উপকূল অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

ফিল্ড ওয়ার্কে সিলেটে একদিন

ছবি: হাসান শাহরিয়ার

খুব সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে চলে যেতাম স্টাডি এরিয়ায়। আমাদের স্টাডি এরিয়া ছিল সিলেটের লালাখাল, তামাবিল, জাফলং, ডাউকি নদী, রাঙ্গাপানি নদী, শ্রীপুর চা-বাগান, সাইট্রাস রিসার্চ সেন্টার।

এসব জায়গায় গিয়ে আমরা পরিমাপ করতাম জিওলজিকাল ফরমেশন, ডিপ, স্ট্রাইক, আজিমুথ। ডিপ, স্ট্রাইক হলো একটি মাপকীর্তি পদ্ধতি, যা একটি পর্যায়ক্রমিক ভূতত্ত্বীয় সংস্থানের সংস্থান বা অবস্থানকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। একটি সংস্থানের স্ট্রাইক হলো একটি ভূতত্ত্বীয় সংস্থানের সঙ্গে সংযুক্ত একটি সমতল রেখার দিক এবং ডিপ হলো সেই সংস্থানের সঙ্গে সংযুক্ত সমতল রেখার কোণ, যা সমতল থেকে নিচে নেমে আসে। আর আজিমুথ হলো ভৌগোলিক উত্তর থেকে পরিমাপ করা নিম্নগামী ডিপের দিক। এছাড়া সিলেট লাইমস্টোন ও কপিলি সেলের সংযোগস্থানের পার্থক্য নির্ণয় করেছিলাম।

বলছিলাম সিলেটে এক ফিল্ড ওয়ার্কের অভিজ্ঞতার কথা। ভূতাত্ত্বিক ও প্রাকৃতিক কারণে সিলেট বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণ খুঁজতে এবং ভূতাত্ত্বিক নানা দিক পর্যবেক্ষণ করতে সিলেটে ফিল্ড ওয়ার্কের আয়োজন করে কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। আমরা গিয়ে উঠি সিলেট জৈন্তাপুর উপজেলার ডাকবাংলোয়। দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জন্য এটাই ছিল প্রথম কোনো ফিল্ড ওয়ার্ক। টিম লিডার ছিলেন আলমগীর হোসাইন স্যার এবং স্বর্নালি মাহমুদ ম্যাম। ফিল্ড ওয়ার্ক যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই প্রথম উপলব্ধি করতে পারি। শিখেছি কিছু চমকপ্রদ অজানা বিষয়। 

সিলেট ভূতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ডাউকি ফল্ট। টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলগুলোকে বলা হয় ‘ফল্ট সিস্টেম’, যেখানে দুটি প্লেটের ঘর্ষণে ভূমিকম্প তৈরি হয়। বাংলাদেশে এরূপ একটা সবচেয়ে বিপজ্জনক ফল্ট বা চ্যুতির নাম হলো ডাউকি ফল্ট। ৩০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এ ফল্টের নামকরণ করা হয়েছে ভারতের মেঘালয়ের শহর ডাউকি থেকে। পূর্বদিক এই ফল্ট ভারত থেকে বিস্তৃত হয়ে পশ্চিমে চলে এসেছে বাংলাদেশের দিকে। আর ডাউকি ফল্টের জন্যই বাংলাদেশের কয়েকটি বিভাগ খুব বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ। এই ফল্টের ফলে টপোগ্রাফিক্যাল অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সেটারও আমরা খুঁটিনাটি জেনেছিলাম। 

এছাড়া আমরা কালেক্ট করেছিলাম লাইমস্টোন, জিপসাম। কোনটা কোন ধরনের শিলা সেসবও আমরা পরীক্ষা করে দেখি। পাথর উত্তোলন এবং পাথর ভাঙা কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের সঙ্গে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করি। এই কাজের ফলে তাদের শারীরিক কী কী ক্ষতি হয় এবং আর্থিকভাবে কতটা লাভবান হচ্ছে  সেসব জানার চেষ্টা করি। সিলেটের বিভিন্ন টিলায় বসবাস করা অধিবাসীদের ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করে তাদের সমস্যা এবং আকস্মিক বন্যার ফলে কী কী ক্ষতি হয় সেসবও জানার চেষ্টা করি আমরা। পানির স্তর অনেক নিচে হওয়ায় টিলায় বসবাসকারীদের অন্যতম সমস্যা হলো পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির অভাব। যার ফলে তারা বর্ষার মৌসুমে কূপে পানি ধরে রাখে পরে তা বিশুদ্ধিকরণ করে পান করে।  এছাড়া সাইট্রাস রিসার্চ সেন্টারে আমরা একটি ওয়ার্কশপ করি। যেখানে সিলেট অঞ্চলের মাটির গুণাগুণ ও এ অঞ্চলের সাইট্রাস ফলন ভালো হওয়ার কারণ সম্পর্কেও জানতে পারি।

প্রতিদিন সকালে ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য হালকা খাবার সঙ্গে নিয়ে বের হতাম। পথিমধ্যে কোথাও দুপুরের খাবার খেয়ে নিতাম। এরপর আবার সবাই মিলে ফিল্ডের কাজে লেগে পড়তাম। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাংলোয় ফিরে চলত বিশ্রামের পালা। বিশ্রাম শেষে আবার শুরু হতো সারা দিনের কাজের আউটপুট নিয়ে পর্যবেক্ষণ। কোন স্থানে কী কী পেয়েছি সেগুলো ম্যাপে প্লোট করে শেষ হতো সারা দিনের কর্মজজ্ঞ। আমার মনে হয়েছে প্রথম বর্ষে তাত্ত্বিক পড়াশোনা করে যা শিখেছিলাম তার চেয়ে বেশি শিখেছি এ পাঁচদিনের ফিল্ড ওয়ার্কে।

মো. ইলিয়াস: শিক্ষার্থী, কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন