ভারতে বকেয়া পড়ছে এখন আবার নেপাল থেকে বিদ্যুৎ যোগ হচ্ছে

আবু তাহের

ছবি : বণিক বার্তা

নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে সরকার। আগামী পাঁচ বছরে দেশটি থেকে ৬৫০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। প্রতি বছর আনুমানিক ১৩০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনা হবে নেপালের কাছ থেকে। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এ বিদ্যুৎ কিনবে বিপিডিবি। গত মাসের বিপিডিবির বোর্ড সভায় বিদ্যুতের দরসংক্রান্ত প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়। বিদ্যুৎ ক্রয়ের এ প্রস্তাব সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগটি যখন গতি পেল ঠিক একই মুহূর্তে ভারত থেকে আনা বিদ্যুতের বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া পড়েছে। ত্রিপুরা স্টেট ইলেকট্রিসিটি করপোরেশন লিমিটেডের (টিএসইসিএল) এমডি দেবাশীষ সরকারের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো গত সপ্তাহে জানিয়েছে, বিল বকেয়া থাকায় টিএসইসিএল এরই মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ভারত সরকারের সঙ্গে জিটুজি চুক্তির আওতায় এ বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ বিভাগের এক চিঠি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত জিটুজি চুক্তির আওতায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বকেয়া ছিল ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা টাকার বেশি। আর ঝাড়খণ্ডে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কেনা বিদ্যুতের বিল বকেয়া পড়েছে ৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। 

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৬ দশমিক ৪০ ইউএস সেন্ট। আর সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের জন্য এনভিভিএন (এনটিপিসি বিদ্যুৎ ভ্যাপর নিগম) ট্রেডিং মার্জিন দশমিক শূন্য ৫৯৫ ভারতীয় রুপি (প্রতি কিলোওয়াট)। এর সঙ্গে সঞ্চালন চার্জ যুক্ত হবে। প্রতি কিলোওয়াট সঞ্চালন চার্জ কত হবে সেটি বিপিডিবির কাগজপত্রে উল্লেখ না থাকলেও ভারতীয় সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি অথরিটির হিসাব অনুযায়ী এ চার্জ যুক্ত হবে।

জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ভারতীয় সঞ্চালন চার্জ ও ট্রেডিং মার্জিন হিসাব করলে মোট কিলোওয়াটপ্রতি ৯ টাকার মতো পড়বে।’

এর আগে নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত ৩১ জানুয়ারি সচিবালয়ে বাংলাদেশে নেপালের রাষ্ট্রদূত ঘনশ্যাম ভাণ্ডারীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির অগ্রগতির কথা তুলে ধরেন তিনি। ওই সময় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নেপাল থেকে ভারত হয়ে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানির সব প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। আরো ৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টির অগ্রগতি দৃশ্যমান।’

নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানি করতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এ বিদ্যুৎ দেশে আসবে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সীমান্ত না থাকায় এক্ষেত্রে ভারতীয় সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করা হবে। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার এইচভিডিসি স্টেশন (সাবস্টেশন) ব্যবহার করে এ বিদ্যুৎ আসবে দেশে। এক্ষেত্রে ট্রেডিং মার্জিন ও সঞ্চালন চার্জ দিতে হবে প্রতিবেশী দেশটিকে।

নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করতে নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি (এনইএম) ভারতের এনভিভিএন ও বিপিডিবির মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে ক্রয় চুক্তি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ)-২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর)-২০০৮ অনুসরণ করে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির (ডিপিএম) প্রস্তাবটি এর আগে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে নীতিগত অনুমোদন পায়।

বাংলাদেশ ও নেপাল বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে প্রথম একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ওই সমঝোতার আওতায় দুই দেশের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ আমদানি বিষয়ে আলোচনা হয়। এমনকি নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশের বিনিয়োগের বিষয়টিও উঠে আসে। তবে এক দশক ধরে এসব আলোচনা চললেও তা ছিল মৌখিক।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি আরো আগেই শুরু হতো। এক্ষেত্রে আমরা ছয় মাস পিছিয়ে গেছি। এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। শিগগিরই দেশের গ্রিডে দেশটির বিদ্যুৎ যুক্ত হবে। এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় এ যাবত বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি হলেও এটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি। প্রথমবারের মতো নেপাল থেকে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হবে। ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকেও বিদ্যুৎ রফতারি দ্বার উন্মোচন হলো।’ 

দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বর্তমানে প্রতি কিলোওয়াট ১২-১৩ টাকা। জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুতের দাম কিলোওয়াটপ্রতি ১৮-২০ টাকার মতো। সেই তুলনায় নেপালের জলবিদ্যুৎ অনেকটাই সাশ্রয়ী। এতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কিছুটা হলেও কমবে এবং বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে জানায় বিপিডিবি।

বিপিডিবি নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে শীর্ষ এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে লাভবান হবে বাংলাদেশ। যেমন শীতের সময়ে যখন বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়, তখন নেপালে থাকে শুষ্ক মৌসুম। দেশটির তখন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। ওই সময় বাংলাদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ রয়েছে নেপালের।’ 

নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলে দেশে মোট আমদানি বিদ্যুতের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট, যা বাংলাদেশের গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ১১ শতাংশ।

বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে, যার পুরোটাই ভারত থেকে। এর মধ্যে দেশটির সঙ্গে সরকারি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি রয়েছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট আর বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আদানির ঝাড়খণ্ড বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসছে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন