সাক্ষাৎকার

চিকিৎসা সহজলভ্য করতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ হওয়া উচিত

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান (সাবেক)। বর্তমানে দেশের একটি শীর্ষ বেসরকারি হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি অ্যান্ড রেডিওথেরাপি বিভাগের কনসালট্যান্ট। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারের চিকিৎসা, অধ্যাপনা ও গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন এ জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক। ওরাল ক্যান্সার বা মুখগহ্বরের ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

মুখগহ্বরের ক্যান্সার নিয়ে কি দেশে কোনো সচেতনতামূলক কার্যক্রম রয়েছে?

অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় ক্যান্সার শনাক্ত করা সহজ। আমরা যেহেতু দুই বেলা ব্রাশ করি, খাবার খাই কুলি করি। তাই কেউ যদি একটু সতর্ক হয় তাহলে লক্ষণ দেখা দিলেই সে বুঝতে পারবে। ক্যান্সারের বেশকিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন মুখের ভেতরে ছোট ছোট চামড়া ওঠার বিষয়টা যদি দীর্ঘদিন থাকে, কোনোভাবেই ভালো হচ্ছে না, তাহলে সতর্ক হতে হবে। মুখের কোনো জায়গায় ঘা, মাড়ি ফুলে যাওয়ার মতো লক্ষণও দেখা দেয় অনেকের। ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে সেগুলো দীর্ঘমেয়াদি হয়। আবার লিউকোপ্লাকিয়া ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। তবে অবস্থায় রোগী ডাক্তারের কাছে এলে তা সরিয়ে ফেলা যায়, তখন আর ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে না।

মুখে বা দাঁতে কিছু হলে আমরা সাধারণত ডেন্টিস্টের কাছে যাই। ক্যান্সারের কোনো আশঙ্কা থেকে থাকলে তারা কি সেটা শনাক্ত করতে পারবেন নাকি ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে?

হ্যাঁ, ডেন্টিস্টরাই পারবেন। ওরালের বেশির ভাগ সমস্যা ডেন্টিস্টরাই হ্যান্ডেল করে থাকেন। ওরাল হাইজিনের রোগীরা তাদের কাছে বেশি যান। ফলে রোগ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আর ডেন্টিস্টরা সাহায্য করতে পারবেন। তবে ডেন্টিস্টদের জন্য শনাক্ত করা বেশি সহজ। কারণ তার কাছে রোগীরা বেশি যায়। কেউ তার কাছে দাঁতের সমস্যা নিয়ে এলে তারা যদি সব মাড়ি একবার পরীক্ষা করে দেয়, মুখের ভেতরটা যদি দেখে দেয়, চারদিকে, মাড়িতে, জিহ্বার নিচে, তালুতে কিছু আছে কিনা, ওরাল মিউকাসে কিছু আছে কিনা সেগুলো চেক করে দেয় তাহলে কাজটা খুব সহজ হয়ে যাবে।

প্রতিটা ক্যান্সারের পরীক্ষা পদ্ধতি কি আলাদা নাকি একটাতেই সবগুলো ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে?

ক্যান্সার আসলে একটিমাত্র রোগ না। ২০০ ধরনের ক্যান্সার রয়েছে যেগুলোতে মানুষ আক্রান্ত হয় এবং এর প্রতিটা আলাদা ধরনের হয়। প্রতিটা ক্যান্সার রোগী কোন স্টেজে ডাক্তারের কাছে এল, সঙ্গে বড় বড় প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে এল তার মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। ফলে প্রতিটি রোগীই সত্যি বলতে আলাদা হয়ে পড়ে। তাই যেমন একই রকম চিকিৎসা দিয়ে সবার রোগ ঠিক করা যায় না, তেমন সব রোগীর ডায়াগনসিসও একভাবে করা যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লাঙ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বোনম্যারো করতে হয়, স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করতে হলে কোর বায়োপসি করতে হয় ইত্যাদি।

যদি ২০০-৩০০ রকমের ক্যান্সার থাকে, তাহলে প্রতিটা ক্যান্সারের জন্য ডায়াগনসিস করা তো অনেক ব্যয়বহুল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

ক্যান্সারের ২০০ রকম থাকলেও এগুলো ভাগ ভাগ করা যায়। কয়েকটাকে এক ভাগে ভাগ করা যায়, বাকিগুলোকে অন্য ভাগে। ফলে দেখতে হবে কোন রোগীর জন্য কোন ভাগটা গুরুত্বপূর্ণ। সেভাবে এগোতে হবে। বেসিক স্ক্যান করলেও অনেক কিছু ধরা পড়ে। তাছাড়া সব ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সীমিত। সেগুলো কাছাকাছি, প্রায় একই রকম। কোথাও পিণ্ড, কোথাও ঘা, আবার সেগুলো শুকাচ্ছে না। গলার স্বর ভেঙে গেল, ওজন কমে গেল, মলমূত্রের স্বাভাবিকতায় পরিবর্তন হলো। ছোট ছোট লক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে লাইন ধরে এগোলে ডায়াগনস্টিক করা সহজ হয়ে যায়। এসব জেনে-বুঝে নিয়ে যার যেটা দরকার সেটা পরীক্ষা করতে হবে।

মুখগহ্বরের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে থেরাপি, সার্জারি চিকিৎসা ব্যয় কেমন হয়?

মুখগহ্বরের ক্যান্সারের সার্জারি সাধারণত ব্যয়বহুল হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এলে খরচ খুব কম। অ্যাডভান্স স্টেজে রোগীরা ডাক্তারের কাছে এলে প্রথমে বড় ধরনের সার্জারি করে তারপর রিকনস্ট্রাকশন করতে হয়। সার্জারিতে মুখের অনেক কিছু কেটে ফেলতে হয়। আবার মুখের আদল ঠিক করার জন্য শরীরের অন্য জায়গা থেকে অনেক কিছু এনে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এছাড়া অনেকের কেমোথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা করতে হয়। এগুলো খুব বেশি সময়সাপেক্ষ হওয়ার কারণ নেই। তবে অবশ্যই ব্যয়সাপেক্ষ।

জীবনাচরণের কারণে মুখগহ্বরের ক্যান্সার কতটা প্রভাবিত হয়?

আমাদের মুখের ভেতর একধরনের ভাইরাস কাজ করে, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। এটা জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্যও দায়ী আর মুখের ক্যান্সারের জন্যও দায়ী। ধূমপান এর একটি কারণ। মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৮০ ভাগেরই ধূমপানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। মদ খেলেও রোগ হতে পারে। তামাক চর্বণ, জর্দা, চুন, সুপারি সবই ক্যান্সার সৃষ্টি করে।

সরকারি বা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

ক্যান্সার চিকিৎসায় বাংলাদেশে সীমাবদ্ধতা অনেক। ওষুধের দাম একটা সীমাবদ্ধতা। সরকার যদি ওষুধ সরবরাহ করতে পারত তাহলে ভালো হতো। এরপর আসে বিকিরণ চিকিৎসা। ঢাকা শহরে সরকারি খাতে ক্যান্সার চিকিৎসার যেগুলো মেশিন আছে তার সবগুলোই নষ্ট। সরকারি হাসপাতালে যেখানে চিকিৎসা চালু আছে সেখানে আছে পুরনো মেশিন, পুরনো ধাঁচের। শুধু একদিক থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হলে হবে না। সেটার প্রতিচ্ছবি আসতে হবে সবদিক থেকে। রোগীরা এল আর আমরা তাকে ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে দিলাম তাহলে হবে না। তারা দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ। অনেক রোগী আছে যারা স্তন ক্যান্সার হয়েও সুস্থ আছেন। তারা সমাজে অবদান রাখছেন, পরিবারে অবদান রাখছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি খাতে তো ক্যান্সার চিকিৎসার মেশিনগুলো বন্ধ নেই। সরকারি খাতে মেশিনে কেন সমস্যা হচ্ছে সেটা খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। তাছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এত বেশিসংখ্যক রোগীকে সেবা দেয়া সম্ভব না। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষেও এত সেবা দেয়া সম্ভব না। সেজন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ হওয়া উচিত। যারা প্রাইভেট উদ্যোক্তা আছেন সরকারের উচিত তাদের কর মওকুফ করে, বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, ঋণের ব্যবস্থা করে তাদের ক্যান্সার হাসপাতাল বানানোর কাজে সহযোগিতা করা। তাহলে সমন্বয় সম্ভব হবে, তা না হলে সরকারের জন্য কঠিন হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন