আলোকপাত

অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্স গার্মেন্টসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ

ড. মইনুল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার মূল চালিকাশক্তি প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাক রফতানি থেকে অর্জিত রফতানি আয়। অর্থনীতির একজন গবেষক হিসেবে আমার দৃঢ় অভিমত, দেশের গত চার দশকের অর্থনৈতিক গতিশীলতার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অভিবাসনকারী বাংলাদেশীরা এবং ফরমাল চ্যানেলে কিংবা হুন্ডি প্রক্রিয়ার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে এ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। গুরুত্বের দিক থেকে গার্মেন্টস দ্বিতীয় স্থানে। আমার এ অনুসিদ্ধান্তকে ভুল বুঝবেন না, প্লিজ! আমি গার্মেন্টস শিল্পের অবদানকে খাটো করার জন্য কথাটি বলছি না, অকাট্য প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্সের ক্রমবর্ধমান অবদানকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য নিরেট সত্যটা তুলে ধরছি। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে সরকারি সংস্থা ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) জানিয়েছে, বাংলাদেশের ১ কোটি ৫৫ লাখ অভিবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে ও কর্মরত রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ অভিবাসীদের কর্মসংস্থান না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কতখানি ভয়াবহ বেকারত্ব সমস্যায় বিপর্যস্ত হতো সেটা কল্পনা করতেই ভয় লাগে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বাংলাদেশকে যে ‘আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস’ অভিহিত করা হয়েছিল, তার প্রধান কারণই ছিল ওই সময়ের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল এবং দেশটি ওই বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থান করতে পারবে না বলে উন্নয়ন-চিন্তকরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন। ২০২২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নির্ধারিত হয়েছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখের মতো। অথচ এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার সত্তর দশকের ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ১ দশমিক ১২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারের এমন প্রশংসনীয় হ্রাসের পেছনে অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। পাকিস্তান জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার তেমন একটা কমাতে না পারায় পাকিস্তানের জনসংখ্যা এখন ২৩ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও মনে করা হতো, প্রতি বছর বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ১৮-২০ লাখ শ্রমশক্তি যোগ হচ্ছে। অথচ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বছরে সাত-আট লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এর মানে, বিদেশে কর্মসংস্থান বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘সেফটি বাল্ব’ হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। এটা সত্যিই স্বস্তিদায়ক যে ২০২৩ সালে ১৩ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী অভিবাসন নিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থান নিতে সমর্থ হয়েছেন। সমাজে বড় ধরনের অস্থিরতা ও সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কাকে রোধ করে চলেছে বিদেশে অভিবাসন।

কৃষি খাতের পর দেশের শ্রমশক্তির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে বিদেশে অভিবাসন। পাকিস্তান আমলে সিলেট থেকে বিলেতে বেশকিছু সংখ্যক অভিবাসীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলেও অভিবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। সত্তর দশকের দুটো আন্তর্জাতিক তেল সংকটের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যে উন্নয়নযজ্ঞ শুরু হয়েছিল তার ফলে সত্তর দশকের শেষ দিকে এবং বিশেষত আশির দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশীদের ব্যাপক অভিবাসনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। এ অভিবাসন-প্রবাহ গত চার দশকে বাড়তে বাড়তে এখন মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে বিশ্বের অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ২০২৪ সালে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মরত রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে ৮০-৯০ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী বসবাস করছেন এবং প্রায় সব দেশে তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ১৮ শতাংশ বিদেশে কর্মরত রয়েছেন।

প্রবাসী বাংলাদেশীরা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার ফরমাল চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। কিছুদিন আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে আসছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সিংহভাগ রেমিট্যান্স প্রেরকরা হুন্ডি পদ্ধতির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। (সম্মিলিতভাবে আমি এগুলোকে হুন্ডি পদ্ধতি বলব)। অতএব ২১-২২ বিলিয়ন ডলার যদি ফরমাল চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স আসে তাহলে কমপক্ষে আরো ২১-২২ বিলিয়ন ডলার বা তার চেয়েও বেশি রেমিট্যান্স (টাকার আকারে) হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে ঢুকছে। হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত অর্থ রেমিট্যান্স প্রেরকের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা যেহেতু পাচ্ছে তাই এ অর্থ প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে ব্যাপক অবদান রাখছে। ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক-অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দেশে এখন ১ লাখ ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। লক্ষণীয়, এসব অ্যাকাউন্টের উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রামীণ এলাকার ব্যাংক শাখাগুলোয়। সারা দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রবাসীদের পরিবারের পাকা বাড়ি নির্মাণের যে অগ্রগতি দৃশ্যমান তার খরচের কত শতাংশ ফরমাল চ্যানেলে দেশে এসেছে? স্বীকার করতেই হবে, ফরমাল চ্যানেল বা হুন্ডি পদ্ধতি যেভাবেই রেমিট্যান্সের অর্থ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হোক তার বহু সুফল পাচ্ছে অর্থনীতি। হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা (প্রধানত ডলার) যদিও দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের জন্য পুঁজি পাচারকারীরা অপব্যবহার করছে, তবুও হুন্ডি পদ্ধতি অর্থনীতির জন্য পুরোপুরি নেতিবাচক নয়। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যে বড়সড় সংকটে পড়ছে না তার পেছনে ফরমাল চ্যানেলে কিংবা হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত রেমিট্যান্স থেকে উদ্ভূত বিশাল আমানতপ্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এক অর্থে, এ বিপুল রেমিট্যান্সের অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। চীন ও ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ যে ভূমিকা পালন করেছে তার অনুরূপ ভূমিকা বাংলাদেশে পালন করছে ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স-প্রবাহ। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের চমকপ্রদ উল্লম্ফনও ঘটাচ্ছে প্রবাসীদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের অনেক এলাকার গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিতে যে বিপুল গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে প্রধান অবদান রাখছে এলাকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যাধিক্য। আমার মতে, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হওয়া রেমিট্যান্স ও অন্যান্য ব্যবস্থায় দেশে নিয়ে আসা বিদেশে উপার্জিত আয়-উপার্জন প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতি বছর। তার মানে, প্রবাসী বাংলাদেশীদের ফরমাল-ইনফরমাল চ্যানেলে মোট রেমিট্যান্স ও দেশে নিয়ে আসা বৈদেশিক মুদ্রার যোগফল ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ৪৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ প্রতি বছর অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়া কি সামান্য ব্যাপার?

এই রেমিট্যান্স-প্রবাহ অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দারিদ্র্য দ্রুত নিরসনের বড় কারণ এই রেমিট্যান্স-প্রবাহ। রেমিট্যান্স-প্রবাহের সুফলভোগী পরিবারগুলোর বর্ধিত ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড়সড় সমৃদ্ধির জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাড়িঘর পাকা হচ্ছে, অন্যান্য ধরনের বসতঘরেরও মান বেড়েছে, ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, পরিবারের সদস্যদের আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সামর্থ্য বাড়ছে, শিশুমৃত্যুর হার কমছে, স্যানিটারি পায়খানার প্রচলন বাড়ছে, ঘরে ঘরে টিউবওয়েল বসে গেছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে এসেছে, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে, গ্রামে শপিং মল স্থাপনের হিড়িক পড়েছে। গ্রামের রাস্তাঘাটেও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। ফলে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত চার-পাঁচ কোটি মানুষ এখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত অবস্থানে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কৃষি খাতের সাফল্যের পেছনেও বাংলাদেশী অভিবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। কৃষিতে উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির প্রসার, সেচ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, গ্রামীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, আধুনিক স্বাস্থ্য সুবিধা গ্রহণের পারঙ্গমতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বিপুল অবদান রাখছে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে সফলতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রশংসনীয়ভাবে গতিশীল করে তুলেছে তা হলো তৈরি পোশাক শিল্পের দ্রুত প্রসার। গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশ চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশের অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ফলে ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে যেখানে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫ কোটি ডলার, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন (৫ হাজার ৫৫৬ কোটি) ডলারে, যার ৮৪ শতাংশ আসছে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। মানে তৈরি পোশাক শিল্প রফতানি আয়ের প্রায় ৪ হাজার ৬৬৭ কোটি ডলার দেশে নিয়ে আসছে। এর মধ্যে নিটওয়্যার রফতানি থেকে আসছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার এবং ওভেন গার্মেন্টস রফতানি থেকে আয় হচ্ছে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার। কিন্তু ওভেন গার্মেন্টস খাতে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন এখনো ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি না হওয়ায় রফতানি আয়ের ৬৫-৭০ শতাংশ, মানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে বিদেশে চলে যায়। অন্যদিকে নিটওয়্যার খাতে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন প্রায় ৬৫ শতাংশে পৌঁছে যাওয়ায় এ খাতের আয়ের প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার দেশেই থেকে যায়। অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বাদ দিলে নিটওয়্যার ও ওভেন গার্মেন্টস রফতানি থেকে বাংলাদেশের প্রকৃত আয় ২২-২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। অবশ্য মনে রাখতে হবে, গার্মেন্টস শিল্প ফরমাল শিল্প খাতে প্রায় ৩০ লাখ নারীর কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি বড়সড় সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছে। উপরন্তু গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারীরা সমাজের হতদরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থান থেকে এসেছেন। ফরমাল শিল্প খাতে তাদের কর্মসংস্থান হওয়ায় তারা গৃহকর্মীর মতো অপমানজনক পেশায় কাজ করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারছে। স্বামী-স্ত্রীর আয়ে তাদের সংসার মোটামুটি চলছে। তারা প্রায়ই মা-বাবার কাছে কিছু অর্থও পাঠাতে পারছেন। এটা খুবই প্রশংসনীয় যে বাংলাদেশের নারীদের প্রায় ৪১ শতাংশ বাড়ির বাইরে কর্মরত রয়েছেন, যেটা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ হার। এর জন্য গার্মেন্টস শিল্প এবং অধ্যাপক ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণ কৃতিত্বের প্রধান দাবিদার। অতএব তৈরি পোশাক শিল্পের সামাজিক অবদানকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ বলতেই হবে।

তৃতীয় যে বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে তা হলো চলমান কৃষি বিপ্লব। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপাদিত হতো মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। গত ৫০ বছরে ধান উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯২ লাখ টনে, ভুট্টার উৎপাদন এবং গম উৎপাদন যোগ করলে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ টন। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে গেছে। তরি-তরকারি, আলু, শাকসবজি, হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি গরু-মহিষের মাংস উৎপাদনেও দেশ এখন স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

চতুর্থ যে বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্বে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে, তা হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণের অভাবনীয় প্রসার। এ ক্ষুদ্র ঋণ সরবরাহ ব্যবস্থায় গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক এবং কয়েক হাজার এনজিওর অংশগ্রহণের ফলে দেশের ২ কোটি ৩০ লাখের বেশি প্রান্তিক অবস্থানের গ্রামীণ নারী ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় এসেছে। এ ঋণগ্রহীতাদের প্রায় ২৮ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণের সহায়তায় দারিদ্র্য নিরসনে সফল হওয়ায় দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দৈন্য অনেকখানি কমেছে। খোদ বাংলাদেশের শাসক মহল কর্তৃক এ ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের ইতিবাচক অবদানকে অস্বীকার করার অপপ্রয়াস সত্ত্বেও জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণকে দারিদ্র্য নিরসন ও উন্নয়নের সহায়ক উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংককে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন