কমছে জমি-কৃষক, যান্ত্রিকীকরণের গতিও মন্থর

দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে চালের উৎপাদন বাড়াতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। কৃষি দেশের অর্থনীতির প্রধান কর্মকাণ্ড এবং জীবনীশক্তি। কৃষিকে বাদ দিয়ে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কয়েক বছর ধরে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে খাদ্যশস্যটি আমদানি করতে হচ্ছে। আমাদের খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগণের চাহিদা পূরণে ধান উৎপাদনও বাড়াতে হবে। ধান ও চাল উৎপাদন বাড়াতে না পারলে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

এদিকে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ (২০১৫ সালের তুলনায়) করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এজন্য নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু জমি-কৃষক কমে যাওয়া ও যান্ত্রিকীকরণের শ্লথগতি এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় চ্যালেঞ্জ। যার কারণে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শস্যটির উৎপাদন বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। ধান ও চালের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কৃষি খাতে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, কৃষি উপকরণ ব্যয়ের সহজলভ্যতার পাশাপাশি কৃষিজমির বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে হবে। 

দেশে জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ার কারণে কৃষি খাতে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। এ খাতে নানা জটিলতা থাকায় নতুন জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে না। দ্রুতগতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও ধানের কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা অন্য ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন। ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতার কারণে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের গতিকে ধীর করছে। এ অস্থিরতার ও কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যয় বাড়ার কারণে যান্ত্রিকীকরণে উৎপাদন ব্যয় কমার কথা থাকলেও সে সুযোগ নিতে পারছেন না কৃষক। অনেকেই কৃষি ছেড়ে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। ফলে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমে আসছে বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। 

কৃষিতে তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে না। ফলে কমছে কৃষকের সংখ্যা। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন হয়েছে। তরুণ উদ্যোক্তারা রফতানির কথা মাথায় রেখে মাছ, আলু, ভুট্টা, গম ও টমেটো বা অন্য ফসল চাষ করছে। রবিশস্যের জমিতে তিল বা সরিষা চাষ হচ্ছে। তরুণদের বাণিজ্যিক কৃষিতে আগ্রহ বাড়ছে। প্রান্তিক কৃষক খোরপোষ বজায় রাখতে উৎপাদন অব্যাহত রাখবে। ফলে চাহিদা অনুপাতে ধান ও চালের উৎপাদন না বাড়ায় প্রতি বছরেই শস্যটি আমদানি করতে হচ্ছে। 

গত ২১ মার্চ ও ১৬ এপ্রিল দুই ধাপে দেশের ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ৭ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় বাংলাদেশ সরকার। চলতি বছরের ১৫ মে পর্যন্ত ছিল আমদানি ও বাজারে সরবরাহের শেষ সময়সীমা। তবে ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দুই ধাপে বেনাপোল বন্দর দিয়ে মাত্র ২৮০ টন চাল আমদানি করেছেন। 

যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় অনেকখানিই কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ব্যয় বাড়ায় কৃষি যন্ত্রপাতির দামও বেড়েছে। ডলারের বিনিময় হার আরো ব্যয়বহুল করে তুলেছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে। ফলে চাইলেও কৃষকের পক্ষে এসব যন্ত্র কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিভিন্ন কৃষি উপকরণ ব্যয় বাড়ার কারণে উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ধানের উৎপাদন ব্যয় কমাতে হলে সারা দেশে কৃষকদের ৮০ শতাংশ হারে ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন। এতে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত বাড়বে, কমবে উৎপাদন ব্যয়ও। কৃষি খাতে বাড়াবে তরুণদের আগ্রহ। উৎপাদনও বাড়বে বলে আশা করা যায়। 

এদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ২০৩০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এ লক্ষ্যে ২০২১ সালে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ‘‌ডাবলিং রাইস প্রডাক্টিভিটি’ (ডিআরপি) শীর্ষক একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার মাধ্যমে উৎপাদন ৪ কোটি ৬৯ লাখ টনে নেয়া সম্ভব বলে জানানো হয়। 

দেশে প্রতি বছর বিদ্যমান জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ২০ লাখ নতুন মুখ। এ বাড়তি জনসংখ্যার জন্য বছরে অতিরিক্ত তিন লাখ টন ধানের দরকার হবে। চালের উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষকদের ভর্তুকি ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।

এদিকে ক্রমেই জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং চাষের জন্য পানির জোগানও কমছে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি কৃষিকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এসব পরিস্থিতি মাথায় রেখে সরকারকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে। 

‘‌রাইস ভিশন ফর বাংলাদেশ: ২০৫০ অ্যান্ড বিয়ন্ড’-এ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে চাহিদার প্রায় ২০ লাখ টন ধান বাড়তি উৎপাদন হয়েছিল। তবে আগামী দশকগুলোয় এমন উদ্বৃত্ত বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ২০৫০ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা হবে ২১ কোটি ১৫ লাখ। তখন এ বাড়তি জনগোষ্ঠীকে খাওয়াতে চার কোটি টনের বেশি ধান দরকার হবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালে চার কোটি টনের বেশি ধানের প্রয়োজন হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ৩৬ লাখ টন ধানের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

দেশের চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে কৃষকের কৃষি উপকরণ ব্যয় কমাতে হবে। এ খাতে সরকারি প্রণোদনা ও ভর্তুকি বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষি জমির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন দক্ষ ও শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা। তাদের মাধ্যমে কৃষি একটি গতিশীল খাতে পরিণত হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা যায়। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন