![](https://bonikbarta.net/uploads/news_image/news_385339_1.jpg?t=1718640803)
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায়
বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্য
অনুযায়ী, রোববার (২৬ মে) রাতে নদীতে জোয়ারের তীব্র চাপে কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের
সিংহেরকোণা, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের
বেলাল গাজীর বাড়ির সামনের বাঁধ ভেঙে যায়।
কয়রার স্থানীয়রা জানান, বাঁধের দুর্বল অংশের ওই তিনটি স্থানে প্রায়
১৫০ মিটার এলাকা ভেঙে নদীর নোনা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া বাঁধের নিচু কয়েকটি জায়গা
ছাপিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। জোয়ারের প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়েছে জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধের
ওপর। এসব জায়গায় স্থানীয় মানুষ রাতভর মেরামত কাজ চালিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। রোববার
রাতজুড়ে ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ের তাণ্ডবে অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে শতাধিক
চিংড়ির ঘের; ভেঙে গেছে কয়েক’শ কাঁচা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট।
কয়রার মহারাজপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, রোববার
রাতের জোয়ারের চাপে ইউনিয়নের দশহালিয়া এলাকায় প্রায় ৫০ মিটার বাঁধ ভেঙে কপোতাক্ষ নদের
পানি ঢুকে পড়েছে। এতে অন্তত দুটি গ্রাম ও কয়েক’শ চিংড়ির ঘের তলিয়ে গেছে।
মহেশ্বরীপুরের ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বলেন, তার ইউনিয়ন
পরিষদের সিংহেরকোণা এলাকায় বাঁধ ভেঙে গেছে। এছাড়া নয়ানি এলাকার বাঁধের নিচু জায়গা ছাপিয়ে
সারা রাত পানি ঢুকেছে। এতে অন্তত সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া অসংখ্য চিংড়ির ঘের
ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ঝড়ের তাণ্ডব ও ভারী বৃষ্টিতে কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে শতাধিক মানুষ
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের মাটিয়াভাঙ্গা এলাকায় জোয়ারে বাঁধের কিছু
অংশ ভেঙে গেছে। এতে ৫-৭টি গ্রামে নদীর পানি ঢুকে পড়েছে বলে ইউপি চেয়ারম্যান আছের আলী
জানান। এছাড়াও ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় নিচু বাঁধ ছাপিয়ে এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে
বলে জানান তিনি।
ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)
এবিএম তারিক উজ জামান বলেন, কয়েকটি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খবর পেয়েছি।
এছাড়া ভারী বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডবে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জেনেছি।
তবে কোথাও কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি।
ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসন সবাইকে সঙ্গে
নিয়ে কাজ করছে জানিয়ে ইউএনও বলেন, ঝড়ে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে; তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গড়াইখালি
ইউনিয়নের খুতখালী গ্রামে শিবসা নদীর বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে
উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন উপজেলার
প্রায় এক লাখ মানুষ। সাগরের নোনাপানিতে প্লাবিত হয়েছে অর্ধশতাধিক গ্রাম।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহেরা নাজনীন বলেন,
রোববার মধ্যরাত থেকে সোমবার (২৭ মে) সকাল পর্যন্ত ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড়
রেমাল। কমপক্ষে ছয়টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। তবে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। ক্ষয়ক্ষতি
নিরূপণের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।
দাকোপ উপজেলার শিবসা ও ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া
গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা তলিয়ে গেছে। তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের
সদস্য ক্ষিতীশ গোলদার বলেন, একই এলাকায় পাঁচটি পয়েন্ট ভেঙে পানি ঢুকছে। কামিনীবাসিয়া
গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় পুরোটা লোনা পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে। তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের
বটবুনিয়া এলাকার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বলে ক্ষিতীশ জানান।
দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগী ফকিরকোনা, ঝুলন্তপাড়া এবং
পণ্ডিতচন্দ্র স্কুল সংলগ্ন এলাকাও সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছে। এ অবস্থায় চরম উৎকণ্ঠার
মধ্যে রয়েছেন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা।
দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়দেব চক্রবর্তী বলেন, উপজেলার
কয়েকটি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কার ও
ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ আশরাফুল আলম বলেন, টানা
বৃষ্টি ও নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বেড়ে যাওয়ায় কয়েকটি স্থানে বাঁধ সামান্য
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত পাওয়ার পর থেকে স্থানীয় মানুষ ও ঠিকাদারি
প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে উপকূলীয় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করা হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়
রেমাল এখনো খুলনা অঞ্চল ছেড়ে যায়নি। এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সোমবার সারাদিন দমকা বাতাসসহ
বৃষ্টি চলবে। আগামীকাল মঙ্গলবার (২৮ মে) পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
আজাদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে রোববার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল
নয়টা পর্যন্ত খুলনা নগরে ৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসী বলছেন, বাঁধ মেরামতের টাকা সঠিকভাবে কাজে লাগানো
হলে এভাবে বারবার বাঁধ ভাঙত না। নিম্নমানের কাজ, নকশায় ত্রুটি ও সীমাহীন দুর্নীতির
কারণে বেড়িবাঁধ টেকসই হয় না।
‘ক্লাইমেট মুভমেন্ট বাংলাদেশ’র সমন্বয়ক শুভ্র শচীন বলেন, পরিকল্পিত
ও স্থায়ী বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতিবছর ভাঙন দেখা দেয়। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের
কর্মকর্তাদের গাফিলতিই দায়ী। যখন জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে পড়ার উপক্রম হয়, তখন স্বেচ্ছাশ্রমে
বাঁধ মেরামতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এলাকাবাসী। এ সময় বাঁধ মেরামতে উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে
ঠিকাদার-পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের লাভ হলেও একদিকে কাজের ব্যয় বাড়ে, অন্যদিকে
মূল ঠিকাদার থেকে একাধিকবার হাত বদল হয়ে কাজ হয় নিম্নমানের।
শুভ্র শচীন বলেন, উপকূলে চিংড়ি চাষের কারণে যথেচ্ছভাবে বেড়িবাঁধ কাটাছেঁড়া
করা হয়। চিংড়ি চাষিরা বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে কৃষিজমিতে নোনাপানি তোলেন। এতে বাঁধ মারাত্মকভাবে
দুর্বল হয়ে পড়ছে। যে কারণে বাঁধ টিকছে না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২
আশরাফুল আলম বলেন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও কম খরচে প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় বেড়িবাঁধ
টিকছে না।