শাড়ি: শরীরে জড়িয়ে থাকা হাজার বছরের গল্প

বণিক বার্তা অনলাইন

শাড়ির ইতিহাস প্রাচীন ভারত থেকে শুরু করে আধুনিককালের ফ্যাশন ক্যাটওয়াক পর্যন্ত বিস্তৃত। অনাড়ম্বর ও বহুমুখি এই পোশাক ব্যবহারকারী নারীর গল্পই তুলে ধরে। দীর্ঘ আয়তক্ষেত্রাকার পোশাকটি ৫ হাজার বছর ধরে নারীর অন্যতম পোশাক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েক কোটি নারীর আটপৌরে পোশাক এটি। একুশ শতকের নারীর ফ্যাশন চয়েসে শাড়ির গল্পটি আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। 

শাড়ির মতো পোশাকের প্রথম দিকের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতায়, যা উত্তর-পশ্চিম ভারতের ২৮০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিকাশ লাভ করেছিল। শাড়ি শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। এটির অর্থ ‘কাপড়ের টুকরো’। এটি মূলত তিন টুকরো কাপড়ের সমন্বয়ে তৈরি। এর মধ্যে এক টুকরো ছিল নিচের পোশাক (পেটিকোট), দ্বিতীয়টি বুকের (ব্লাউজ) ও তৃতীয় অংশটি পুরো শরীরে পেঁচিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে পরা হতো এবং এটির অগ্রভাগ দিয়ে ঢেকে রাখা হতো মাথা। 

দিল্লিভিত্তিক হাতে তৈরি কাপড়ের ব্র্যান্ড ‘র ম্যাঙ্গো’র মালিক ও ডিজাইনার সঞ্জয় গার্গ বলেন, ‘শাড়ি সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন একটি সেলাইবিহীন পোশাক। এটি সবচেয়ে বহুমুখি, প্রচলিত ও সামসাময়িক।’ গার্গের ডিজাইন করা একটি শাড়ি ২০১৭ সালে নিউইয়র্কের মডার্ন আর্ট জাদুঘরের একটি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল। সেসময় সেটি আধুনিক ফ্যাশনের একটি অনবদ্য চিহ্ন রেখে দিয়েছে। 

৬ থেকে ৯ মিটার দৈর্ঘ্যের এই শাড়ি ক্যাটওয়াক, বলিউডের ঝলমলে সিনেমা, ভারত ও বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে রাস্তায় দেখা যায়। সর্বস্তরের নারীদের পরিহিত এই শাড়ি কালজয়ী কমনীয়তার প্রকাশ তুলে ধরে। 

ভারতের উত্তর প্রদেশ বিজনোর থেকে আসা হংকংয়ের শিক্ষিকা আরাধনা চন্দ্রের কাছে শাড়ি পোশাকের টুকরোর থেকে অনেক বেশি কিছু। এটা তার পারিবারিক ইতিহাসের ভাণ্ডার এবং তিনি কে তার অনুস্মারক। 

তিনি বলেন, শাড়ির প্রতি ভালোবাসা আমার মায়ের কাছ থেকে এসেছে। এটাই সম্ভবত একমাত্র পোশাক যেটা আমি তাকে সবসময় পরতে দেখেছি। তার ঘুমানোর জন্য একটি শাড়ি ছিল, বাড়ির কাজের জন্য একটা শাড়ি ছিল, বাজারে যাওয়ার জন্য একটা শাড়ি ছিল এবং তার বিয়ের একটা আলাদা শাড়ি ছিল। 

শাড়ির জনপ্রিয়তার সঙ্গে এর বহুমুখিতার একটি গভীর যোগাযোগ আছে। ‘প্রায় একশ উপায়ে শাড়ি পরা যেতে পারে। একই শাড়ি কেবল পরার ভিন্নতা এটিকে নৈমিত্তিক অথবা আনুষ্ঠানিক করে তোলে। ভারতের অঞ্চল ভেদে শাড়ি পরার ধরন খাদ্য ও আঞ্চলিক ভাষার মতো সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা’- বলছিলেন শাড়ি নিয়ে প্রায় ৮৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সিরিজ ‘দ্য শাড়ি সিরিজ’-এর সহ-নির্মাতা মালিকা ভার্মা।

তিনি বলেন, আমরা সমসাময়িক ভারতীয় ফ্যাশনে শাড়ি পরার আঞ্চলিক পদ্ধতিগুলো আবার নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং পোশাকটি ভারতীয় শহুরে নারীদের কাছে আরো সহজলভ্য করতে চেয়েছিলাম। ঐতিহ্যগতভাবে শাড়িগুলো ব্লাউজ ছাড়াই পরা হতো এবং বেশিরভাগ পরার ধরনেই পেটিকোট নেই। 

আধুনিক শহুরে স্টাইলে পোশাকটির একপ্রান্ত পেটিকোটের সঙ্গে আটকে দিয়ে কয়েকবার কোমরের চারপাশে জড়িয়ে বুকের উপর দিয়ে অপর প্রান্ত বাম কাঁধের ওপর রাখা হয়। ব্লাউজযুক্ত এ পোশাকটির শেকড় ভারতের পার্সি সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে ঠেকে।

দিল্লিতে শাড়ি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চিশতি বলেন, শাড়ি পরার এই স্টাইলটি ১৮৭০-এর দশকে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নামে এক বাঙালি নারী জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) পার্সি নারীদের থেকে শাড়ি পরার প্রথম দিকের এই স্টাইলটি রপ্ত করেছিলেন। তারা ব্লাউজ ও পেটিকোটসহ শাড়ি পরতেন। তবে এটা ভারতীয় বাঙালি স্টাইল থেকে আলাদা ছিল। 

শাড়ির ব্লাউজটি পারস্যবাসীদের হাত ধরে একটি অভিযোজন বলা চলে। তারা লং স্কার্টের সঙ্গে পশ্চিমা স্টাইলের হাতা-গোটানো ব্লাউজ পরতো। ৭০০ বছর আগে তারা পারস্য সাম্রাজ্য থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে তারা স্থানীয় পোশাক পরিধান, স্থানীয় খাদ্যাভ্যাস রপ্ত করা এবং উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের স্থানীয় ভাষা গ্রহণ করার শর্ত মেনেই বসতি গড়েছিল।

কারুশিল্পীদের সহায়তা দেয়া এনজিও দস্তকার-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা লায়লা তায়াবজি বলেন, শাড়ি ভারতীয় রং, প্রিন্টিং ও রেশম বয়নশীল্পের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য তুলে ধরে। প্রতিটি অঞ্চল যেন শাড়িতে ভরপুর ট্রাঙ্ক। অঞ্চলভেদে এগুলোর একটি গভীর পরিচয়, নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী নকশা, মোটিফ ও রং রয়েছে। এমনকি গ্রামভেদে শাড়ির বুননও আলাদা। প্রতিটি শাড়িরই সমাজ ও তার চারপাশের মানুষদের নিয়ে একটি গল্প রয়েছে। এটি একটি ইতিহাস বই, যা আপনাকে অঞ্চল, সম্প্রদায়, কারুশিল্পী ও স্থানের ভূগোল সম্পর্কে ধারণা দেয়।

কাঞ্জিভরম রেশম শাড়িগুলোর জন্ম তামিলনাড়ুর মন্দিরের শহর কাঞ্চিপুরে। বিশেষ বুনন কৌশল ব্যবহার করে তৈরি শাড়িগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে টিকে আছে। পশ্চিমবঙ্গের বালুচরি শাড়িগুলো ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে নকশা করা হয়। বিহার রাজ্যের তুষার শাড়িগুলো অত্যন্ত নরম এবং সমৃদ্ধ গঠন ও প্রাকৃতিক গাঢ় সোনা রঙের জন্য বিখ্যাত। 

আজকাল কারখানায় তৈরি সুতি শাড়িগুলো ৫০০ রুপি দিয়েই পাওয়া যায়। তবে হস্তশিল্পের শাড়িগুলোর দাম ২ লাখেরও উপরে উঠে যায়। সবচেয়ে দামি শাড়িটি ২০০৮ সালে ৩৯ লাখ ৩০ হাজার রুপিতে বিক্রি হয়েছিল। তামিলনাড়ু রাজ্যের তিরপুরের একটি শাড়ি প্রস্তুতকারক দ্য চেন্নাই সিল্কস শাড়িটি তৈরি করেছিল। এটাতে ভারতীয় শিল্পী রাজা রবি ভার্মার ১১টি চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়। এটিই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে পাওয়া সবচেয়ে বেশি দামে শাড়ি বিক্রির ইতিহাস। 

বিগত কয়েক দশক ধরে সস্তা শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় যন্ত্রচালিত তাঁতের শাড়িগুলো জনপ্রিয় হয়েছে। যন্ত্রের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তাঁতীদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠেছে। তবে বর্তমানে দাম বেশি হলেও হস্তনির্মিত শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কারিগররা আবার শাড়ি তৈরিতে ফিরে আসছেন। 

একটি সুন্দর শাড়ি হলো জীবন্ত ও দীর্ঘকাল ধরে চলা শিল্পের এক একটি টুকরো। এটি পুরো উপমহাদেশের ইতিহাস, তার কারিগরদের দক্ষতা এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যত্নসহকারে রাখা নারীদের স্মৃতি ধারণ করে। এটি যেন নারীদের শরীরে জড়িয়ে থাকা হাজার বছরের গল্প। 

সাউথ চায়না মনিটরিং পোস্ট অবলম্বনে শিহাবুল ইসলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন