বর্ষাকালের স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্রতিবেশগত কারণে দেখা দেয় যেসব সমস্যা

অধ্যাপক ডা. শংকর নারায়ণ দাস

বর্ষাকালে যেমন দ্রুত আবহাওয়ার তারতম্য ঘটে, তেমনি পরিবেশ-প্রতিবেশও বিনষ্ট হয়। জলাবদ্ধতা, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, বিশুদ্ধ পানির সংকট, বজ্রপাত, রাস্তাঘাট নোংরা হয়ে যাওয়া প্রভৃতি কারণে এ সময় স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বেড়ে যায় মশা, মাছি, সাপসহ বিভিন্ন রোগের জীবাণু বহনকারী কীটপতঙ্গের উপদ্রব। আচমকা ঝড়-বৃষ্টির দরুন রাস্তাঘাটে গাছ ভেঙে পড়ে পথচারীদের আহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এ সময় পরিবেশ-প্রতিবেশের স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হওয়ার কারণে বেশকিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

মশাবাহিত রোগ: বর্ষাকালে আমাদের দেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার না রাখলে, ফুলের টব, ডাবের খোসা প্রভৃতিতে পানি জমলে এডিস মশা বিস্তার লাভ করতে পারে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহকও একই। স্ত্রী এডিস ঈজিপশাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া ছড়ায়। দুটি জ্বরের উপসর্গগত মিলও রয়েছে। তবে ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণের ঝুঁকি এমনকি মৃত্যুঝুঁকি থাকলেও চিকুনগুনিয়ায় এ ধরনের ঝুঁকি কম। এছাড়া এ সময় মশাবাহিত আরেকটি রোগ দেখা দেয়—ম্যালেরিয়া। অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ছড়ায়। তাই বর্ষায় ঘরে কিংবা বাইরে যেখানেই থাকুন সচেতন থাকা জরুরি।

ছত্রাক সংক্রমণজনিত রোগ: বর্ষার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ছত্রাক সংক্রমণজনিত নানা রোগবালাই দেখা দেয়। এ সময় বেশি হতে দেখা যায় খোসপাঁচড়া। সারকোপটিস স্ক্যাবি নামের একধরনের পরজীবীর কারণে দেহের বিভিন্ন স্থানে দানার মতো তৈরি হয়। সাধারণ অর্থে একে খোসপাঁচড়া বলা হয়ে থাকে। এতে আক্রান্ত হলে প্রচণ্ড চুলকানি হয়। এটি একধরনের ছোঁয়াচে রোগ, ফলে একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্যরাও আক্রান্ত হতে পারে।

বর্ষার গুমোট আবহাওয়ায় ব্যবহৃত কাপড় ধোয়ার পর শুকাতে বেশ অসুবিধা হয়। এ সময় রোদের দেখা মেলে না। ফলে ভেজা কাপড় ভালোভাবে শুকাতে পারে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার না করা, ময়লা কাপড় ব্যবহার করার মাধ্যমে দাদ ও ছুলির প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায়। দাদ ও ছুলি দুটি আলাদা রোগ হলেও দুটিই ছত্রাকজনিত চর্মরোগ। দাদকে রিংওয়ার্ম টিনিয়াসিস বা ডার্মাটোফাইটিস বলা হয়। সাধারণত বগল, পিঠ, বাহু বা কুঁচকিতে এটি বেশি হয়ে থাকে। অন্যদিকে, ছুলির ইংরেজি নাম পি. ভার্সিকালার। অঞ্চলভেদে এটি ছুলি, ছলম, ছৌদ প্রভৃতি নামে পরিচিত। 

বর্ষায় প্রকৃতি একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে। কখনো তীব্র গরমে ঘেমে আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ত্বক আর্দ্র হয়ে থাকে। ফলে মাথার ত্বকে ব্রণের মতো দানা বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এতে খুশকি, চুল পড়াসহ মাথার ত্বকের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ: বর্ষাকালে বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। টিউবওয়েলসহ নিরাপদ পানির উৎসগুলো ডুবে যায়। ফলে বর্ষাকালে সাধারণ রোগ হিসেবে দেখা দেয় ডায়রিয়া ও টাইফয়েড। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার কারণে ড্রেনের নোংরা পানি, মলমূত্র প্রভৃতি বৃষ্টির পানির মাধ্যমে পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায়। এ দূষিত পানি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

এ সময় অনেকের চোখ উঠতে দেখা যায়। চোখ ওঠাকে বলা হয় কনজাংটিভাইটিস বা রেড আই। চোখের পর্দায় কনজাংটিভা প্রদাহের কারণে এ অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে ও সংক্রামক রোগটি হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত তোয়ালে-রুমাল-কাপড়চোপড়, বিছানার চাদর, বালিশ, সেলফোন ইত্যাদির মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সাপের কামড়: বর্ষাকালে মাঠ-ঘাট, ফসলের জমি প্লাবিত হয়ে যায়। তখন সাপ এসে বসতভিটা, খড়ের গাদা, রাস্তার পাড়, গাছ প্রভৃতি জায়গায় আশ্রয় নেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাপের কামড়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সাপে কামড়ালে একদমই সময় নষ্ট করা যাবে না। অজপাড়া গাঁয়ের মানুষের ভেতর এখনো ওঝা, বৈদ্যদের শরণাপন্ন হওয়ার প্রবণতা আছে। এসব কুসংস্কার রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সাপে কামড়েছে—এমন সন্দেহ হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। চিকিৎসক প্রাথমিক পরীক্ষা করে অ্যান্টিভেনম দিলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন।

বজ্রপাত ও গাছ ভেঙে পড়া : বর্ষায় প্রচুর বজ্রপাত হতে দেখা যায়। এ সময় নিরাপদে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় ধাতব বস্তু, সিঁড়ির রেলিং, জানালার কাচ, ল্যান্ডফোন, গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, টিভি, ফ্রিজ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাত শুরু হলে নিকটস্থ কংক্রিটের ঘরে আশ্রয় নিন। অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টির দিনে রাস্তাঘাটে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতের তার পড়ে থাকে। তারের স্পর্শে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। তাই এ সময় বাইরে গেলে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করুন। 

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ

সিনিয়র কনসালট্যান্ট

ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন