চার যুগেও আনুষ্ঠানিক খাত হয়ে উঠতে পারেনি শ্রমশক্তি রফতানি

দেশের শ্রমশক্তি রফতানি ও অভিবাসন বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক সি আর আবরার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে চার দশকের অধ্যাপনা শেষে এখন কাজ করছেন রোহিঙ্গা অভিবাসী, শ্রম রফতানি, সামাজিক নিরাপত্তা, রিক্রুটমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে। দেশের শ্রমশক্তি রফতানি খাত, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা, রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরফিন শরিয়ত

দেশের শ্রমশক্তি রফতানির সময়কাল প্রায় অর্ধশতক ছুঁইছুঁই। এ সময়ে শ্রমশক্তি রফতানিতে আমাদের অর্জন এবং সংকটকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 

দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে অভিবাসন এখন জাতীয় শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশেষ করে জাতীয় সংকটকাল, অর্থনৈতিক মন্দা, কভিড এবং বর্তমান অর্থনৈতিক টানাপড়েনে শ্রম অভিবাসনের গুরুত্ব ভীষণভাবে বেড়েছে। অতীতের তুলনায় এ খাতের ভূমিকা যেমন বেড়েছে, তেমনি এ খাতকে ঢেলে সাজানোর গুরুত্বও বেড়েছে। এর জন্য নীতিনির্ধারণ, আইন প্রণয়ন, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে যাতে সেবা প্রদান করা যায় তার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। 

বিপরীতে মোটা দাগে বলতে গেলে, অভিবাসন ব্যয় এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, অভিবাসীরা হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট দেশে নিয়োগকর্তা অথবা এজেন্টদের মাধ্যমে নানা সমস্যার মুখে পড়ছেন। কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছেন না, প্রত্যাশিত বেতনও দেয়া হচ্ছে না। নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মুখে পড়ছেন, বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। আবার প্রবাস ফেরতদের পুনঃএকত্রীকরণের উদ্যোগ আগে ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে এ উদ্যোগ নেয়া হলেও বড় আকারে সম্ভব হয়নি। এসব বাধা দূর করতে হবে। নিগ্রহের শিকার প্রবাসীদের ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে ভূমিকা পালন করতে হবে। সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস রাষ্ট্র, রাষ্ট্রকে এখানে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। নিয়োগ এখনো দুষ্ট চক্র দিয়ে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত। এগুলো থেকে বের হওয়ার উপায় আমরা বের করতে পারিনি। এসব সমস্যাকে চিহ্নিত করে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। 

নীতিমালা, আইন, সরকারের আদেশ জারি হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কতটুকু হচ্ছে?

নীতিমালা রয়েছে কিন্তু সেগুলো কার্যকর করা হচ্ছে না। দুষ্ট চক্র এমন শক্তিশালী যে তাদের এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। মালয়েশিয়ার ঘটনাগুলোয় মূল হোতা কারা তা সর্বজনবিদিত। বেসরকারি খাত, সরকার এবং নাগরিক সমাজও সেগুলো জানে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। কেন নেয়া হচ্ছে না, কারা এর মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে তা কর্তৃপক্ষকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। 

গত চার দশক শ্রমশক্তি রফতানির সরকারি সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বোয়েসেল (বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড)। বোয়েসেলের অর্জনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সরকারিভাবে দক্ষ শ্রমিকদের পাঠানোই এখন বোয়েসেলের মূল ভূমিকা। দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বিশ্বব্যাপী রয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন এ সংখ্যা বাড়ছে না সেটি তলিয়ে দেখতে হবে। যে পরিকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বোয়েসেল গঠিত, সেটাকে কীভাবে আরো সচল করা যায়, সেখানে কী ধরনের মানবসম্পদের বিনিয়োগ করতে হবে, নতুন বাজারে প্রবেশের জন্য তাদের আরো সক্রিয় হতে হবে। এটা সরকারকেই করতে হবে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বোয়েসেল গঠিত হয়েছে, এখন পর্যন্ত তারা তা অর্জন করতে পারেনি বলে আমার মনে হয়। দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত খুব বেশি এগিয়ে আসে না। অদক্ষ শ্রমিক পাঠালে তারা যতটুকু লাভবান হয়, দক্ষ শ্রমশক্তিতে তারা ততটুকু লাভবান হতে পারে না। এক্ষেত্রে অবশ্যই বোয়েসেলের ভূমিকা থাকা দরকার। 

বেসরকারি খাতের শ্রম রফতানির এজেন্সিগুলো দেশে আদম ব্যবসায়ী বা বেপারি হিসেবে পরিচিত। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আদম ব্যবসা একটি নেতিবাচক এবং অপমানজনক শব্দ। এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?

শ্রমশক্তি রফতানিকারকদের আখ্যায়িত করার এ পদ্ধতি একেবারে অগ্রহণযোগ্য। তবে আমার মনে হয়, আমরা একটু এগিয়েছি। আগে আরো বেশি আখ্যায়িত করা হতো। আমাদের যথেষ্ট ভালো এজেন্সি রয়েছে, তারা দক্ষ শ্রমিক পাঠাচ্ছে। এথিক্যাল রিক্রুটিং এজেন্সি সংখ্যায় কম হলেও রয়েছে। এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। সবাই যে দুষ্ট কর্মে নিয়োজিত এমনটা নয়। 

বায়রার (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ) উচিত ছিল সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং এর সদস্যদের এথিক্যাল রিক্রুটমেন্টের প্রতি আগ্রহী করা। আদতেই তারা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। তাদের নানা অসুবিধা রয়েছে। তার পরও আমি মনে করি, আদম বেপারি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। পরবর্তী প্রজন্মে যারা রিক্রুটিংয়ে আসছেন, তাদের সক্রিয় ভূমিকা রাখা দরকার। যারা নৈতিক রিক্রুটমেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের কোনো ভূমিকা বায়রায় নেই। কী কারণে নেই, কীভাবে এটা হচ্ছে তার জন্য নানা ব্যাখ্যার দাবিদার। করপোরেট স্বার্থ রক্ষার জন্য বায়রার যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল এখন পর্যন্ত বায়রা সেটি অর্জন করতে পারেনি। 

নতুন বাজার, নতুন কর্মসংস্থান খোঁজার উদ্যোগ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। নতুন শ্রমবাজার খোঁজার ক্ষেত্রে আমাদের এজেন্সিগুলোর সংকট কোথায়?

শ্রমশক্তি রফতানির বড় অংশই সংগঠিত হয় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও অভিবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে। রিক্রুটিং এজেন্সির ভূমিকা অপেক্ষাকৃত অনেক কম। ডিমান্ড লেটার চলে আসার পর সেটাকে প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা রয়েছে। এর বাইরে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হয়ে তারা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে এমন খুবই নগণ্য উদাহরণ আছে। এ ধরনের ভূমিকার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও অবকাঠামো বেসরকারি এজেন্সিগুলোর নেই। ব্যবসায়ীরা উদ্যোগী হলে সহযোগিতার মাধ্যমে এ সংকট অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব। 

যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সংশ্লিষ্ট দেশের নিয়োগকর্তার কাছ থেকে কাজ নিয়ে আসতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের সংশ্লিষ্টতা বাড়তেই থাকবে। এর জন্য সক্রিয় উদ্যোগ সরকার ও বেসরকারি খাতকে নিতে হবে। এর জন্য প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, আইনি কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে।

আপনি বলছিলেন, শ্রম রফতানি অনানুষ্ঠানিক খাত হিসেবে কাজ করছে। তার মানে কি এখানে এখনো ‘করপোরেট কালচার’ তৈরি হয়নি? 

চার যুগ পার হলেও এ শ্রমশক্তি রফতানি এখনো আনুষ্ঠানিক খাত হয়ে উঠতে পারেনি। সে অর্থে করপোরেট কালচার এখানে তৈরি হয়নি। রেডিমেড গার্মেন্টস যে ধারাবাহিকতা ও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এতখানি পরিপক্ব হয়নি। যার ফলে করপোরেট ইন্টারেস্ট দেখতে বিজিএমইএ গার্মেন্ট খাতের জন্য যেভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, বায়রা সেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কেন এমনটি হচ্ছে তা অনুসন্ধান করতে হবে। একই সঙ্গে এ পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

দেশের অভিবাসী শ্রমিকরা বিভিন্ন দেশ থেকে পলায়ন করে। এক দেশের কর্মক্ষেত্র ছেড়ে অনিশ্চিত, অনিরাপদ গন্তব্য খুঁজতে চায় কেন তারা?

যেটাকে আমরা নিশ্চিত ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র বলে থাকি সচরাচর তা থাকে না। গবেষণার মাধ্যমে ও বিদেশফেরত অভিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, অভিবাসীদের যে ধরনের কাজ, বেতন, কর্মস্থল সম্পর্কে আশ্বাস দেয়া হয়, তার ন্যূনতম শর্ত মালিক, এজেন্ট পালন করলে শ্রমিকরা অন্য জায়গায় যাওয়ার উদাহরণ প্রাসঙ্গিকভাবে কম। আনুষ্ঠানিকভাবে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েও তারা কাজ পাচ্ছেন না। 

এ প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোয় খুব বেশি আলোচনা দেখি না। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। মানুষের এটা সহজাত প্রবণতা যে কোথাও ভালো সুযোগ তৈরি হলে মানুষ সেখানে যাবে। অনেকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ যাওয়ার জন্য পাড়ি জমান। এখানে দুষ্ট চক্র রয়েছে, অভিবাসীদের তারা প্রভাবিত করে, উদ্বুদ্ধ করে। এ ধরনের তৎপরতা বন্ধে গণহারে প্রচারণা, প্রমাণ উপস্থাপন করা দরকার। এ শ্রমিকদের জন্য কিছু করা হচ্ছে না। এটাকে ধর্তব্যের মধ্যেও নেয়া হচ্ছে না। ওখানকার মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করছেন তা আমরা খতিয়ে দেখতেও চাই না। আমরাও তাদের ধরে নিতে চাই অবৈধ অভিবাসী হিসেবে। 

করোনার সময় শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসার পর আইনগত ব্যবস্থা নিতে তাদের আটক করা হয়েছে। পরবর্তীকালে আদালতের আদেশের কারণে তাদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তারা কেন ওই পথ বেছে নিয়েছিলেন, কেন তারা অবৈধভাবে যাচ্ছেন তার কার্যকারণ খোঁজার ব্যবস্থা করা হলো না। যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র এ বিষয়গুলোকে সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব না নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে, এ সমস্যার সমাধান হবে না। 

প্রবাসীদের কল্যাণে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড কাজ করে। কল্যাণ বোর্ড প্রবাসীদের কতটুকু কল্যাণ করতে পারে বলে মনে হয়। সংস্থাটির সংকট এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই।

অনেক বছর ধরেই প্রবাসীদের কল্যাণ বলতে মরদেহ নিয়ে আসা, সাহায্য করা, অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ, সন্তানদের বৃত্তি দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাম্প্রতিক কালে নীতি প্রণয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের কারণে এ তৎপরতাগুলো বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। তা না করে দেখা যাচ্ছে, ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ডের টাকা খরচ করে সরকারি বিভিন্ন ব্যয় পরিশোধ করা হচ্ছে। প্রবাসীদের সেবা প্রদান, প্রশাসনিক ব্যয় সরকারের কাছ থেকে আসা প্রয়োজন। ওয়েলফেয়ার ফান্ডের টাকা পরিবারগুলো ও শ্রমিকরা যাতে ভোগ করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনিক কাজ, সংস্থার বেতন প্রদান, বিভিন্ন গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এ অর্থ ব্যবহার করা অযৌক্তিক হবে। এর জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা নানা সময় বলে এসেছি। শ্রমিকদেরও প্রতিনিধিত্ব এখানে প্রয়োজন, সেই প্রতিনিধিত্ব এ ফান্ড ম্যানেজমেন্টে নেই। বিষয়টি দেখতে হবে আমাদের। 

সরকার রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বিপরীতে হুন্ডির ব্যবহার বাড়ছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। হুন্ডি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। সরকারের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাও হুন্ডি প্রতিরোধে সক্ষম হচ্ছে না। এর কারণ কী?

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং যত দিন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে না আনা হচ্ছে ততদিন হুন্ডি থাকবে। ব্যবসার এ লুকোচুরিকে সহজতর করে হুন্ডির টাকা। বৃহত্তর বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ, প্রণোদনার বিষয়গুলো সমন্বয় করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য হুন্ডি কমাতে হবে, এটা দিয়ে হবে না। 

আমাদের শ্রমিকদের বড় একটি অংশ অনিয়মিত অবস্থায় রয়েছে। তারা চাইলেও ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে পারেন না। হুন্ডি ব্যবস্থা ব্যাংক ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। ব্যাংকের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, পেপার ওয়ার্ক, ছুটির দিনগুলোয় ব্যাংকগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। অথচ হুন্ডি সিস্টেমে যেকোনো দিন টাকা পাঠাতে পারবেন। একই সঙ্গে তা বিতরণও সম্ভব। 

পরিবার ও সামাজিক কারণেও হুন্ডি ব্যবস্থা প্রচলিত। স্ত্রী চান না শ্বশুর জানুক তার নামে টাকা এসেছে, বাবা চান না ছেলের বউ জানুক তার নামে টাকা এসেছে। অফিশিয়াল দর এবং কার্ব মার্কেটের দরের মধ্যে যতদিন পার্থক্য থাকবে ততদিন হুন্ডি ব্যবস্থা নির্মূল করা যাবে না। দেশপ্রেমের বুলি আউড়িয়ে এ ব্যবস্থা বন্ধ করা যাবে না। বড় বড় ব্যবসায়ী যেখানে দেশপ্রেম দেখাচ্ছে না, সেখানে অভিবাসী শ্রমিকরা দেশপ্রেম দেখাবে তা প্রত্যাশা করা ভুল। কভিডের সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতার মধ্যে হুন্ডির চাহিদা কমে গিয়েছিল, তখন রেমিট্যান্স বাড়তে থাকে। যখন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হলো, তখন আবার হুন্ডির প্রবণতা বেড়ে গেল। 

হুন্ডি ও রেমিট্যান্সকে বৃহত্তর পরিসরে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, আমদানি-রফতানির বিষয়, অর্থায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। এটাকে শুধু রেমিট্যান্সের সমস্যা হিসেবে দেখলে হবে না। 

রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে?

বাংলাদেশ যে আশ্বাসের ভিত্তিতে চুক্তি করেছিল চুক্তির সে শর্তগুলো দিয়ে কার্যকরভাবে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হবে না। যে বন্ধু রাষ্ট্র আমাদের আশ্বস্ত করেছিল, তারা উপর্যুপরি অভিযুক্ত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করে আসছে। বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র বলে কথিত দুটি বড় এশিয়ান শক্তি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া বার্মিজ রাষ্ট্রকে (মিয়ানমার) অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে আসছে। সেক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনৈতিক দক্ষতার বড় ধরনের ঘাটতি দেখে এসেছি। 

রোহিঙ্গাদের মতো বড় একটি জনগোষ্ঠী কাজহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা জানিয়েছে, আমাদের জীবনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াটাই শুধু নিশ্চিত। এর বাইরে আমাদের জীবনের আর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ ধরনের হতাশাবাদী জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের যুক্ত করার মতো কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। তারা এ দেশের মধ্যে লীন হয়ে যাবে—এ ভয়ে এগুলো না করলে তাদের বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। 

বড় ধরনের মানসিক আঘাতের পর এমন পরিবেশে থাকার মধ্য দিয়ে তারা কোনো অপশক্তি দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে রোহিঙ্গাদের ইতিবাচক মানবিক গুণগুলোকে পরিচর্যা করতে হবে, তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। এটা সত্য, দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় রয়েছে। কিন্তু এমনভাবে রাখলে তা দিয়ে কি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষা করতে পারছি? প্রতিনিয়তই আমরা নানা সমস্যা দেখছি। অদূর ভবিষ্যতে তারা যদি চলে যায়, তাহলে খুব ভালো, যদি না যায় তাহলে এ জনগোষ্ঠীকে প্রস্তুত করতে হবে এবং আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। 

এ সংকট আমাদের সৃষ্ট নয় তা ঠিক, একই সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে যা মোকাবেলা করা প্রয়োজন ছিল তা করতে পারিনি। আমরা এমন কিছু ধারণার ওপর ভিত্তি করে তাদের গ্রহণ করেছি, মিয়ানমার এর পুরো সুযোগ গ্রহণ করেছে। এখন পর্যন্ত তারা অনড় অবস্থানে রয়েছে। যখনই বলা হয়, প্রত্যাবাসন হবে, করবে। এ বলা খুব কার্যকর পর্যায়ে দাঁড়াচ্ছে না। এর জন্য আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। মূলত এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমস্যা, আমাদের সমস্যা নয়। কিন্তু দায় আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। এর জন্য আমাদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অব্যাহতভাবে কথা বলে যেতে হবে। অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন