পটশিল্পে আমরা ৪৬০ বছর ধরে যুক্ত

ছবি: শুভ ঘোষ, পটুয়া শম্ভু আচার্য্যের পটচিত্র। ছবি শিল্পীর সৌজন্যে

বাংলার পটচিত্র পট বা বস্ত্রের ওপর আঁকা চিত্র। বাংলায় দরবারি শিল্প আগমনের আগে চিত্রকলার ঐতিহ্যের গৌরব হিসেবে পটচিত্র স্থান করে নিয়েছিল। বাংলার পট শিল্প বলতে শুরুতেই চোখে ভাসে গাজির পট। যারা পটচিত্র আঁকেন তার পটুয়া নামে পরিচিত। বাংলাদেশে পটচিত্রের ঐতিহ্য বহন করে চলছেন পটুয়া শম্ভু আচার্য্য। শুধু তিনি নন, তার পরিবার দীর্ঘ ৪৬০ বছর ধরে বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাহিনীগুলোকে পটচিত্রে ফুটিয়ে তুলছে। বাংলাদেশে এত পুরনো পটুয়া পরিবার আর নেই। বাংলাদেশে পট শিল্পের অতীত, এর বিশিষ্টতা এবং তার পটুয়া পরিবার নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারিহা আজমিন

পটচিত্রের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা কতদিনের? আপনি কীভাবে পটুয়া হয়ে উঠলেন?

পট শিল্পের সঙ্গে আমার পরিবার দীর্ঘ ৪৬০ বছর ধরে যুক্ত আছে। আমি এ পরিবারের নবম পুরুষ। আমার বাবা, দাদা, তার বাবা এভাবে আমার আগের আরো আট প্রজন্ম যুক্ত ছিল পট শিল্পের সঙ্গে। বাংলা বর্ণমালা শেখার আগেই রঙ-তুলি দিয়ে আমার ছবি আঁকা শুরু হয়েছিল। কারণ আমি আমার বাবাকে দেখেছি ছবি আঁকেন এবং আমার মাও বাড়িতে কুলো-ডালায় নানা রকমের নকশা-আলপনা আঁকতেন। বলা যায়, আমি বেড়ে উঠেছি আঁকাআঁকির মধ্য দিয়ে। আমি পটচিত্র নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিইনি। ২০০৭ সালে একটি ওয়ার্কশপ করেছি সতিদিনের জন্য। যমুনা নদীর পাড়ে এটা আমি আয়োজন করেছিলাম। কীভাবে পটচিত্রের জন্য রঙ তৈরি করতে হয় এবং আমি কী কী ব্যবহার করে রঙ বানাই সে বিষয়গুলো তুলে ধরাই ছিল আমার ওয়ার্কশপের মূল প্রতিপাদ্য। মজার বিষয় হলো সেখানে আমার ছাত্র হয়েছিলেন আমাদের কয়েকজন বরেণ্য শিল্পী। কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, হামিদুজ্জামান খান, নিতুন কুণ্ডু, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, শাহজাহান বিকাশ, তরুণ ঘোষসহ আমার আরো কয়েকজন শিক্ষক সেখানে ছিলেন। আমি বেশকিছু প্রদর্শনী করেছি। দেশের বাইরে আমার প্রথম প্রদর্শনী ছিল ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন। দেশে এখন পর্যন্ত আমার ১৫-১৬টি প্রদর্শনী হয়েছে। আমি শুধু গাজির পট নয়; মহাভারত, মনসামঙ্গল, দেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য নিয়ে ছবি আঁকি। আমার পটচিত্র ব্রিটিশ জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম, জাপানের শিতামাসি জাদুঘর ও চীনের সাংহাই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

এ দেশে পট শিল্পের ধারাটি কীভাবে বিকশিত হয়েছে?

আমাদের একদা পূর্ববঙ্গেই পট শিল্পের উৎপত্তি এবং এর বিকাশ এ অঞ্চলেই হয়েছে। আমি আরো একটি কথা বলতে চাই। আমার পরিবারের অষ্টম পুরুষ পর্যন্ত কেউ তাদের চিনতেন না। তাদের কাজের বিষয় নিয়ে তেমন কেউ জানতেনও না। ১৯৭৭ সালে কারু শিল্পবিশারদ পণ্ডিত তোফায়েল আহমেদ কলকাতা আশুতোষ জাদুঘরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেখেন একটি পটচিত্র। ছবিটির নিচে লেখা ‘দুই বঙ্গের একটি মাত্র গাজীর পট’। এ লেখার সূত্র ধরেই তিনি আমাদের কাছে আসেন এবং আমার বাবা সুধীর আচার্য্যকে খুঁজে পান মুন্সিগঞ্জের কালিন্দীপাড়ায়। ঘটনাটা ছিল এই যে আশুতোষ জাদুঘরের সেই ছবিটি আমার বাবার আঁকা। আমার বাবা সুধীর আচার্য্য ১৯৮৯ সালে জাতীয় কারুশিল্পী পরিষদের ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন’ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। কিন্তু তা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। যেদিন এ পুরস্কারের চিঠি এসে পৌঁছায় সেদিনই বাবা মারা যান। আমার দাদুর আঁকা পটচিত্র কলকাতার গুরুসদয় জাদুঘরে আছে। আমাদের অঞ্চলের পটচিত্র এবং পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্র অঙ্কনের ধরনে ভিন্নতা আছে। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে পটচিত্রের ইতিহাস আছে বলে জানা যায়। তবে আমাদের দেশ থেকেই এর বিকাশ হয়েছে। বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে কালীন্দীপাড়ায়ই আমাদের আচার্য্য পরিবারের বাস। আমাদের অনেক বড় পরিবার ছিল। দেশভাগের পর অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। আমাদের পরিবারের এখন আমার ছেলে ও আমি আছি। আমি যখন খুব ছোট তখনো দেখেছি অনেক জেলা থেকে মানুষ পটচিত্র দেখতে আসত এবং একটি উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। তারা আমাদের বাড়ি থেকে ছবিও নিয়ে যেত। সিলেট, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকেও অনেক মানুষ আসত।

 পটচিত্রের বিশেষত্ব কী? বাংলাদেশে এখন আর্ট গ্যালারি ছাড়া তেমন কোথাও পটচিত্র দেখা যায় না। এর কারণ কী? 

পট শব্দটির মানে হলো কাপড়। বর্তমানে শব্দটি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে মোটা কাপড় বা কাগজের খণ্ড ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহার হয়। পটের ওপর তুলির সাহায্যে রঙ লাগিয়ে ছবি আঁকা, বস্তুর রূপ ফুটিয়ে তোলাই পটচিত্র। আধুনিক সময়ে এখন বাজারে যে তুলি কিনতে পাওয়া যায় তা দিয়েই ছবি আঁকেন শিল্পীরা। তবে আমি এখনো আমাদের আদি ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। ছাগলের লোম দিয়ে আমার বাবাকে দেখেছি তুলি বানাতে। আমি এখনো তা-ই করি। আমার ছবিতে বাজারের প্রস্তুতকৃত কৃত্রিম রঙ ব্যবহার করি না। চালতার রঙ, তেঁতুল, গাছের আঠা, সাবু দানা, ইটের গুঁড়ো ব্যবহার করে আমি রঙ তৈরি করি। এটি পটচিত্রের বিশেষত্ব। এর রঙ হবে প্রাকৃতিক। ছবির দিকে তাকালে একটি আদিকথন মনে হবে। আদিকাল থেকে এটিই হয়ে আসছে এবং তা-ই হওয়া উচিত। পটচিত্রের মাধ্যমে আমাদের পুরনো গল্পগুলো ধারাবাহিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। যেমন আমি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি করেছি। ১৭৫৭-৭১ পর্যন্ত মোট ২৪ খণ্ড এঁকেছি, যেটি ‘মহাপুরুষের অন্তর্ধান: সহি শহীদ মুজিবনামা’ নামে প্রদর্শিত হয়েছে। ২০০২ সালে আমার কাজটি সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং জাতীয় জাদুঘরে একবার প্রদর্শিত হয়েছিল। আরো একটি পটচিত্র আছে আমার, মহাভারত নিয়ে। ১০০ ফুটের ফ্রেমের কাজটি আমার শেষ করতে সময় লেগেছিল দেড় বছর। এটির নাম সমুদ্রমন্থন। এ কাজগুলোর কিছু আলাদা বিশেষত্ব আছে—রঙের ব্যবহার এবং ছবির দিকে তাকালে আধুনিক দৃশ্য বলে মনে হবে না। বর্তমানে আর্ট গ্যালারিতেও যে পটচিত্রগুলো প্রদর্শিত হয় তার সবই অ্যাক্রিলিক রঙে করা। কেমন যেন দেখতে, আদিগল্প অঙ্কিত কিন্তু রঙগুলো আধুনিক। এভাবে আসলে পটচিত্র হয় না।

বর্তমানে আপনি ছাড়া আপনার পরিবারের কতজন এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন? সবার অঙ্কনের ধরন কি একই?

বর্তমানে আমি, আমার দুই মেয়ে, আমার ছেলেসহ দশম পুরুষ পর্যন্ত আমার পরিবার পট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে। আমি ও আমার সন্তানরা কেউ পটচিত্র নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিইনি। আমি বলব, এটি রক্তের টান থেকেই হয়। ছোটবেলা থেকে দেখতে দেখতেই আমাদের শেখা। পটচিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে আমরা সবাই প্রকৃতি থেকে রঙ সংগ্রহ করি এবং এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

 আপনার অঙ্কিত পটচিত্রের ধরন এবং বর্তমানের তরুণ শিল্পীদের কাজের ধরনে ফারাক কতটা?

পটচিত্রকে বলা হয় দ্বিমাত্রিক চিত্র। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি পটচিত্র বহুমাত্রিক। পটচিত্র যখন আবিষ্কার হয়েছিল তখন মানুষের ভাবনায় ছিল না কীভাবে মানুষের দুই চোখ, একটি নাক ও মুখ আঁকবে। তাই তখন ছবি হতো এক চোখের। এ বিষয়গুলোই পটচিত্রকে আলাদা করেছে। আমার আঁকা পটচিত্র দেখলে মনে হবে কোথায় যেন দেখেছি। আদি বা পুরনো কথন বলেই মনে হবে। এর মূল কারণ আমার রঙ, আমার তুলির ভিন্নতা। বর্তমানে আসল পটুয়া শিল্পী নেই এবং আমার পটচিত্রের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনেক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ওই ছবিগুলোকেই নকল করে অনেকে আঁকছেন। দুঃখজনক হলো আমি দেখেছি এ ছবিগুলো নিয়ে অনেকেই প্রদর্শনীও করছে। ফলে আমি মনে করি আসল পটচিত্র নিয়ে এখন বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন