গ্যাসের স্থানীয় জোগান নিয়ে চিন্তিত পেট্রোবাংলা

পুরনো ও পরিত্যক্ত কূপ সংস্কারের পাশাপাশি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারে সচেষ্ট হতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে গ্যাস সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আবাসিক, শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে জাতীয় গ্রিডে মোট সরবরাহ হয় ৩০০ কোটি ঘনফুট। বাড়তি চাহিদা পূরণে বেড়েছে আমদানিনির্ভরতা। কিন্তু বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ইত্যাদি কারণে প্রয়োজনমাফিক আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদনের পরিমাণও কমেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর পেছনে দায়ী দেশীয় গ্যাস খাতের অনুসন্ধান ও উত্তোলন ব্যবস্থায় মনোযোগ না দিয়ে উল্টো আমদানিনির্ভর হওয়া। সম্প্রতি বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গ্যাসের সরবরাহ নিয়ে চাপ বাড়ছে পেট্রোবাংলার ওপর। এ পরিস্থিতিতে খনন ও সংস্কারের (ওয়ার্কওভার) মাধ্যমে পরিত্যক্ত গ্যাসকূপগুলোকে উত্তোলনে ফিরিয়ে আনায় মনোযোগ দিয়েছে সংস্থাটি। পেট্রোবাংলার এক কমিটির সমীক্ষা প্রতিবেদনমতে, দেশের বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রের আওতাধীন অন্তত ৯৮টি কূপ এখন পরিত্যক্ত ও সাময়িক বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে কূপগুলো থেকে নতুন করে দৈনিক ২২০-২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব।

গ্যাস সংকটের আশু সমাধান করা না গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক অভিঘাত পড়বে। গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো। বিদ্যমান কূপগুলো সংস্কারের ফলে গ্যাস সংকট কিছুটা লাঘব হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে পুরনো ও পরিত্যক্ত কূপের সংস্কারের পাশাপাশি নতুন কূপ অনুসন্ধান করা জরুরি। কেননা কয়েকটি বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্রের মজুদও প্রায় শেষের পর্যায়ে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উত্তোলনে উদ্যোগী হতে হবে পেট্রোবাংলাকে। 

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশে ২০২৩ সালের প্রথম ১০ মাসে গ্যাসের চাহিদা কমেছে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ শতাংশ। কিন্তু ওই সময়ে এলএনজি আমদানি বেড়েছে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও এ আমদানি স্থানীয় উত্তোলন হ্রাসজনিত ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট নয়। সরবরাহস্বল্পতার কারণে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের রেশনিং করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এতে বিদ্যুৎ খাতে ক্রমাগত লোডশেডিং বেড়ে চলছে।

গ্যাস সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগছে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন খাত। দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু এ সময় তা ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুতে গত বছর ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও গড় সরবরাহ ছিল ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বড় অংশ বসে থাকায় বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনে অন্তত আড়াই-তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। ওই সময় বিতরণ কোম্পানিগুলো ঘোষণা দিয়েই অব্যাহতভাবে কয়েক মাস লোডশেডিং করেছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি শিল্প খাতেও চলছে গ্যাস সংকট। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার শিল্প এলাকার টেক্সটাইল মিলগুলো প্রায় অচলাবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের বিসিক ও আশপাশ এলাকায় দুই সপ্তাহের জন্য গ্যাস সরবরাহ বন্ধও হয়ে যায়। 

বিদ্যুৎ খাতে চাপ সৃষ্টি হওয়ার আরেকটি কারণ হলো আবাসিক কাজ, বিশেষত শহরে রান্নার কাজে গ্যাসের বিকল্প হয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ কিংবা তারা রান্না করতে বাজার থেকে চড়া দামে কিনে আনছে গ্যাস সিলিন্ডার। এতে মানুষের ওপর আর্থিক চাপও বেড়ে চলেছে। আবাসিক খাত থেকে শুরু করে শিল্প-কলকারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে গ্যাস সংকটের কারণে। এর প্রভাব রফতানি বাণিজ্যেও পড়ছে।

দেশে স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত গ্যাসের চাহিদা ক্রমেই বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় গত ১০ বছরে এখানে বড় কোনো মজুদ আবিষ্কার করা যায়নি। এমনকি ২০১১ সালের পর দেশে গ্যাসের প্রকৃত মজুদসংক্রান্ত কোনো অনুসন্ধানভিত্তিক তথ্যও প্রকাশ হয়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোভিত্তিক কনসালট্যান্সি ফার্ম গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটসের সমীক্ষামতে, দেশে গ্যাসের মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। অনুমান করা হয় খনিগুলোয় গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ আছে ৩৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য নতুন গ্যাস অনুসন্ধানে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। পুরনো ও পরিত্যক্ত কূপ স্বল্পমেয়াদে সুফল বয়ে আনতে পারে তবে তা টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে প্রতীয়মান হয় না।

জানা যায়, গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র নয়টি কূপ খনন করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে খুব বেশি গ্যাসও যুক্ত হয়নি। বোঝা যায় যে এসব উদ্যোগ বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বর্তমানে এ সংকট মোকাবেলা করতে ভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশে গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পেট্রোবাংলা বর্তমানে ৪৮টি গ্যাস কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ২৩টি কূপ খনন করা হচ্ছে বাপেক্সের রিগ দিয়ে এবং বাকিগুলো আউটসোর্সিং করে খনন সম্পন্ন করবে পেট্রোবাংলা। এসব কূপ খননের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে সংস্থাটির। 

হাইড্রোকার্বন ইউনিট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে ২৯ দশমিক ৯৩ টিসিএফ। এর মধ্যে গত বছরের জুন পর্যন্ত ২০ দশমিক ৩৫ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। চলতি মাস পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে আরো অন্তত ৬০০ বিসিএফ। সে হিসাবে বাকি গ্যাস দিয়ে চলবে প্রায় ১০ বছর। অর্থাৎ গ্যাসের মজুদ দ্রুত শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এক্ষেত্রে স্পট মার্কেটের ওপর নির্ভরশীলতাও সমাধান নয়। আবার স্পট মার্কেটের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোকেও সমাধান হিসেবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এখন স্পট এলএনজির চাহিদা বাড়ছে। বাজার পর্যবেক্ষকরদের মতে, এলএনজির বাজার আবারো যেকোনো সময় ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। আইইএসহ আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার সংস্থাগুলোর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় গ্যাসের স্থানীয় উত্তোলন এখন কমছে। দাম কম হওয়ার সুবাদে দেশগুলো এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বাড়াচ্ছে। বাড়তি এ চাহিদা যেকোনো সময় জ্বালানি পণ্যটির বাজার মূল্যকেও আবারো ঊর্ধ্বমুখী করে তুলতে পারে। স্থানীয় উত্তোলন না বাড়ালে এ সংকট মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

তবে গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান বা আবিষ্কার কিংবা সংস্কারের বাইরে গিয়েও এখন চিন্তা করা উচিত। দেশে জ্বালানি খাতের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল গ্যাস। শিল্প খাতের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। জ্বালানি ও উৎপাদন খাতকে গ্যাসনির্ভরতা থেকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। প্রকৃতির নিয়মেই অনবায়নযোগ্য জ্বালানি একসময় নিঃশেষ হবে। আগামীতে এ ধরনের সংকট থেকে বাঁচতে চাইলে কালক্ষেপণ না করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ধাবিত হতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন