পড়ুয়াদের নতুন প্লাটফর্ম চট্টগ্রাম বই বিনিময় উৎসব

ফিচার ডেস্ক

ছবি: ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ

৩ মে, ২০২৪। শুক্রবার। সকাল ৯টা থেকে চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান মোড়ে রাস্তার দু’ধারের ফুটপাতে দেখা গেল অনেক মানুষের জটলা। সবাই ছুটছেন। কাছে গিয়ে দেখা গেল অনেকগুলো বইয়ের স্টল। সবাই বেছে বেছে বই নিচ্ছেন, অনেকেই আবার বই এনে জমা দিচ্ছেন। বলছি ‘পঞ্চম চট্টগ্রাম বই বিনিময় উৎসবের’ কথা। স্টোরিটেলিং প্ল্যাটফর্ম ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ এর উদ্যোগে ‘বই নয়, জ্ঞানের বিনিময়’ শ্লোগানে দিনব্যাপী চলে এ বিনিময় উৎসব; যেখানে একদিনেই প্রায় ২৫ হাজার বইয়ের বিনিময় হয়। কথাসাহিত্য, কবিতা, প্রবন্ধ, ক্যারিয়ার, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, জাফর ইকবাল-হুমায়ুন আহমেদ, একাডেমিকসহ ১১টি ক্যাটেগরিতে দিনব্যাপী এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের নানাবয়সী পাঠকের ভিড় জমে জামাল খানে, জায়গাটা পরিণত হয় বইপ্রেমীদের মিলনমেলায়।

বই বিনিময় উৎসব কী?

সাধারণত আমরা বই কিনি টাকা দিয়ে। কিংবা উপহার পাই। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি যদি বই দিয়ে বই কেনা যায় কেমন হয়? ঠিক এই আইডিয়াটাকেই সামনে নিয়ে এসেছে ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ। বই বিনিময় উৎসবে মূলত পাঠক তার পঠিত কিংবা অপ্রয়োজনীয় বই নিয়ে আসেন এবং বইগুলো বিনিময় করে নিয়ে যান অন্য কোনো বই। এই যে বইয়ের বিনিময়ে বই নেয়া এটায় অনেক মানুষের সম্মিলন ঘটে বলে উৎসবের একটা আবহ পাওয়া যায়। সবকিছু মিলিয়েই এটি হয়ে উঠে বই বিনিময় উৎসব।

খুলনায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে 'বুক ব্যাংক' প্রথম এ ধরনের আয়োজন করে। তারপর দেশের নানা জায়গায় বিভিন্ন সংগঠন 'বই বিনিময় উৎসব' এর আয়োজন করলেও কেউই অব্যাহত রাখতে পারেননি সে অর্থে। তবে 'ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ' টানা পাঁচবার বই বিনিময় উৎসব আয়োজন করেছে।

চট্টগ্রামে কীভাবে শুরু হলো এই বই বিনিময় উৎসবটি?

সালটা ২০২১। করোনার ভয়াল ত্রাসে কাঁপছে গোটা পৃথিবী। অমর একুশে বইমেলা পড়েছে মুখ থুবড়ে। লকডাউন শেষে সীমিত পরিসরে চলাফেরা করছিল মানুষ। সেসময়ে চট্টগ্রামের ফিল্ম এক্টিভিস্ট ও বইপ্রেমী সাইদ খান সাগর ভাবলেন চট্টগ্রামের বইপড়ুয়াদের কিভাবে বইপড়াটা অব্যাহত রাখা যায়। তারপর তার দুই বন্ধু মাহির আজরফ ও অংকন দে অনিমেষসহ একত্রে সিদ্ধান্ত নিলেন তাদেরই স্টোরিটেলিং প্ল্যাটফর্ম ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ থেকে এমন এক অভিনব উপায়ে বইয়ের বিনিময় করতে যেখানে কাউকে বই নিতে টাকা দিতে হবে না, কেবলই বিনিময়ে অন্য কোনো বই দিতে হবে। যেহেতু সীমিত পরিসরে লোকসমাগমের অনুমতি রয়েছে সেহেতু কিভাবে বেশি পাঠকের সমাগম ঘটান যায় সে চিন্তা থেকে বই বিনিময় উৎসব আয়োজনের চিন্তা করেন তারা।

ক'দিন আগেই তারা অনলাইনে আয়োজন করেছিলেন ইন্টারন্যাশনাল লকডাউন শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যাল যা সাড়া ফেলেছিল। তাই আত্মবিশ্বাস তো ছিলই। সে বিশ্বাস থেকেই কাজ শুরু করলেন। সাগর, মাহির আর অংকনদের ৮০টি বই ছিল। তারা তাদের পরিচিতজনদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করতে লাগলেন। সব মিলিয়ে ৬০০টি বই হয়। এই ৬০০ বই দিয়েই ২০২১ সালের ১১ মার্চ প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের জামালখানে বই বিনিময় উৎসবের আয়োজন করেন তারা। "লকডাউনের লম্বা সময় ঘরবন্দি থাকতে থাকতে এমন একটা পাঠক সমাগমের জন্য কত যে ব্যাকুল হয়ে ছিলেন তারা বুঝতে পেরেছিলেন সেদিনের ভিড় দেখে। বিকেল হতে হতে জামালখান হয়ে উঠে লোকারণ্য। তারা অন্তত ৫ হাজার বই বিনিময় করার লক্ষ্য নিয়েছিলেন, কিন্তু সংখ্যাটা ৯ হাজার পার হয়ে যায়। এসব তথ্য দিলেন চট্টগ্রাম বই বিনিময় উৎসবের সমন্বয়ক সাইদ খান সাগর।

যেভাবে বড় হয়ে উঠেছে এই উৎসব

প্রথম বই বিনিময় উৎসব আয়োজনের পর থেকে ফেসবুক, মেইল, কখনোবা বই পড়ুয়াদের কমিউনিটিগুলো থেকে অসংখ্য অনুরোধ পেয়ে আসছিল ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ। আমরা বুঝতে পারলাম কিছু পাঠক এতে উপকৃত হচ্ছেনই বটে। তখন ঠিক করলাম প্রতিবছর আয়োজন করে যাব এই উৎসবের, বলছিলেন সাইদ খান সাগর।

২০২২ সালের ১১ মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজন করা হয় বই বিনিময় উৎসবের। সেবার ২০ হাজার ১০৫টি বই বিনিময় হয়। এ বিপুল সাড়া দেখে এগিয়ে আসে প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়াও। তাদের সহযোগিতায়, বই পাঠকদের অংশগ্রহণে বই বিনিময় উৎসব আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠে, বাড়তে থাকে এর আবেদন। তাই একই বছর ৯ ডিসেম্বর আয়োজন করা হয় শীতকালীন বই বিনিময় উৎসবের।

উৎসবের সহ-সমন্বয়ক সায়মা সুলতানা জানান, আমরা ছোটবেলায় বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে বই পড়তাম। আবার আমাদের বইও তাদের দিতাম। এভাবে বই বিনিময় তো চলতেই থাকত। সেই শৈশবের রেওয়াজটাকেই সামনে নিয়ে আসি শীতকালীন বই বিনিময় উৎসবের মাধ্যমে। সেই বই বিনিময় উৎসবে আয়োজকরা সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষার্থীর বাইরেও সব বয়সীদের কাছে এই বই বিনিময় উৎসবকে পৌঁছে দিবেন তারা। ৩০ হাজারের অধিক বই বিনিময় হয় সেবার। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট আয়োজন করা হয় চতুর্থ বই বিনিময় উৎসবের। সেবার উৎসবের দিন বৃষ্টি হানা দিলেও জলাবদ্ধতার মাঝেও মানুষ আসতে থাকে উৎসবস্থলে। দিনশেষে প্রায় ১৪ হাজার বই বিনিময় হয়।

পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করায় এবং নিয়মিত বিরতিতে আয়োজন করতে পারা দেখে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ। দ্বিতীয় বই বিনিময় উৎসব থেকে শুরু করে এখনো অবধি এই বই বিনিময় উৎসবকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন তারা। সেই সঙ্গে এগিয়ে আসেন চট্টগ্রামের বরেণ্য ব্যক্তিত্বরাও। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেক, সাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, খ্যাতিমান অভিনেতা নাসির উদ্দিন খান, ইমতিয়াজ বর্ষণ, বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল প্রমুখ সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন বই বিনিময় উৎসব। তারই ফলশ্রুতিতে অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের মিশেলে এ বই বিনিময় উৎসব সার্বজনীন হয়ে উঠেছে বলেই অভিমত আয়োজক সদস্য রিনভী নুসরাত প্রাপ্তির।

যারা নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন

চট্টগ্রামের বই বিনিময় উৎসবের দলপতি সাগর হলেও তাদের রয়েছে প্রবল সক্রিয় একটি সংগঠক প্যানেল। রিনভী নুসরাত প্রাপ্তি, সায়মা সুলতানা, ঋত্বিক বড়ুয়া, আদিল রায়হান, সুদীপ্ত চৌধুরী, আকিবুল ইসলাম জিশাদ, সাইফুল্লাহ নাদিম, কাজী সদরুল্লাহ, সাদমান ফাহিমসহ প্রায় ১৫ জনের সংগঠক প্যানেল নিয়ে ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ আয়োজন করে আসছে এই বই বিনিময় উৎসবের। সাগর শেষ করেছেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা। এদের মধ্যে আদিল ও সুদীপ্ত চুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রাপ্তি ও সায়মা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবপ্রযুক্তি, ঋত্বিক ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে এবং বাকিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় আছে। সৌভাগ্যবশত মেধাবীদের একটা টিম পেয়েছি, প্রত্যেকেই একেকজন দক্ষ সংগঠক হওয়ায় পরিকল্পনা নেয়া ও বাস্তবায়ন সহজ হয়, বলেন ঋত্বিক বড়ুয়া। এছাড়া ৫টি বই বিনিময় উৎসব মিলিয়ে চার শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজের। এতবড় কমিউনিটি থাকায় প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রেও সুবিধা পান বলে জানান তারা।

ছবি: ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ

এই বই বিনিময় উৎসব আলাদা হওয়ার কারণ

সাগর বলেন, বই বিনিময় উৎসবকে শুরু থেকে আমরা একটা প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছি। তা না হলে আমাদের এই বই বিনিময় উৎসব পঞ্চমবারের মতো আয়োজন করা যেতো না। আয়োজক দলে নানাবয়সী সদস্য রাখায় যে কারোরই অনুপস্থিতি বিশেষ সমস্যা তৈরি করে না। ভলান্টিয়ার সংগ্রহ করার পর তাদের নিয়ে কর্মশালা করা হয় বেশ কয়েকবার। ফলে আমাদের গোটা প্রক্রিয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে থাকতে পারেন তারা। তারপর আমরা শুরু করি বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ক্যাম্পেইন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা। পঞ্চম বই বিনিময় উৎসবে চট্টগ্রামের প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা প্রচারণা চালিয়েছি।

কেবল বই বিনিময় উৎসবের আমন্ত্রণ নয়, সেই সাথে এই প্রচারণার সুযোগে তারা তাদেরকে বই পড়ার আমন্ত্রণও জানাতে পারে। এভাবেই একটা বড় অডিয়েন্স তৈরি হয়ে যায়। প্রচারণার সঙ্গে সঙ্গে আবার চলে বই সংগ্রহেরও ক্যাম্পেইন। এভাবে তারা অনেক মানুষের ঘরে পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় বই নিজেদের পাঠাগারে নিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে বিশেষভাবে আনা হয় একাডেমিক বইসমূহও। 'গাইড-টেস্টপেপার-একাডেমিক বই' নিত্যপ্রয়োজনীয় বইই, এবং অনেকের জন্যই কিছুদিন পরপর নতুন একাডেমিক বই কেনা কষ্টের। তাই শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ অপেক্ষায় থাকেন আমাদের একাডেমিক বই বিনিময় করতে। জানান ঋত্বিক বড়ুয়া। তারপর আসে সেই প্রতীক্ষার বই বিনিময় উৎসবের দিন। তারা স্টলে বই সাজিয়ে রাখেন, সাজানো বইগুলোকে আবার তিনটি সেশনের জন্য ভাগ করা হয়। প্রত্যেক সেশনে আলাদা আলাদা করে ভালো বই রাখা হয় যেন পাঠককে এসে হতাশ না হতে হয়।"মূলত একজন পাঠক যখন বইবিনিময় করতে আসেন তার তো প্রত্যাশাই থাকে তিনি যে বইটি দিচ্ছেন তার চেয়ে ভালো কোনো বই পাবেন। আমরা তাই চেষ্টা করে সকাল-দুপুর-বিকাল তিন সেশনেই পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য বই রাখতে।" এই বই বিনিময় উৎসবকে পাঠক এত আপন করে নিতে পারার প্রধান কারণ এটাই বলে মনে করেন সাগর। ক্যাটেগরি করে রাখাটাও আরেকটা আলাদা ব্যাপার দাবি তার। তিনি বলেন, বই বিনিময় উৎসব যখন শুরু হয় তখন কেউই ক্যাটেগরির ব্যাপারটা মাথায় রাখত না। ফলে দেখা যেত কেউ ম্যাগাজিন নিয়ে এসে রচনাসমগ্র নিয়ে চলে যাচ্ছেন, অন্যদিকে যিনি রচনাসমগ্র নিয়ে এসেছেন তাকে হতে হচ্ছিলো হতাশ। আমরা ২০২১ সাল থেকেই তাই সবার আগে ক্যাটেগরি করাতে মনোযোগ দিই। যিনি যে ক্যাটেগরির বই আনবেন তিনি সেই ক্যাটেগরির বইই বিনিময় করে নিয়ে যেতে পারবেন। এর ফলে একটা ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। বর্তমানে তাদের এই কাজের ধরনটা অনুসরণ করছে অন্যান্য বই বিনিময় উৎসবও এবং এতে পাঠকদের আস্থার জায়গায়ও যেতে পারছেন তারা বলে মনে করেন আয়োজকেরা। এছাড়াও, রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া; টোকেন প্রণয়ন প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে বই বিনিময়কে সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্য করা গেছে বলে জানান তারা।

সব বয়সের পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়া

ফজলুল করীম একজন মধ্যবয়সী পাঠক। তিনি তার পরিবারের পাঁচজন সদস্য নিয়ে এসেছেন বই বিনিময় করার জন্য। তারা পাঁচজন মিলে ২৫টি বই বিনিময় করেছেন। সব বয়সী মানুষের পড়ার মতো বই আয়োজকদের সংগ্রহে আছে বলেই এমনটা পারছেন তারা জানান। বৃষ্টি দাশ নগরীর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তিনি এসেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাসমগ্র দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস সমগ্র নিতে। ক্যাটেগরি অনুযায়ী স্টল বসানো থাকায় এত ভিড়ের মাঝেও নিজের পছন্দের বইটি খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি জানান তিনি। আবার অনার্স পড়ুয়া জাহিদ হোসাইন পেয়েছেন তার প্রয়োজনীয় একাডেমিক বই। চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রান্ত আর সিয়ামকে দেখা গেল কে বেশি বই বিনিময় করেছে তা নিয়ে বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে। সব বয়সী পাঠকদের এই ভিড়, তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়াটা কীভাবে সম্ভব হলো এত স্বল্প সময়ে জানতে চাওয়া হলে প্রাপ্তি বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো অনলাইন-অফলাইন দু'ভাবেই সহজ ছিল। আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিলো পেশাজীবী কিংবা শিশুদের কাছে পৌঁছানো। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম আর শিল্প-সাহিত্য সমঝদার ব্যক্তিদের একটি ভূমিকা আছে জানান তারা। বস্তুত তারা ১৫ জন এই উৎসবের নেতৃত্ব দিলেও কিংবা ৪০০ স্বেচ্ছাসেবক যার যার জায়গায় থেকে কাজ করে গেলেও পরোক্ষভাবে এই উৎসব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন অসংখ্য বই অনুরাগী মানুষ, যাদের অংশগ্রহণ আলোর পাদপ্রদীপে আসে না বলে মনে করেন তারা।

ছবি: ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ

বই বিনিময় উৎসব নিয়ে আয়োজকদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি

দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি থানার নাম দোহাজারী। সেখান থেকে বাস ভাড়া করে ৪০ জন বইপ্রেমী এসেছেন বই বিনিময় করতে। গ্রামাঞ্চলে থাকায় এমনিতেই বই কেনার সুযোগ কম থাকে। তার ভেতর এমন এক সুযোগ পেয়ে নিজের অযত্নে থাকা সব বইই বিনিময় করে নতুন বই নিতে পেরে আনন্দের সীমা নেই তাদের। ফেনী থেকে এসেছেন মোহাম্মদ ইকবাল। এ ধরনের আয়োজন তাদের শহরে হলে এত লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হতো না জানান তিনি।

করোনার ভেতরেও মানুষের ঢল দেখে ২০২১ সালেই 'ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ' বুঝতে পেরেছিলো ধারাবাহিকতা রাখতে পারলে এই উৎসব একদিন গণমানুষের উৎসব হয়ে উঠবে। সেই প্রত্যাশাটুকু পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করে ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় আমাদের অনেক বড় আকারে সারাদেশে করার ইচ্ছে থাকলেও নানা কারণে তা হয়ে উঠেনি৷ তাই আমরা চাইতাম আমাদের এই আইডিয়াগুলো যেন বেশি করে ছড়িয়ে দিতে পারি এবং অন্যান্য সংগঠন নিজ নিজ জায়গা থেকে এ কাজটি করতে এগিয়ে আসে। সময়ের ধারাবাহিকতায় আমরা দেশের নানা জায়গায় এ ধরনের আয়োজন দেখতে পাচ্ছি। তারা হয়তো ধারাবাহিক না, কিন্তু কিছু না৷ থাকার চেয়ে এটুকু তো অনেক বেশিই, বলছিলেন সাগর। আগামী বছর থেকে সারাদেশে একযোগে আয়োজনের আশা রাখেন তিনি। এবং 'চট্টগ্রাম বই বিনিময় উৎসব' এর সবচেয় বড় প্রাপ্তি এটা গণমানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

বিশিষ্টজনদের অভিব্যক্তি

বই নিয়ে রিভিউ লিখা এবং অনলাইন বই বিক্রির জন্য জনপ্রিয় 'পিয়ন'-এর কর্নধার আসাদুজ্জামান জয়। তিনি জামালখানে এই বই বিনিময় উৎসব ঘুরে জানান এখন অবধি বাংলাদেশে যত বই বিনিময় উৎসব দেখেছেন তার দেখা এখানকার উৎসবটিই সবচেয়ে গোছালো লেগেছে। লেখক মোহাম্মদ জাহিদ হোসাইনও বলেন তিনি দেশের নানা বই বিনিময় উৎসবে গেলেও বই বিনিময় করেন কেবলই 'চট্টগ্রাম বই বিনিময় উৎসবে'। কারণ তাদের বইয়ের কালেকশন অনন্য। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক জানান, বইয়ের বিনিময়ে বই মিলছে এমন সুন্দর ধারণা যারা করতে পারে তাদের নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অনেক দূর। বিকেলে উৎসব পরিদর্শন করতে এসে একুশের পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস বলেন এমন ফুটপাতে বই সাজিয়ে রাখা দেখেছিলেন দিল্লিতে। বাংলাদেশে সারাক্ষণই তরুণ প্রজন্ম বই পড়ে না ধরনের যে কথা চালু রাখা হয় তাকে ভুল প্রমাণ করেছে জামাল খানের এই বই বিনিময় উৎসব। লেখক হিসেবে তিনি পাঠকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজের প্রতি।

আমরা চেয়েছিলাম করোনার মাঝেও পাঠকদেরকে বই পড়ার প্রতি উৎসুক রাখতে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই বই বিনিময় উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চমূল্যের বইয়ের বাজারে পাঠকদের জন্য কিছুটা স্বস্তির জায়গা। সেই সাথে নতুন নতুন মানুষ এসে বইয়ের সংস্পর্শ পেয়ে পাঠক হয়ে উঠছেন। আমরা স্বপ্ন দেখতাম মানুষ এই বই বিনিময় উৎসবকে একদিন নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে নিবে। আমরা সে স্বপ্নের অনেকটাই কাছাকাছি এটুকু বলতে পারি।" জানান সায়মা সুলতানা।

৮০টি বই নিয়ে বই বিনিময় উৎসব করতে নেমেছিল সাগর, মাহির, অংকন। এখন তাদের কাছে ৬ হাজারেরও বেশি বই। পাঠকের ভালোবাসা, প্রকাশনীর পাশে দাঁড়ানো, বরেণ্য মানুষদের সহযোগিতা সবকিছু মিলিয়েই চট্টগ্রাম বই বিনিময় উৎসব এখন 'সার্বজনীন বই বিনিময় উৎসব' হয়ে উঠেছে বলছেন তারা। ফিলিস্তিনে নিহত শিশুদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা এই চট্টগ্রাম বই বিনিময় উৎসব সামনে আরো ঋদ্ধ হবে এই প্রত্যাশাই তাদের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন