সময়ের ভাবনা

ডিজিটাল ব্যাংকিং নীতিমালা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

রেজাউল হোসেন

বাংলাদেশের ফাইন্যান্সিয়াল প্রযুক্তির পরিসরে গত এক যুগে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি। ১২ বছর আগেও ব্যাংক খাতে মানুষের অন্তর্ভুক্তি ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ। মাত্র ১২ বছরে এ খাতে অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছে এবং অন্তর্ভুক্তি বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে এ ব্যাপক সাফল্যের পেছনে মূল ভূমিকাটি রেখেছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস খাত। এমএফএস এমনকি প্রথাগত ব্যাংক খাতকে এগিয়ে নিতেও পরোক্ষ সহায়তা করেছে।  

এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী একটি কাজ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এরই মধ্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিকল্প ডেলিভারি চ্যানেল, তথা এমএফএস ও অন্যান্য ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে। এ নীতিমালার অন্যতম লক্ষ্য এমএসএমই, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ এমএফএস গ্রাহকদেরও ‘অ্যাকসেস টু ফাইন্যান্স’ নিশ্চিত করা। 

ডিজিটাল ব্যাংকিং নিয়ে দেশে সম্প্রতি ব্যাপক আলোড়ন দেখতে পাচ্ছি। অনেক বড় শিল্পগোষ্ঠী বা কনগ্লোমারেট এ খাতের ব্যবসায়ে আসতে আগ্রহী। এটি একদিকে যেমন আশাব্যঞ্জক, তেমনই আশঙ্কার কিছু বিষয়ও রয়েছে। অনেকেই অত্যুৎসাহী হয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছাড়া ব্যবসায় নেমে পড়লে তাদের ব্যবসায় সাফল্য তো দূরের কথা, দেশে ডিজিটাল ফাইন্যান্সে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিশেষত ফ্রেশ অপারেশন যারা করবে তাদের জন্য এই বিজনেস কতটুকু ফিজিবল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংকিং নীতিমালায় অর্থনৈতিক খাতের অনেক সম্ভাবনার বিষয় উঠে এলেও নীতিমালায় এমন কিছু বিষয় আছে, যা এ খাতে নবাগত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যথেষ্ট বাস্তবসম্মত ও সহায়ক নয়। ফলে নীতিমালাটি বেশকিছু সংশোধনীর দাবি রাখে। বর্তমান লেখায় ডিজিটাল ব্যাংকিং নীতিমালা সম্পর্কে সংক্ষেপে কয়েকটি মন্তব্য করতে চেষ্টা করব, যা আমার বিবেচনায় দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি। 

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংকের নিজস্ব কোনো এজেন্ট বা নেটওয়ার্ক রাখা যাবে না। অর্থাৎ ব্যাংক বা ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানকে এমএফএস/থার্ড পার্টির এজেন্ট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ট্রানজেকশন, কাস্টমার অ্যাকুইজিশন ও অন্যান্য কাজ করতে হবে। নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে আসতে চাইলে ট্র্যাডিশনাল ব্যাংক ও এমএফএসের সহায়তা ছাড়া করা সম্ভব নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতি এমন যে এমএফএস সহজে ডিজিটাল ব্যাংকের ভূমিকা নিতে পারে কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংক সহজে এমএফএস হতে পারবে না। 

 নীতিমালায় বলা হয়েছে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা/সিইওকে অবশ্যই ব্যাংকিং পেশায় ন্যূনতম ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটি বাস্তবসম্মত কিনা সেটি আলোচনার দাবি রাখে।

 নতুন লাইসেন্সধারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অন্য এমএফএস বা ব্যাংকের ওপর প্রতিষ্ঠানকে নির্ভরশীল হতে হবে। ফলে চ্যানেল ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। ব্র্যান্ডিং খরচ বাড়বে। রিটেইল পর্যায়ে তীব্র প্রতিযোগিতা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ইন্টিগ্রেশনের কারণে প্রযুক্তিগত খরচও অনেক বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া সেই প্রযুক্তি ও মার্কেট যথার্থ তত্ত্বাবধানের মতো রিসোর্সও দেশে আছে কিনা সেটিও বড় প্রশ্ন। 

 ওয়ালেট বনাম অ্যাকাউন্ট দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। সাধারণত ব্যাংকে কোনো গ্রাহক কেওয়াইসি (গ্রাহক সম্পর্কে বিশদ তথ্য) করলে অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়। এমএফএসের ক্ষেত্রে কেওয়াইসি করলে তৈরি হয় ওয়ালেট। বর্তমানে এনআইডি দিয়ে এমএফএসে একটিমাত্র অ্যাকাউন্ট খোলা যায় কিন্তু ব্যাংকে এনআইডি দিয়ে অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে এমএফএস ও ব্যাংকের এই ‘অ্যাকাউন্ট বনাম ওয়ালেট’ উদ্ভূত সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় কী নীতি গ্রহণীয় হবে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা নীতিমালায় থাকা প্রয়োজন। 

 এরই মধ্যে যারা এমএফএস ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন, তারা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে আসতে চাইলে তা কীভাবে পারবে নীতিমালায় তা পরিষ্কার করা দরকার।  ডাটা ক্লাউড ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা গাইডলাইনে থাকা প্রয়োজন।  পুরো ব্যবসা প্রক্রিয়া হোয়াইট লেবেলিংয়ের ওপর যেহেতু অনেকটা নির্ভরশীল, নীতিমালায় হোয়াইট লেবেলিং সম্পর্কে স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা থাকা আবশ্যক।

 সার্বিক ব্যবসায়িক ইকোসিস্টেম তৈরিতে অংশীদারত্ব নিঃসন্দেহে জরুরি। তবে আমার বিবেচনায় চ্যানেল অংশীদারত্বের ওপর এ সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।

 এমএফএসের তৈরি হওয়া নিজস্ব ই-মানি ও ডিজিটাল ব্যাংকে অ্যাকাউন্টের ই-মানির স্বভাব হুবহু এক হবে না। যেহেতু একটি আরেকটির ওপর নির্ভরশীল, এ বিষয়ে নীতিমালায় পরিষ্কার নির্দেশনা প্রয়োজন।

 আর্থিক মার্কেটের দিক থেকে দেখলে, ফ্রড বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। প্রযুক্তিগত নিরাপত্তাও একটি সমস্যা আকারে দেখা দিতে পারে। রিটেইল পর্যায়ে বার্গেইন পাওয়ার বাড়বে। এগুলো কীভাবে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সে সম্পর্কিত স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা নীতিমালায় থাকতে হবে।

 বর্তমানে বাংলাদেশে PSO, PSP, MFS ও WALAMA-এ চার ধরনের ব্যবসার অনুমোদন রয়েছে। তবে একমাত্র এমএফএসই বাণিজ্যিকভাবে আত্মনির্ভর হয়ে ব্যবসাটি পুরোপুরি পরিচালনার সামর্থ্য রাখে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংক বা অন্য প্রতিষ্ঠান আবার সরাসরি থার্ড পার্টির (যা মূলত এমএফএস) ও ব্যাংকের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। তবে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, এমএফএস নিজেই কিন্তু পরোক্ষে চারটি ফ্যাক্টরের (ব্যাংক, টেলিকম, ইন্টারনেট ও হ্যান্ডসেট মার্কেট) ওপর নির্ভরশীল। এক কথায়, ডিজিটাল ব্যাংক প্রকৃতপক্ষে এমএফএসসহ মোট পাঁচটি ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করবে। এ ধরনের নির্ভরশীলতা কতটা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করবে তা বড় প্রশ্ন। বরং আমি মনে করি, এ রকম বিচ্ছিন্ন এনটিটির নির্ভরশীলতার জটিল ব্যবস্থার বদলে পুরো বিষয়টিকে সমন্বিত একক কোনো ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসতে পারলে দেশের ফিনটেকের ক্ষেত্রে তা বড় সুফল বয়ে আনবে। 

রেজাউল হোসেন: মার্কেট ট্রান্সফরমেশন স্পেশালিস্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন