অভিমত

খেলাপি ঋণের লাগাম টানা হবে কি

জালাল উদ্দিন ওমর

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্যাংক সেক্টরে খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। ২০২৩ সালের জুনের শেষে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। অথচ ২০২৩ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। মন্দ ঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। জনতা, অগ্রণী, সোনালী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের মোট ঋণের ২৫ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ খেলাপি ঋণ। ২০২৩ সালের জুন শেষে এই পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা খেলাপি। 

ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকে ২৩ দশমিক ৫১, সোনালী ব্যাংকে ১৪ দশমিক ৯৩, রূপালী ব্যাংকে ১৯ দশমিক শূন্য ৬ ও বেসিক ব্যাংকে ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ৮৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং পদ্মা ব্যাংকে ৬৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক ব্যাংকের মূলধন কাঠামো আরো দুর্বল হয়েছে এবং প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণও বেড়েছে।

খেলাপি ঋণের বিদ্যমান পরিমাণের বাইরে বিরাট অংকের ঋণ রাইট অফ করা আছে, যা ব্যালান্স শিটে অন্তর্ভুক্ত নয়। ব্যাংকগুলো প্রতি বছর বিরাট অংকের খেলাপি ঋণকে রাইট অফ করে এবং তা ব্যালান্স শিট থেকে বাদ দেয়। রাইট অফ করা এ ঋণ ব্যালান্স শিটের অন্তর্ভুক্ত থাকে না বিধায়, তা খেলাপি ঋণ হিসেবে ব্যাংকগুলো প্রকাশ করে না। তাছাড়া ব্যাংকগুলো বিরাট অংকের খেলাপি ঋণ বিভিন্ন মেয়াদে রিশিডিউল করেছে, যা খেলাপি ঋণ হলেও রিশিডিউল করার কারণে আর খেলাপি ঋণে গণ্য করে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ভারতে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ, শ্রীলংকায় ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বাড়লে দেশের ঋণমানও কিন্তু কমে যায়। ফলে সবদিকেই সমস্যা। সুতরাং খেলাপি ঋণের লাগাম টানতেই হবে। 

ঋণের সুদই ব্যাংকের মূল আয়। কিন্তু ঋণ যখন খেলাপি হয় তখন ব্যাংকের আয় কমে যায়, ফলে ব্যাংকের গতিও কমে যায়। কারণ এই বিরাট পরিমাণ টাকা থেকে ব্যাংক কোনো প্রকার আয় করতে পারে না, আবার এ ঋণ অনাদায়ী হওয়ার কারণে তা নতুন করে বিনিয়োগও করতে পারে না। ফলে ব্যাংকের আয়, বিনিয়োগ এবং গতিশীলতাও কমে যায়। আবার এ খেলাপি ঋণের বিপরীতে আয় থেকে প্রভিশন রাখতে হয় বিধায়, ব্যাংকের আয়ের বিরাট একটি অংশ খেলাপি ঋণের ঘাটতি মেটাতে ব্যয় করতে হয়। এ অবস্থায় ব্যাংকের অবস্থা ক্রমান্বয়ে নাজুক থেকে নাজুকতর হতে থাকে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের ডিপোজিটররা অপেক্ষাকৃত কম লভ্যাংশ পান। ব্যাংকের আমানত মূলত এ দেশের লাখো মেহনতি মানুষদের কষ্টার্জিত অর্থ। কিন্তু এসব টাকা আজ গুটি কয়েক ঋণখেলাপির পকেটে ঢুকে আছে। বাংলাদেশে আজ যত টাকা খেলাপি ঋণ আছে, তা যদি খেলাপি না হত, তাহলে শুধুমাত্র এই টাকা দিয়েই দেশে হাজারো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ, হাসপাতাল এবং বিদ্যুত কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেত। করা যেত পদ্মা সেতুর মত চারটি ব্রিজ। তখন এদেশ অনেক উন্নত হত। 

দুর্বল ব্যবস্থাপনা, পেশাদারিত্বের অভাব এবং অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে একটি প্রজেক্টের গুরুত্ব এবং ভবিষ্যৎ যথাযথভাবে বিবেচনা না করে ঋণ প্রদান করা হয়। অধিকন্তু ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা পুরোপুরিভাবে ওই প্রজেক্টের উন্নয়ন এবং পরিচালনায় ব্যয় করছে কিনা ব্যাংক তা যথাযথ মনিটরিং করে না। এ সুযোগে গ্রাহক তার গ্রহণকৃত ঋণ থেকে একটি অংশ জমি কেনা, দামি গাড়ি কেনা এবং বিলাসবহুল বাড়ি তৈরির জন্য ব্যয় করে। ফলে ঋণের অর্থ যথাযথভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যয় না হওয়ার কারণে ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠান যথাসময়ে উৎপাদনে যেতে পারে না। ফলে ওই শিল্প দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ঋণগ্রহীতা যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ঋণ অনুমোদনের সময় একটি প্রতিষ্ঠানের মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং অতিরিক্ত ঋণ প্রদান শুরুতেই খেলাপি ঋণের সুযোগ সৃষ্টি করে। 

অন্যদিকে প্রয়োজনের তুলনায় কম ঋণ প্রদানও খেলাপি ঋণ সৃষ্টি করে। পরিমাণমতো ঋণ না পাওয়ায় প্রাহক যথাসময়ে প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে পারে না। ফলে আয় হয় না এবং গ্রাহক ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারে না। ফলে এখানেও খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়। সুতরাং ঋণ প্রদান এবং ঋণপ্রবাহকে ব্যালান্স করতে হবে। অত্যধিক মুনাফা অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতাও খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দা ভাবও খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য অনেক সময় দায়ী। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসে না, শিল্প-কারখানা ঠিকমতো চলে না। এসব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী/শিল্পপতিরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে তারা ব্যাংকের ঋণ ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারে না এবং ঋণ খেলাপির সৃষ্টি হয়। বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ব্যবসায়ীরা যখন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তখনো তার প্রভাবে খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে বাস্তবতার আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে ঋণ একটি চলমান এবং রিভলবিং প্রক্রিয়া। কোনো কারণে ঋণপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে শিল্প-কারখানা রুগ্‌ণ হয়ে যায় এবং বিদ্যমান ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণ নির্ণয়, বিদ্যমান খেলাপি ঋণ আদায় এবং নতুন খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পথ বন্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব সিইওর সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হোক, যেটি নিয়মিতভাবে বৈঠক করবে এবং ব্যাংক সেক্টরে বিদ্যমান ঋণখেলাপি সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করবে। 

আইনের আশ্রয় নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করাটা অনেক সময় বেশ কষ্টকর। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আদালতে মামলা করা হলেও তা মীমাংসা হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য সরকার অর্থঋণ আদালত প্রতিষ্ঠা করেছে। মামলা বেশি হওয়ার কারণে এখানেও জট লেগে আছে। তাছাড়া অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারছে না আর এক্ষেত্রে ঋণখেলাপিরা সুবিধা পাচ্ছে। অন্যদিকে নিলামের মাধ্যমে বন্ধকীকৃত সম্পদ বিক্রি করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। বন্ধকীকৃত সম্পত্তি বিক্রির জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিলাম আহ্বান করা হলেও তা অধিকারে যেতে পারবে না মনে করে ক্রেতারা কিনতে কম আগ্রহ দেখায়। কোনো ক্রেতা আগ্রহী হলেও তিনি ওই সম্পত্তির জন্য অপেক্ষাকৃত কম মূল্য দিতে চায়। ফলে খেলাপি ঋণ যথাযথভাবে আদায় করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। বর্তমানে অনেক ব্যক্তি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে, সেই ঋণ পরিশোধ না করে সপরিবারে বিদেশে বসবাস করছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি গ্রাহকের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ সমঝোতার মাধ্যমেও খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব এবং এটা অনেক বেশি কার্যকর। মনে রাখতে হবে গ্রাহকেরা ব্যাংকারের বন্ধু, ‘‌শত্রু’ নয়। আর গ্রাহক ভালো থাকলেই ব্যাংকও ভালো থাকে। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আলাদা কোম্পানি গঠন এবং এজন্য আইন প্রণয়ন করা হোক। এসব কোম্পানির কাজই হবে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায় করা। বিনিময়ে তারা কমিশন নেবে। রেটিং কোম্পানি এবং সার্ভে কোম্পানির মতো খেলাপি ঋণ আদায়ে আলাদা কোনো কোম্পানিকে নিযুক্ত করা গেলে খেলাপি ঋণ আদায়ে অনেক বেশি গতি আসবে এবং ব্যাংক সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক কমে আসবে।

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুন খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য সুপারভিশন, গাইডেন্স ও মনিটরিং আরো বাড়াতে হবে। এসবের পাশাপাশি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। 

মনে রাখতে হবে দেশের অর্থনীতি পুরোটাই ব্যাংক সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। অধিকন্তু অর্থঋণ আদালতসহ আইনি প্রক্রিয়াকে আরো উন্নত এবং সংস্কার করতে হবে, যাতে আইনের সাহায্য নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা যায় এবং ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। ঋণখেলাপিদের যথাযথ শাস্তি দেয়া হোক। যেনতেন প্রকারে ঋণ প্রদান করে মুনাফা অর্জনের টার্গেট ব্যাংকগুলোকে পরিহার করতেই হবে। কারণ যেনতেনভাবে প্রদত্ত ঋণ সময়ের ব্যবধানে খেলাপি হবেই। ব্যাংকগুলোকে তার ঋণ নীতিমালা পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং ঋণকে বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করতে হবে। গ্রাহকেরা বলে ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ায় তারা ঋণখেলাপি। কিন্তু ব্যবসার পুরো টাকাটাই তো আর ক্ষতি হয়নি। তাহলে পুরো ঋণই খেলাপি হবে কেন? আসল কথা হচ্ছে ব্যাংকের ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ না করা কিছু লোকের কাছে একটা কালচারে পরিণত হযেছে। এ অবস্থায় দেশের কল্যাণে খেলাপি ঋণ কমাতেই হবে। তার জন্য ব্যাংকগুলোতে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কর্মকর্তাদের মধ্যে সততা, দক্ষতা ও পেশাদারত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। কর্মক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং কর্মকর্তাদের মাঝে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। কর্মকর্তারা সৎ না হলে ঋণ বিতরণে অনিয়ম হবে। আর অভিজ্ঞতা সবসময় কিন্তু যোগ্যতার বিকল্প হতে পারে না। অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ না হলে এবং অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান ও দূরদর্শিতা না থাকলে তাদের পক্ষে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ব্যাংক খাতকে সমানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কখনো সম্ভব নয়। সুতরাং যেকোনো মূল্যে খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে হবে।

জালাল উদ্দিন ওমর: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক 

সিইও, আশা এগ্রো, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন