রেমব্রান্টের স্কেচে মোগল ছায়া

আহমেদ দীন রুমি

শাহজাহান অ্যান্ড দারা শিকো ছবি: গেটি মিউজিয়াম, শাহজাহান অ্যান্ড হিজ সন ছবি: হিস্টোরিয়ান অব নেদারল্যান্ডিশ আর্ট

২০১৮ সাল। গেটি মিউজিয়ামে প্রদর্শনী চলছে। ডাচ চিত্রকলার পুরোধা পুরুষ রেমব্রান্টের চিত্রকলা। কিন্তু সেই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে উঠে এল অন্য একটা সূত্র। সতেরো শতকের নেদারল্যান্ডসের চিত্রকলার সঙ্গে মোগল চিত্রকলার গভীর যোগাযোগের সূত্র। উত্তর ইউরোপের দেশটির সঙ্গে মোগলদের বাণিজ্যিক বিনিময় ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই বাণিজ্যের সূত্র ধরেই ঘটে চিন্তার লেনদেন। তার বড় নজির হলো মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দারবারে ইউরোপীয় চিত্রকরদের ‍পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া। ইউরোপীয় পেইন্টিং নিয়ে জাহাঙ্গীরের আগ্রহ ছিল। তিনি ইউরোপীয় আর্ট সংগ্রহে রাখতেন, দরবারে জায়গা দিতেন ইউরোপীয় চিত্রকরদের। উৎসাহিত করতেন প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের রীতির মিশেলকে। অবশ্য শাহজাহানের আমলে এ প্রবণতা এগিয়ে যায় আরেক ধাপ। তার আমলে চিত্রকলার ইউরোপীয় ঘরানা ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করেছে মোগল চিত্রকর্মে। ঠিক এ সময়টাতেই ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীরা ভারতের ধ্রুপদি শিল্পকর্মগুলো ইউরোপের বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে শুরু করেন। আর ভারতীয় চিত্রকলা মানে তখন মোগল চিত্রকলাই। মোগল দরবার নিয়ে ডাচ অভিজাতদের মধ্যে তখন আগ্রহ তুঙ্গে। চিত্রকলার বাজারও বেশ চড়া। সেখানকার শিল্পীরা পর্যন্ত সংগ্রহ করতেন মোগল চিত্রকলার নীতিপদ্ধতি। তাদের একজন ছিলেন রেমব্রান্ট।

১৬০৬ সালে জন্ম নেয়া রেমব্রান্টকে গণ্য করা হয় চিত্রকলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন হিসেবে। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন ভারতীয় চিত্রকলার স্টাইল ও মোটিফ। মোগল দরবারে আঁকা একটি চিত্রকর্মে দেখা যায়, জুজার সিং বুন্দেলা শাহজাহানের সামনে নতজানু হয়ে আছেন। সেখানে শাহজাহান চিত্রিত হয়েছেন খ্রিস্টীয় আইকনোগ্রাফির আদলে, যা নিঃসন্দেহে ইউরোপীয় প্রভাব। তাছাড়া রঙ আর উপাদানেও ছিল প্রভাব। রেমব্রান্টের জন্য সেসব দেখার প্রবণতা ক্রমে পরিণত হয় অনুপ্রেরণায়। সে অনুপ্রেরণা থেকেই নিজের মতো করে আঁকলেন মোগল সম্রাটদের। তার রসদ কিন্তু কঠিন ছিল না। সতেরো শতকের দিকে হাজার হাজার ভারতীয় চিত্রকর্ম গেছে ইউরোপে। মোগল চিত্রকলার বড় একটা বাজার ছিল তখন নেদারল্যান্ডস। সবচেয়ে অদ্ভুত কথা হলো, রেমব্রান্ট কখনো ভারত সফর করেননি। এমনকি কখনো নেদারল্যান্ডস থেকেও বের হননি। তার পরও এ বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি মোগল দরবার সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। যেহেতু বিপুল পরিমাণ চিত্রকর্ম সেখানে গেছে আর যেহেতু ভারতীয় কাজগুলো প্রায়ই এক রকম, ফলে এটা হলফ করে বলা কঠিন, ঠিক কোন কাজটা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কোন স্কেচটা তৈরি করেছেন রেমব্রান্ট।

মোগল চিত্রকলাকে পাশে রেখে দেখা গেলে সহজেই ধরা পড়ে, কীভাবে রেমব্রান্ট মোগল চিত্রকলা থেকে প্রভাবিত হয়েছেন। আলো, ছায়া ও মোটিফ নির্মাণেও তার ছাপ স্পষ্ট। তবে পশ্চিমা প্রভাবের যে দাগ ভারতীয় চিত্রকলায় দেখা যায়, রেমব্রান্ট তা সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। বোঝা যায়, মোগল চিত্রকলায় ইউরোপীয় উপাদান খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে নিখাদ মোগল উপাদানই তাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। পোর্ট্রেটের জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন রেমব্রান্ট। সম্ভবত এ কারণেই অনুকরণ ও স্কেচ করার সময় তিনি ভারতীয় শাসকদের পোর্ট্রেটকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার অনেক স্কেচই ছিল এশীয় কাগজের ওপরে আঁকা। ফলে তিনি কেবল মোগল চিত্রকলার প্রতিলিপি ও বিষয়বস্তু নিয়েই আগ্রহী ছিলেন, এটা বললে ভুল হবে। বরং তিনি অনুরাগী ছিলেন মোগল উপাদান নিয়েও। তবে এখানকার চিত্রকলায় যেখানে রঙের ব্যবহার প্রধান হয়ে উঠেছিল, সেখানে রেমব্রান্টের মুনশিয়ানা ছিল লাইনের ব্যবহার ও ভারসাম্য স্থাপনে। ফর্মের দিক থেকে তিনি ধ্রুপদি ভারতীয় ঘরানাকেই অনুসরণ করেছেন। অবশ্য কতক ক্ষেত্রে স্বীয় ঐতিহ্যের মিশেলে বাড়িয়ে তুলেছেন গভীরতা। রেমব্রান্টের অন্যান্য কাজের মধ্যে, বিশেষ করে যিশু খ্রিস্টের লিথোগ্রাফ নির্মাণের ক্ষেত্রে মোগল ঘরানার চিত্রকলার প্রভাব স্পষ্ট। পরিধেয়, মুখভঙ্গি, মানুষের জমায়েত—সবকিছুতেই যেন ভারতকে তুলে ধরেছেন। 

রেমব্রান্ট চিত্রকর্মগুলো আঠারো শতকের গোড়ার দিকে একত্র করেন ব্রিটিশ চিত্রকর ও সংগ্রাহক জোনাথান রিচার্ডসন। তিনি রেমব্রান্টের সঙ্গে দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিলেন। রিচার্ডসনের মৃত্যুর পর তার ছেলে সেগুলোকে নিলামে তোলেন বিক্রির জন্য। তবে তার সৃষ্টিকর্মের অধিকাংশই এখনো অক্ষুণ্ন। উপমহাদেশ থেকে দূরের এক চিত্রশিল্পীর কর্মে এতটা গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে এখানকার প্রভাব, তা চিত্রকলার ইতিহাসে অনন্য উদাহরণ হিসেবেই টিকে থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন