কার্ডিয়াক ডিজিজ), থ্রম্বোফিলিয়া, দীর্ঘস্থায়ী অস্ত্রোপচার, অ্যানেসথেসিয়া ও অচলাবস্থার সময়।
গর্ভাবস্থা থ্রম্বোসিসের একটি বর্ধিত ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত এবং সেই সঙ্গে গর্ভাবস্থার সময় হাইপারকোগুলেবল অবস্থাও একটি কারণ হতে পারে। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের প্রায়ই প্রোকোগুল্যান্ট কার্যকলাপের (যেমন টিস্যু ফ্যাক্টর ও ক্যান্সার প্রোকোগুল্যান্ট) জন্য থ্রম্বোসিসের ঝুঁকি প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। এমনকি ম্যালিগন্যান্সি ও সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটারের রোগীদের মধ্যে থ্রম্বোসিসের ঝুঁকি আরো বাড়তে পারে।
লক্ষণ
হঠাৎ করে হাত বা পা ফুলে ওঠে, তীব্র ব্যথা হয় কিংবা পেশি শক্ত হয়ে যায়
আক্রান্ত স্থানের ত্বক লালচে হয়ে যায়
পা অবশ বা অনুভূতিহীন মনে হয়
দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস
মাথা ঘোরা ও জ্ঞান হারানো
ফুলে ওঠা, ব্যথা ও শক্ত হয়ে যাওয়া—এ তিনটিই বা যেকোনো একটি লক্ষণ সাধারণত এক পা ও এক হাতে দেখা দেয়
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা: রক্তনালির আল্ট্রাসনোগ্রাম বা ভাস্কুলার ডুপ্লেক্স স্টাডি পরীক্ষার মাধ্যমে থ্রম্বোসিস শনাক্ত করা যায়। এছাড়া ডি-ডাইমার টেস্টের মাধ্যমেও থ্রম্বোসিস নির্ণয় করা হয়।
চিকিৎসা: থ্রম্বোসিসের চিকিৎসায় কার্যকর পদ্ধতির নাম থ্রম্বোলাইসিস। এ পদ্ধতিতে শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ প্রবেশ করানো হয়, যা রক্তের প্রবাহকে নির্বিঘ্ন করে। শুরুতে ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করা হয়। কয়েকদিন পরে মুখে খাওয়ার ওষুধ দেয়া হয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারলে এতে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। বিশেষ এ জটিল ক্ষেত্রে ভাস্কুলার সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে।
প্রতিরোধে করণীয়
গাড়ি চালানোর সময় অন্তত ২-৩ ঘণ্টা পরপর বিরতি নিন। কিছুক্ষণ বাইরে হাঁটাহাঁটি করুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া জন্ম নিরোধক ওষুধ খাবেন না।
ধূমপান ও মদপানের অভ্যাস দ্রুত পরিহার করুন।
যারা দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে কাজ করেন, তারা নির্দিষ্ট সময় পরপর উঠে দাঁড়ান। হাঁটাহাঁটি বা হাত-পা নাড়াচাড়া করুন।
স্থূলকায় মানুষের ওজন নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দিতে হবে।
অতিরিক্ত তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করুন।
নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন। সুষম ও পর্যাপ্ত আঁশযুক্ত খাবার এবং ফলমূল খাবেন, সেই সঙ্গে যথেষ্ট পানি পান করুন।
থ্রম্বোসিসের লক্ষণ দেখা দিলে একটুও সময় নষ্ট না করে দ্রুত একজন ভাস্কুলার সার্জন, কার্ডিওলজিস্ট বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং সুচিকিৎসা গ্রহণ করুন।
লেখক: রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ফিজিশিয়ান। সিনিয়র কনসালট্যান্ট, হেমাটোলজি অ্যান্ড হেমাটো-অনকোলজি, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল