গুরুদক্ষিণা রশিদ বন্দনা

শফিকুল কবীর চন্দন

শিল্পী রশিদ চৌধুরী (১ এপ্রিল ১৯৩২-১২ ডিসেম্বর ১৯৮৬ খ্রি.), ছবি: অ্যাথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস

মানুষ কেবল তার আয়ুষ্কালেই বাঁচে না, কারো কারো বেঁচেবর্তে থাকা হয়তো কেবল বর্তমানে বলয়িত। আর এক পদের মানুষ বাঁচেন অনিবার্য বর্তমানে আর তার যোগসূত্রে অনাগত ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সীমাহীন আয়ুষ্কাল পকেটে পুরে। তেমনি একজন ক্ষণজন্মা শিল্পী রশিদ চৌধুরী। যিনি একার স্বার্থপর শিল্পযাত্রায় নয়, সমষ্টির শিল্পপুরাণ পালার বিবেক হয়ে বেঁচে থাকেন।

‘‌সৎ সাহস জ্যাঠামি নয়, সৎ সাহস হচ্ছে দূরকে দেখতে পাবার ক্ষমতা।’ -আহমদ ছফা

শিল্পী রশিদ চৌধুরী বাংলাদেশের ব্যতিক্রম চিত্রকরদের একজন, যিনি আঙ্গিক ও রীতিতে ইউরোপীয় হয়েও বক্তব্য ও বিষয়বস্তুতে পুরোপুরি বাঙালি। যে কারণে তার ছবি কখনো হারিয়ে যায় না। বৈশিষ্ট্যটুকু যেকোনো দর্শককে আকৃষ্ট করে। বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে গিয়ে তিনি স্মৃতি ও কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে তার সমাজ ও স্বদেশ এক আশ্চর্য অলৌকিক রূপে বিধৃত। বাংলার শাশ্বত রূপকে যেভাবে কবি জীবনানন্দ দাশ উপলব্ধি করেছেন তার কবিতায়, রশিদ চৌধুরীর ছবিতে বারবার ঘুরেফিরে সে বিশেষ রহস্যময় সৌন্দর্য ও রূপটি তার সব ঐতিহ্য-উপকথা, জাদু লৌকিকতা ও মায়ামমতা নিয়ে ধরা পড়েছে। বাংলার প্রতি গভীর আনুগত্য রশিদ চৌধুরীর স্বকীয়তা।

শিল্পের প্রয়োজন ও শিল্পীর দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তার বক্তব্য, কোনো শিল্পীর দায়িত্ব হচ্ছে তার সমাজের প্রতি, যেখানে তিনি জীবন ও সমাজকে সুন্দর করার দায়িত্ব পালন করবেন। শিল্প কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পদ হওয়া উচিত নয়, শিল্প সবার জন্য।

শিল্পী রশিদ চৌধুরীর চারুপথ তার সমসাময়িকদের চেয়ে ভিন্নতর। তার শিল্পচর্চার ধরন, আঙ্গিক ও প্রকরণেই কেবল নয়। প্রাণবান দেশব্রতী চরিত্র ছিল তার যাপনাভিজ্ঞা। ফলে ঢাকা চারুকলা থেকে চাকরি হারিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে ব্রতী হন চট্টগ্রামের মতো মফস্বলে শিক্ষা বিস্তারে। নিজের মেধা প্রজ্ঞা আর অসীম উৎসাহে গড়ে তোলেন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক চারুকলা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা কার্যক্রম। ১৯৬৯ সালে চারুকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। গড়ে তোলেন অন্যতর ধাঁচে। সেখানে রশিদ চৌধুরী ছিলেন প্রথম শিক্ষক। ঢাকায় তখনো শুধু স্নাতক পর্যন্ত ছিল। উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের সুবিধার সূত্রপাত চট্টগ্রাম চারুকলা থেকেই। এ কথা অত্যুক্তি নয় যে বাংলাদেশে জয়নুল আবেদিনের পর রশিদ চৌধুরী একজন স্বপ্নদর্শী হিসেবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডসহ শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। সেখানে তিনি শুধু নিজেই শিল্পচর্চা করেননি, জনপদ ও সম্প্রদায় নিয়ে ভেবেছেন, শিল্প শিক্ষা ব্যবস্থাপনার প্রসার করেছেন এবং নতুন শিল্প মাধ্যমেরও উন্মেষ ঘটিয়েছেন। পশ্চিমে যেভাবে আধুনিকতাবাদ চর্চিত হয়েছে এবং ষাটের দশকে আমাদের দেশেও শিল্পচর্চায় যেভাবে অনুকরণ করা হয়েছে তার মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, বোহেমিয়ানিজম এসব অনুষঙ্গ আমাদের শিল্পানুশীলনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। অথচ শিল্পী রশিদ চৌধুরী ছিলেন সেখানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম! নিজেকে মেলে ধরেছিলেন স্বতন্ত্রভাবে।

শিল্পী রশিদ চৌধুরী ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে ছাড়িয়ে সমষ্টির কথা ভেবেছেন, প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি এমন হয়েছিল তিনি তার গড়ে তোলা বিভাগ ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। কেবল অভিমান নয় অবজ্ঞা, অসদাচরণের পরিমণ্ডল থেকে আত্মসম্মান নিয়ে তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসেন। অথচ তার হাত দিয়েই বিভাগটি তৈরি হয়েছে। প্রতিকারহীন বঞ্চনা আর অন্তহীন প্রতারণার ঘা নিয়েই তিনি একসময় চট্টগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। সম্ভবত ঢাকা চারুকলা থেকেও জয়নুল আবেদিনকে চলে যেতে হয়েছিল। এখানে গুরু-শিষ্যের প্রস্থানের এক অদ্ভুত সাদৃশ্য! এখানেও তিনি গুরু জয়নুলের অনুসারী। দায়-এর প্রশ্ন এখানেও! তবে দায় এড়াতে নাকি তা ছিল দায়বোধের আরেক প্রপঞ্চ?

১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ঢাকায় শুরু হয় গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ। তার ২১ বছর পর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবসিডিয়ারি হিসেবে শুরু হয় চারুকলা বিষয়। পরবর্তী ২০ বছর চট্টগ্রাম থাকাকালীন ১৯৭২ সালে কলাভবন ও আর্ট গ্যালারি, ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম শহরে চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তার অবদান অগ্রগণ্য। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। ফরিদপুরের পদ্মা তীর থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তীরে তার তীর্থযাত্রার সমাপ্তি! অতঃপর মাত্রই বছর পাঁচেক জীবদ্দশায় ঢাকায় বাস।

আজকে রশিদ চৌধুরীর শিল্পকর্ম বিশেষত ট্যাপেস্ট্রি নকলে নাকাল এ বিষয়ে আলাপ অল্পবিস্তরই! কেন? খুবই সংগত এ প্রশ্ন জারি করতে না পারা, না রাখা রশিদ চৌধুরীর প্রতি তার শিল্পকৃতির প্রতি অবিচার।

প্রশ্ন উঠতে পারে শিল্পকর্ম জাল-জালিয়াতি বিষয়ে বাংলাদেশে চারুঙ্গনের অবস্থান কী? সত্যি বলতে বাংলাদেশের শিল্পকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার বয়স ৭০-এর বেশি হলেও সত্বর এ জাল-জালিয়াতি বিষয়ে কোনো সদুত্তর আসলেই পাওয়া কঠিন! বাস্তবিক অর্থে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, আইনপ্রতিষ্ঠান কোথাও এ নিয়ে ন্যূনতম চর্চার কোনো হদিস পাওয়া সত্যিই দুরূহ! চারুশিল্পের পেশাদারত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক স্বত্ব আইন, ও এ-সংক্রান্ত অপরাধবিষয়ক আইনি সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও সংশ্লিষ্ট মহল ভাবিতই নয়! ফলে বিশ্বের অপরাপর দেশের চারুশিল্পের চর্চা, বাণিজ্য ও পেশা সুরক্ষার তুলনায় বাংলাদেশ যে কেবল পিছিয়ে আছে তাই নয়, এ মুহূর্তে সেসব দেশের সঙ্গে শিল্পকলা রক্ষণাবেক্ষণ, সংগ্রহশালা, শিল্পকর্মসংক্রান্ত বিনিময় কার্যক্রম স্বচ্ছন্দে চালানোরও অন্তরায়। দেশে শিল্পকর্মের জাল-জালিয়াতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিশন, এক্সপার্ট, শিল্পী-শিল্পকর্ম ও জাতীয় স্বার্থ বিষয়ে কোনো দিশাই কার্যত নেই, ফলে যেমন খুশি তেমন সাজের এ বিভাগে জাল-জালিয়াতি, নকল, ভুয়া, প্রতারণা চলতেই থাকবে তা আর এমন কি!

মাত্র ৫৪ বসন্তের যাপন পরিধিতে রশিদের সাংগঠনিক সামর্থ্য ও সফলতা বিবেচনায় নিলে তার সমসাময়িকদের যাপিত জীবন দৈর্ঘ্যের তুলনায় নিঃসন্দেহে ঈর্ষা জাগানিয়া। আমাদের চেনাজানার মধ্যেই সন্তুষ্টির উন্মাদনার সিনড্রোম আক্রান্ত শিল্পসংশ্লিষ্টদের আকছার নানা বিশেষয়োক্তি যখন আসলে ‘থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়’ তখন রশিদের জন্য গলা খাঁকারি দিয়ে কোনো ‘ক্লিশে বিশেষণের’ প্রয়োজন অবান্তর।

এ বন্দনা আমাগো রশিদ শিল্পকর্তার লগে চিন পরিচয় বা তর্কাতীত তর্পণ খায়েশ! জনারণ্যে লোপাট হয়ে যাওয়া থেকে তার নির্মিতির গহন-গড়ন, ন্যায্যতা, আলোক-অনালোকের বয়ন, ইত্যাকার আচ্ছন্ন গল্পের কুহক আমাদের আবিষ্ট করে আজও। আমরা চাইলে পষ্টাপষ্টি প্রত্যক্ষ করতে পারি তারিখ-সাল-সাকিন চিহ্নিত সিলমোহরসহ পোস্টাল অ্যাড্রেস। যে ঠিকানায় আমাদের গর্বের মৌরুসি বসত। প্রযত্নে থাকেন শিল্পী রশিদ চৌধুরী। 

১ এপ্রিল শিল্পী রশিদ চৌধুরীর জন্মদিন। ৯২তম জন্মদিনের প্রাক্কালে এক অখ্যাত শিষ্যের গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করুন।

জয়তু শিল্পী রশিদ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন