তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন

সিরাজগঞ্জে দেড় দশকে আবাদি জমি কমেছে প্রায় ২ হাজার হেক্টর

অশোক ব্যানার্জী, সিরাজগঞ্জ

পুকুর খননের কারণে সিরাজগঞ্জে তিন ফসলি জমির পরিমাণ কমছে আশঙ্কাজনক হারে ছবি : নিজস্ব আলোকচিত্রী

ধান ও সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন হয় সিরাজগঞ্জে। তবে পুকুর খননের কারণে তিন ফসলি জমির পরিমাণ কমছে আশঙ্কাজনক হারে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৮-২৩ সাল পর্যন্ত জেলায় ২ হাজার ৫৩৯টি পুকুর খনন করা হয়েছে। এ কারণে দেড় দশকে ১ হাজার ৯২০ হেক্টর আবাদি জমি কমেছে, যার বেশির ভাগই তাড়াশ উপজেলায়।

এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন কমে আসবে। জলাবদ্ধতাসহ পরিবেশ ও সার্বিক কৃষি ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখে দেবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলছে, মামলা, জেলজরিমানা করেও পুকুর খনন বন্ধ করা যাচ্ছে না। পুকুর খননের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, ফসল উৎপাদনের চেয়ে মাছ চাষ অধিক লাভজনক। এজন্য ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির আহ্বায়ক দীপক কুমার কর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলনবিল-ধ্যুষিত তাড়াশ ও উল্লাপাড়ায় অবাধে পুকুর খনন করে পানিপ্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষি ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পুকুর খনন বন্ধে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব দেয়া উচিত।’

তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করছেন হাজি বাবু। আবাদযোগ্য প্রায় ৫০ বিঘা তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন করছেন তিনি। শুধু হাজি বাবু নন, একই উপজেলার ভায়াট গ্রামের আল-আমিন অন্যের জমি ইজারা নিয়ে পুকুর খনন করছেন।

তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের শিক্ষক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ১০ কাঠা জমি ছিল। সলঙ্গা থানার কুমার গাইলজানি গ্রামের সাচ্চু নামে এক ব্যক্তি ১৫ জন কৃষকের জমি ইজারা নিয়ে সেখানে পুকুর খনন করছেন। আমাকে বললে প্রথমে জমি দিতে রাজি হয়নি। আমার সামান্য জমি পুকুরের এক কোনায় পানিতে তলিয়ে থাকত, কোনো আবাদ করা যেত না। তাই আমিও জমি দিতে বাধ্য হয়েছি।’

নওগাঁ ইউনিয়নের কালীদাসনিলি গ্রামের তারিকুল ইসলাম ও শাজাহান আলী বলেন, ‘নিয়ম না মেনে অনেকে যত্রতত্র আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খনন করছে। এ কারণে মাঠের পানি সহজে নামতে পারবে না। তখন জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে, ফসলি জমি তলিয়ে যাবে।’

তবে হাজি বাবু ও আল-আমিন বলেন, ‘‌ফসল উদপাদনের চেয়ে মাছ চাষ লাভজনক। এজন্য এ অঞ্চলে পুকুর খনন বেশি হচ্ছে। লাভ বেশি হওয়ায় কৃষক ফসল উৎপাদন না করে জমি ১৫-২৫ বছর মেয়াদে লিজ দিচ্ছে। আমরা জমি লিজ নিয়ে পুকুর খনন করছি। কয়েক বছর ধরে তাড়াশের বিভিন্ন স্থানে পুকুর খনন করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী সবারটা বন্ধ হলে আমরাও আর পুকুর খনন করব না।’

সিরাজগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায়  ধান, গম, খিরা, শসা, পাট, বেগুন, ডাল, রসুন, কাঁচামরিচ, আখসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়। যার বড় একটি অংশ তাড়াশ ও উল্লাপাড়া উপজেলায় উৎপাদন হয়। পুকুর খনন অব্যাহত থাকলে খাদ্যে উদ্বৃত্ত এ জেলায় খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।

এ ব্যাপারে তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তাড়াশে বিভিন্ন জাতের ধান ও রবিশস্য আবাদ হয়। এখানে তিন ফসলি জমিও রয়েছে। তার পরও কৃষক তাদের জমিতে পুকুর খনন করছে। মূলত মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্র কৃষকের সব দায়ভার নিয়ে পুকুর খনন করে দিতে উৎসাহিত করছে, যা কৃষির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

এদিকে ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা লঙ্ঘন করে পুকুর খনন করায় মার্চে জমির মালিকদের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে আটটি, ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ১০টি এবং সাধারণ কৃষক বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছেন।’

এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদ হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেকে অবৈধভাবে রাতের অন্ধকারে পুকুর খনন করছে। পুকুর খননের তথ্য পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো হচ্ছে। জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতে বেশ কয়েকজনকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। তাতেও পুকুর খনন বন্ধ করা যাচ্ছে না।’

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উর্বর এবং তিন থেকে চার ফসলি জমি দেশের খুব কম এলাকায় রয়েছে। এজন্য সিরাজগঞ্জ শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত। তবে যেভাবে ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে সেই সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হবে না। মানুষ বুঝতে পারছে না, আবাদি জমি কমে গেলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তাদের জীবন সংকটাপন্ন হতে পারে। পুকুর খননের কারণে দেড় দশকে জেলায় ১ হাজার ৯২০ হেক্টর আবাদি জমি কমেছে। যা মোট ফসল উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন