
সুবহে সাদিকের পরপরই আমরা ছয় শিক্ষার্থী—ফজলুল, ইমরান, শামীম, রবিউল, সোহান এবং আমি শাহজাদা একত্রিত হই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে। আমরা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লিস্ট গ্রুপের সদস্য। পার্বত্য বান্দরবান জেলার মারায়ন তং পাহাড়ের চূড়ায় ক্যাম্পিং করার ইচ্ছা বহু পুরনো। তখন ঘড়িতে সময় ৬টা। সবার তল্পিতল্পা গোছানো শেষ। সঙ্গে রয়েছে তাঁবু এবং হেলমেট, হ্যান্ডগ্লাবস, হেডলাইটসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আর একমাত্র বাহন সাইকেল। সারিবদ্ধভাবে আমরা রওনা দিই মারায়ন তং পাহাড়ের উদ্দেশে।
সূর্য তখনো উঁকি দেয়নি। ভোরের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় সাইক্লিং করতে বেশ ভালোই লাগছিল। ক্যাম্পাস থেকে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীতে পৌঁছে যাই। নতুন ব্রিজ পার হয়ে একটু সামনেই একটি হোটেলে নাশতা করার জন্য বিরতি নিলাম। চলার পথে বড় সেতু ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের সামনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম আর স্মৃতি সংক্ষরণে ছবি তুলেছি। কর্ণফুলী, বাঁশখালী উপজেলা পেরিয়ে টইটং বাজারে দুপুরের আহারের জন্য থামি। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আশপাশে খাবারের হোটেল আছে কিনা। তিনি আমাদের একটি হোটেলের সামনে নিয়ে এলেন। স্বল্পমূল্যের খাবার দারুণ ছিল। আমাদের মেনুতে ছিল ভাত, গরুর গোশত, সবজি ও ডাল। পুনরায় শুরু হয় যাত্রা। সূর্য তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। রাস্তার ডান দিকে লবণ তৈরির দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। বাকিরা একটু পেছনে পড়ায় এ ফাঁকে আমি ও ফজলুল সরজমিন লবণ তৈরির প্রক্রিয়া দেখে নিলাম। লবণাক্ত পানি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় লবণ সংগ্রহ করেন তারা।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা চকরিয়ায় বিরতি নিই। তখন শেষ বিকাল। সাইকেলে করে ১১০ কিলোমিটারের মতো পাড়ি দেয়া শেষ আমাদের। সবাই বেশ ক্লান্ত। একটি মসজিদে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। পরের দিন ভোরে ফজরের নামাজের পরপরই রওনা হই। চকরিয়া থেকে বান্দরবানের লামায় ঢুকে পড়ি। এ পথটা চোখজুড়ানো। দুই পাশে বৃক্ষরাজিঘেরা সবুজ পাহাড়। তার বুক চিরে বেরিয়ে গেছে আঁকাবাঁকা রাস্তা, যা দেখে নিমিষেই দূর হয়ে যায় ক্লান্তি। নিঃসন্দেহে প্রকৃতিপ্রেমীরা এমন দৃশ্য দেখার জন্য আকুল হয়ে থাকেন।
সহযোদ্ধা ইমরান জানায়, তার পরিচিত একজন পাহাড়ি ভাইয়ের বোনের বিয়ে। তিনি বিয়েতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মাতামুহুরী নদীর ব্রিজ পেরিয়ে আমরা বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হই। আগে কখনো আদিবাসীদের বিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। এবারই প্রথম সুযোগ হলো। তারা আন্তরিক ও মিশুক। দুপুরের দিকে আবাসিক নামক জায়গায় চলে আসি। এখান থেকে ডান দিকে দুই-তিন কিলোমিটার ট্রেকিং করতে হবে। শুকনো খাবার, পানি নিয়ে এবং স্থানীয় হোটেলে রাতের খাবারের অর্ডার করে সাইকেল নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে শুরু করলাম।
বলতে বাধা নেই ১ হাজার ৬৪০ ফুট উচ্চতার পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে বেগ পেতে হয়েছে। তবে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চারদিকের সৌন্দর্য দেখে নিমিষেই দূর হয়ে যায় সব ক্লান্তি। যেখানে মানুষ হেঁটে উঠতেই হাঁপিয়ে ওঠে সেখানে আমাদের সাইকেল নিয়ে উঠতে দেখে অন্য দর্শনার্থী অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। কেউ কেউ অকপটে স্বীকার করে নেয় বীরত্বের কথা। আমরা তাঁবু রেডি করি। আঁধার নেমে এলে জ্বলে ওঠে ক্যাম্প ফায়ার। শুরু হয় বারবিকিউ করার প্রস্তুতি। ঢাকা থেকে আসা কয়েকটি দল গলা ছেড়ে গান ধরে। আমরা পাহাড়টা ঘুরে দেখতে বের হই।
মারায়ন তং বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায় অবস্থিত মিরিঞ্জা রেঞ্জের একটি পাহাড়। এর উচ্চতা প্রায় ১ হাজার ৬৪০ ফিট। পাহাড়টি মারায়ন তং জাদি, মারায়ন ডং, মারাইথং নামেও পরিচিত।
ভোরের দিকে আবার পাহাড়টা ঘুরে দেখার জন্য বের হই। বাতাসের কোমল প্রবাহে হৃদয় জুড়িয়ে যায়। সূর্যোদয়ের সময় আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল রঙিন আলো। এত সুন্দর! এখানে বারবার আসতে মন চাইবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লিং গ্রুপ থেকে প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণে বের হন ভ্রমণপ্রেমীরা। সাইক্লিস্ট গ্রুপটির স্লোগান—দুই চাকায় দুর্নিবার। গ্রুপটি বিভিন্ন জাতীয় দিবসকে কেন্দ্র করে নিয়মিত রাইডের আয়োজন করে থাকে। তাছাড়া প্রতি শুক্রবারে আয়োজন করা হয় বাইক ফ্রাইডে। শরীরচর্চায় উৎসাহসহ সামাজিক সচেতনতামূলক প্রতিপাদ্য সামনে রেখে ক্রস কান্ট্রি রাইডও দিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লিং গ্রুপের সদস্যরা।