নটবরলাল : ‘দ্য কন ম্যান অব ইন্ডিয়া’

বণিক বার্তা ডেস্ক

মধ্য ও বৃদ্ধ বয়সের নটবরলাল (মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব)। ছবি : সংগৃহীত

গত শতকের বিশ কি ত্রিশের দশকের কথা বিহারের সিওয়ান জেলার বাংরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন সহায় নামের এক ব্যক্তি প্রতিবেশী স্টেশন মাস্টারের ছেলে মিথিলেশের ওপর ছিল তার অগাধ ভরসা প্রায়ই তাকে অর্থ জমা রাখতে বা তুলতে পাঠাতেন ব্যাংকে কিন্তু তখনো ভাবতে পারেননি সই জালে পারদর্শী মিথিলেশ এরই মধ্যে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বেশকিছু টাকা সরিয়ে ফেলেছে সহায় যখন টের পেলেন, মিথিলেশ তখন কলকাতাগামী ট্রেনে পকেটে তার ওই সময়ের মূল্যমানে হাজার রুপি প্রতারণার দুনিয়ায় বড় প্রতারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জালিয়াতনটবরলাল

নটবরলাল ওরফে মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তবের জন্ম ১৯১২ সালে কিশোর বয়সে প্রতিবেশীর সই জাল করে চেক ভাঙানো দিয়ে শুরু এরপর একে একে সই জাল করেছেন বহু বিখ্যাত-অখ্যাত মানুষের তালিকা থেকে বাদ যায়নি ধিরুভাই আম্বানি বা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সইও তিনবার বিক্রি করেছেন তাজমহল দিল্লির লাল কিল্লা বিক্রি করেছেন দুইবার। বেচে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ভবন পার্লামেন্ট ভবনও পরিচিতি পেয়েছেন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জালিয়াত হিসেবে নয়বার জেল ভেঙে পালিয়েছেন আট রাজ্যে ১০০টি মামলার আসামি তিনি বিভিন্ন মামলায় তার জেল হয়েছিল ১১৩ বছরের যদিও সাজা ভোগ করেছেন মোটে ২০ বছর এমনকি নিজের মৃত্যু নিয়েও তৈরি করে রেখে গেছেন ধোঁয়াশা ভারতজুড়ে এখনোনটবরলালনামটিকে দেখা হয় অসম্ভব ধরনের জালিয়াতি বা অবাস্তব কোনো ঠাট্টার সমার্থক হিসেবে আর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাকে চেনেদ্য কন ম্যান অব ইন্ডিয়াহিসেবে তার জীবন কাহিনীর অনুপ্রেরণায় বলিউডে সিনেমাও বানানো হয়েছে বেশ কয়েকটি।

মিথিলেশ কুমার বেশ বুঝতে পেরেছিলেন, বড় জালিয়াত হতে হলেও পেটে অন্তত দুকলম বিদ্যা থাকা প্রয়োজন এজন্য কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার পর বি. কমে (কোনো কোনো সূত্রে প্রকাশিত তথ্যে আইন বিষয়ের কথাও বলা আছে) ভর্তি হলেন আর শেয়ারবাজারে যোগ দিলেন পার্ট টাইম ডিলার হিসেবে ভালোমতো বুঝে নিলেন ব্যাংক ব্যবস্থার নিয়ম-কানুন আর ফাঁকফোকর কাপড়ের ব্যবসাও করেছেন টুকটাক তবে তাতে মন ছিল না মিথিলেশের

জালিয়াত হিসেবে তিনি প্রথমবারের মতো কলকাতা পুলিশের নজরে পড়েন ২৫ বছর বয়সে, ১৯৩৭ সালে বউবাজারের মেটকালফে স্ট্রিটের ওপর কিছু লোহার স্তূ দেখে সন্দেহ হয় পুলিশের খুঁজতে খুঁজতে জনৈক বিহারি মিথিলেশ কুমারের সন্ধান পায় তারা জাল কাগজপত্র দেখিয়ে মিথিলেশ দাবি করলেন, নয় টন লোহার প্রকৃত মালিক তিনি, যা এরই মধ্যে এক দালালের কাছে বিক্রিও করেছেন প্রকৃতপক্ষে এগুলোর মালিক ছিল রেলওয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ছয় মাস জেলও খাটেন

জেল থেকে বেরিয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মিথিলেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন স্থানে রূপোপজীবিনীদের নেশাগ্রস্ত করে বা বিষ প্রয়োগ করে তাদের টাকা-পয়সা, গয়না নিয়ে পালিয়ে যেতেন তিনি কিন্তু এমনই এক লুটপাটের শিকার তাকে চিনতে পারায় ধরা পড়ে যান কিন্তু রহস্যজনকভাবে ওই নারী বিচার শুরুর এক সপ্তাহ আগে আত্মহত্যা করে বসেন বেঁচে যা মিথিলেশ কুমার

মানুষকে নেশাগ্রস্ত বা বিষ প্রয়োগ করার বিপদ আঁচ করতে পেরেনিরীহজালিয়াতির কাজে ফিরে যান তিনি পিতা স্টেশন মাস্টার হওয়ায় ভারতের রেল শিল্প নিয়ে ভালোই জ্ঞান ছিল তার বিশেষ করে বিপুলায়তনের পণ্য পরিবহন কার্যক্রমের খুঁতগুলো ধরতে পেরেছিলেন তিনি রেলের ফ্রেইট অফিসে গিয়ে ছাড়করণের অপেক্ষায় থাকা পণ্যের খোঁজখবর নিতেন এরপর জাল রিলিজ অর্ডার চেক দিয়ে সেসব মালপত্র ছাড়িয়েও নিতেন

চল্লিশের দশকে উপমহাদেশজুড়ে টেক্সটাইল পণ্যের কাঁচামালের সংকট দেখা দেয় নটবরলাল নামের এক গুজরাটি সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে বড় দাঁওয়ের খোঁজে নেমে পড়েন মিথিলেশও বম্বের টেক্সটাইল কমিশনারের অধীন পারচেজ অফিসার সেজে টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী ডিলারদের সঙ্গে দেখা করতেন বরাদ্দের অতিরিক্ত তুলা কেনার সুযোগ করে দেয়ার প্রস্তাব দিতেন তবে তার জন্য দাম চাইতেন বেশি এবং শর্ত অনুযায়ী তা আগাম পরিশোধ করতে হতো এরপর রেলের জাল রিলিজ সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়ে তাদের বলা হতো রেলস্টেশন থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে যদিও সেখানে গিয়ে দেখা যেত, আদতে এমন কোনো তুলার চালান আসেনি এরপর তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে ধরে ফেলে যদিও সে সময় ভুলবশত পুলিশ তাকে তার সহযোগী নটবরলাল বলে মনে করেছিল ওই ভুলের সুবাদেই মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব পরে ভারতজুড়ে পরিচিতি পান নটবরলালহিসেবে

এরপর কিছুদিনের জন্য রেলওয়েকেই জালিয়াতির হাতিয়ার বানিয়ে রেখেছিলেন নটবরলাল পঞ্চাশের দশকে বিহারের দ্বারভাঙ্গা, পাটনা ইত্যাদি জেলা থেকে কলকাতায় ভুয়া চালান পাঠানোর কথা বলে ব্যাংক থেকে বেশকিছু টাকা হাতিয়ে নেন তিনি

এর মধ্যেই বিহারের এক গ্রামে পরিদর্শনে আসেন ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলেন নটবরলাল রাজেন্দ্র প্রসাদকে অবাক করে তার সই হুবহু নকল করে দেখালেন বেশ জোর দিয়েই বললেন, ‘হুকুম দিন তো ভারতের পুরো ঋণ পরিশোধ করে দি? একবার বলেই দেখুন না, উল্টো বিদেশীরা ভারতের কাছে ঋণী হয়ে পড়বে

তবে . রাজেন্দ্র প্রসাদ সে ঝুঁকি আর নেননি আর নটবরলালও রাজেন্দ্র প্রসাদের সই শুধু প্রেসিডেন্টকে দেখিয়ে বাহবা নেয়ার জন্য নকল করেনি

আগ্রায় হানিমুন করতে এসেছিল এক ধনী মার্কিন দম্পতি তাজমহলের সৌন্দর্য আর এর পেছনের গল্পে বিমোহিত তারা অর্থগৌরবে গৌরবান্বিত স্বামী ভাবছিলেন তাজমহল কিনে নেয়া সম্ভব কিনা ত্রাতা হয়ে এগিয়ে এলেন ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তানটবরলাল রাজেন্দ্র প্রসাদসহ সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তার সই জাল করে তাদের কাছে বিক্রি করে দিলেন তাজমহল

এভাবে একবার নয়, বিদেশী ট্যুরিস্টদের কাছে তিনবার তাজমহলের মালিকানা বেচে দিয়েছেন নটবরলাল লাল কিল্লা বিক্রি করেছেন দুবার এমনকি ৫৪৩ পার্লামেন্টারি আসনের জনপ্রতিনিধিসহ গোটা ভারতীয় পার্লামেন্টটাকেই একবার বিক্রি করে দিয়েছেন বাদ যায়নি দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনও রাজেন্দ্র প্রসাদ ছাড়াও টাটা-বিড়লা-ধিরুভাই আম্বানিদের সই নকল করেও জালিয়াতি করেছেন নটবরলাল

এসব জাল-জালিয়াতির ঘটনায় নটবরলাল যে পার পেয়ে গেছেন তা- নয় দ্বারভাঙ্গা জেলা আদালত একবার তাকে জালিয়াতির মামলায় ১৭ বছরের জেল লাখ রুপি জরিমানা করে সিংভূম জেলার আদালতে তার সাজা হয় ১৯ বছরের পাটনার আদালতে সাজা হয় যাবজ্জীবন এক পর্যায়ে দেখা যায় শুধু বিহার রাজ্যেই ১৪ মামলায় তার মোট সাজা শতবছরের কাছাকাছি পৌঁছে যায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের আদালতে তার মোট সাজা হয়েছে ১১৩ বছরের

যদিও বিভিন্ন দফায় গ্রেফতার হওয়ার পর নটবরলালকে সব মিলিয়ে ২০ বছরের বেশি সাজা খাটতে হয়নি প্রত্যেকবারই তিনি জেল থেকে পালিয়েছেন অভিনব উপায়ে 

এর মধ্যে ১৯৫৭ সালে কানপুরের একটি জেল থেকে তার পালানোর গল্পটি বেশ কুখ্যাতি পেয়েছে এমনকি গল্প পরে বিভিন্ন সিনেমায়ও ব্যবহার হয়েছে প্রথমে এক সহযোগীর মাধ্যমে জেলের ভেতরে পুলিশের এক সাব-ন্সপেক্টরের পোশাক আনিয়ে রাখেন বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে সেলের রক্ষীদের কাছ থেকে জেল থেকে পালানোয় সহায়তার প্রতিশ্রুতি নেন তিনি এরপর নির্দিষ্ট দিনে এক অ্যাটাচি কেসভর্তি অর্থ সেলরক্ষীদের হাতে তুলে দেন সেল থেকে বেরিয়ে আসেন পুলিশের পোশাক পরে পুলিশ কর্মকর্তা ভেবে জেলগেটের রক্ষীরা রীতিমতো স্যালুট দিয়ে দরজা খুলে দে তাকে এরপর এক গাড়িতে চড়ে হাওয়া হয়ে যান নটবরলাল ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন নটবরলালের সেলের রক্ষীরা চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় তাদের আর নটবরলালের কাছ থেকে রুপিতে ভর্তি ভেবে যে অ্যাটাচি কেস নিয়েছিলেন তারা, সেটি খুলে খবরের কাগজ ছাড়া আর কিছু মেলেনি তাদের

১৯৭৭ সালে আরেকবার আটক হওয়ার পর তাকে ইন্দোর জেলে নিয়ে যাওয়া হয় ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইন্দোর সেশন কোর্টের বিচারক ১৯৫৬ সালের এক ব্যাংক জালিয়াতির মামলায় তাকে ২৬ বছরের কারাদণ্ড দেন এরপর তাকে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) পাঠানো হয় সেখানে তার বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র পুলিশের দায়ের করা মামলার সংখ্যা ছিল ৩০

মহারাষ্ট্র পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে কিডনিতে অসুস্থতার ভান করেন নটবরলাল এক কনস্টেবলকে সঙ্গে দিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয় পথে কিছু টাকা পাওয়ার কথা বলে কনস্টেবলকে ধোঁকা দিয়ে এক পাঁচতারকা হোটেলে নিয়ে যান তিনি এরপর সেখান থেকেও উধাও হয়ে যান

নটবরলাল পুলিশের হাতে সর্বশেষ ধরা পড়েন ১৯৯৬ সালে, ৮৪ বছর বয়সে সে সময় তাকে কানপুর জেল থেকে নয়াদিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া কিন্তু এবারো বার্ধক্য জর্জরিত শরীর নিয়েই পালালেন তিনি

ভারতীয় পুলিশের জানামতে, তাকে সর্বশেষ দেখা গেছে নয়াদিল্লি রেলস্টেশনে ১৯৯৬ সালের ২৪ জুন এরপর আর কেউ কখনো তার সন্ধান পায়নি কিছুদিন পরই তার ভাই দাবি করলেন, নটবরলাল আর বেঁচে নেই রাঁচিতে ১৯৯৬ সালেই তাকে দাহ করা হয়েছে যদিও দাবির সত্যতা নিয়ে সে সময় বেশ সন্দেহ তৈরি হয়

নটবরলালের মৃত্যু নিয়ে বিভ্রান্তি বড় আকার ধার করে ২০০৯ সালে সে সময় আদালতে তার বিরুদ্ধে ঝুলে থাকা শতাধিক অভিযোগ তুলে নেয়ার আবেদন করেন তার উকিল আবেদনে বলা হয়, নটবরলাল মৃত তাই তার বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা চালু রাখা অনর্থক আর আবেদনে মৃত্যুর তারিখ বলা হয় ২৫ জুলাই, ২০০৯ সাল

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়া টুডে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন